শেয়ারবাজারে ধস, সংস্কারে আশার রেখা

শেয়ারবাজার ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০২ ১১:০৩:৪৮
শেয়ারবাজারে ধস, সংস্কারে আশার রেখা

২০২৪-২৫ অর্থবছরটি বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের জন্য ছিল রাজনৈতিক পালাবদল, বিনিয়োগকারীদের চরম হতাশা এবং কাঠামোগত সংস্কারের যুগান্তকারী প্রয়াসে মোড়ানো এক দ্বৈতধর্মী বছর। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাজারে দেখা দেয় প্রচণ্ড ধস, বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণে লোকসানে পড়েন, এবং বাজার মূলধন থেকে হারিয়ে যায় প্রায় ৩৩ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। তবে এই পতনের মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনার নতুন আলো নতুন বিএসইসি নেতৃত্বের অধীনে সংস্কার ও স্বচ্ছতার পদক্ষেপ ভবিষ্যতের বাজারকে গঠনমূলক গতিপথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

অর্থবছরের শুরুতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশায় বাজার কিছুটা সক্রিয় হলেও সরকারের পতন এবং অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হওয়ার পরপরই সূচকগুলো নিম্নমুখী হতে শুরু করে। ডিএসইএক্স সূচক ৯.৯১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৪,৮৩৮ পয়েন্টে, এবং ব্লু-চিপ কোম্পানিগুলোর ডিএস৩০ সূচক ৪.৯২ শতাংশ কমে গিয়ে থামে ১,৮১৬ পয়েন্টে। এই ধস শুধুমাত্র সূচকেই সীমাবদ্ধ ছিল না বাজার মূলধনে ৩৩ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকার ক্ষতি এবং হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীর পুঁজি ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

এই ধসের আরেকটি লক্ষণীয় দিক ছিল বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তার হ্রাস। সিডিবিএল এর তথ্যমতে, শেয়ার ব্যালেন্স থাকা ৮৩,৬১৯টি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার) অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যায়, যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা সংকট ও হতাশা কতটা গভীর ছিল।

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গঠিত নতুন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বাজার সংস্কারে বেশ কিছু দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কমিশন গঠনের পরপরই বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়মের শেকড় অনুসন্ধানে গঠন করা হয় একাধিক তদন্ত কমিটি। ইতোমধ্যে ১২টি তদন্ত প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে, যেগুলোতে শেয়ার দর কারসাজি, তথ্য গোপন, অস্বচ্ছ আইপিও কার্যক্রমসহ নানা অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।

একইসঙ্গে গঠন করা হয় একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্ক ফোর্স, যারা এখন পর্যন্ত পাঁচটি মূল প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে। এসব প্রতিবেদনে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (IPO), মিউচুয়াল ফান্ড নীতি ও মার্জিন ঋণ কাঠামোতে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাজারে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর রোডম্যাপ প্রতিষ্ঠার আশা করা হচ্ছে।

অর্থবছরজুড়ে প্রাথমিক বাজার কার্যত স্থবির ছিল। একটিও আইপিও, রাইটস শেয়ার বা প্রেফারেন্স শেয়ার ইস্যু হয়নি। এমনকি বেশ কয়েকটি কোম্পানির প্রস্তাবিত শেয়ার ইস্যু আবেদন নতুন কমিশন দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল কোম্পানির প্রবেশ ঠেকাতে সচেষ্ট থেকেছে।

এর পাশাপাশি বিএসইসি ৩০ কোটি টাকার ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধন শর্ত আরোপ করে ইতোমধ্যেই ৬০টি দুর্বল তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে নোটিশ ইস্যু করেছে, যা বাজার পরিশোধন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে কমিশন বিও অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ফি ৪৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকায় নামিয়ে আনে। পাশাপাশি, মার্জিন অ্যাকাউন্টে নেতিবাচক ইক্যুইটি সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানো হয়, যা ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ সহায়তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় বিএসইসি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কমিটি গঠন করছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে বাজারে গুণগত পরিবর্তন আনা, বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা এবং মানসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তি সহজতর করা। এতে করে বহুজাতিক ও বৃহৎ দেশীয় কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম জানান, “বর্তমান কমিশন ইতিমধ্যেই ১২টি তদন্ত রিপোর্ট ও ৫টি টাস্ক ফোর্স রিপোর্ট হাতে পেয়েছে। এগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা বাজারে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”

তিনি আরও বলেন, “বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ-অভিযোগ ও বাজারের নৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে একটি স্থিতিশীল, গতিশীল ও টেকসই বাজার গঠনের লক্ষ্যে কমিশন ধারাবাহিক কাঠামোগত সংস্কার গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছে।”

২০২৪-২৫ অর্থবছর শেয়ারবাজারের জন্য ছিল উত্তেজনা, হতাশা, কিন্তু একইসঙ্গে আত্মসমালোচনার ও ভবিষ্যতের জন্য ভিত্তি গড়ার সময়। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ভূমিকা বাজারকে একটি সংকট থেকে সুযোগে রূপান্তরের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। এখন প্রশ্ন একটাই এই সংস্কার ও প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা সময়োপযোগীভাবে কার্যকর হবে এবং তা দীর্ঘমেয়াদে আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কতটা কার্যকর প্রমাণিত হবে?

-শরিফুল, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ