মতামত

তথ্য ফাঁস: সাংবাদিকতা, নৈতিকতা না রাজনৈতিক অস্ত্র?

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুন ২২ ১৬:২৯:১৩

ইদানীং বাংলাদেশের রাজনীতিতে গোপন তথ্য ফাঁস করা, ভিডিও ফাঁস করা, ছবি ফাঁস করা, স্ক্রিনশট ফাঁস করা প্রায় নিয়মিত কাজ হয়ে গেছে। এটি যেমন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘটছে, তেমনি অরাজনৈতিক ক্ষেত্রেও ঘটছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন দুই নেতার ফোনালাপ ফাঁস করা হচ্ছে, তেমনি অরাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা কার সঙ্গে প্রেম করছেন সেই ধরনের ছবি বা ভিডিও ফাঁস করা হচ্ছে।

এই তথ্য ফাঁসকে কেন্দ্র করে একটি ‘তথ্য অর্থনীতি’ দাঁড়িয়ে গেছে। ধরুন, কোনো সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তাঁর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের একটি ভিডিও বা অডিও কোনো ব্যক্তি সংগ্রহ করলেন, যাঁর সেই তথ্য জনসমক্ষে আনার মতো সামাজিক মূলধন (social capital) আছে। তিনি প্রথমে সেই কর্মকর্তার কাছে অর্থ দাবি করবেন। না দিলে ‘ফাঁস’ করার হুমকি দেবেন। একবার যদি সেই কর্মকর্তা অর্থ দেন, তবে তাঁকে নিয়মিত ‘টাকা’ দিতে হবে। আর না দিলে সেই তথ্য ফাঁস করে দেওয়া হবে এবং সেই ফাঁসকারীর ‘সাংবাদিকতা’ বা ‘সাহসিকতা’র সুনাম তৈরি হবে।

তবে এসব তথ্য ফাঁস সব এক চোখে দেখা যায় না। এর মধ্যে কিছু আছে ‘নৈতিক’ (ethical) তথ্য ফাঁস, যা যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য। যেমন, কেউ ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি করলে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে যৌন নিপীড়ন করলে, নাগরিক অধিকার খর্ব করলে সেই তথ্য জনগণের সামনে আনা নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। যেমন, উইকিলিকস-এর মাধ্যমে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নানা অসংগতির প্রকাশ কিংবা ফেসবুক কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারির তথ্য ফাঁস, যা সামাজিকভাবে গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করে।

আমেরিকান প্রেক্ষাপটে, এথিকাল তথ্য ফাঁসের একটি বড় উদাহরণ হলো এডওয়ার্ড স্নোডেন। তিনি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (NSA) অবৈধ নজরদারি কার্যক্রম ফাঁস করেছিলেন, যেখানে নাগরিকদের ব্যক্তিগত ফোনকল, ইমেইলসহ নানা তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছিল সরকারিভাবে, বিনা অনুমতিতে। এই ফাঁস আন্তর্জাতিকভাবে নজর কাড়ে এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বনাম জাতীয় নিরাপত্তা বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে।

একইভাবে, চেলসি ম্যানিং এর তথ্য ফাঁস মার্কিন সেনাবাহিনীর যুদ্ধ অপরাধ, বেসামরিক মানুষ হত্যার ভিডিও এবং ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক গোপন নথি সামনে এনেছিল। এইসব তথ্য ফাঁস সরকারকে জবাবদিহিতে বাধ্য করেছিল এবং একটি এথিকাল ফাঁস হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে, যদিও বিতর্ক ছিল এর কৌশল এবং পরিণতি নিয়ে।

কিন্তু সব তথ্য ফাঁসই যে নৈতিক, তা নয়। কিছু ফাঁস হয় ‘প্রিডেটরি’ বা শিকারী ধরনের। অর্থাৎ, ব্যক্তিগত আক্রোশ, অর্থনৈতিক স্বার্থ, রাজনৈতিক ফায়দা কিংবা প্রতিপক্ষকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তিগত বা খণ্ডিত তথ্য ফাঁস করা হয়। যেমন, নির্বাচনের আগে কোনো প্রার্থীর পুরনো ভিডিও, ব্যক্তিগত ছবি বা কথোপকথন জনসমক্ষে আনা, যা হয়তো সেই সময় রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু এটি একধরনের সামাজিক নিপীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারেরই নামান্তর।

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনটা নৈতিক তথ্য ফাঁস, আর কোনটা প্রিডেটরি তথ্য ফাঁস এটি নির্ধারণ করবো কীভাবে? এক্ষেত্রে ‘কেস বাই কেস’ যাচাই প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের সমাজে সমালোচনাশীল (critical) জনমত গঠনের যে ‘ক্রিটিকাল ম্যাস’ দরকার, তা খুব সীমিত। আর যাঁরা আছেন, তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক বিভাজনে এমনভাবে জড়িত যে তাঁরা প্রথমে চিন্তা করেন, "এই তথ্যটা আমার প্রতিপক্ষকে ক্ষতিগ্রস্ত করলো কি না", তাঁরা বিবেচনা করেন না এটি নৈতিক তথ্য ফাঁস কি না।

অন্যদিকে যারা এই তথ্য ফাঁস করে নিজেদের ‘সাংবাদিক’ বা ‘সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁরাও প্রায়ই এই একই পক্ষপাতদুষ্ট চিন্তাধারায় ভোগেন। ফলে তাঁরা হয়তো একদিকে সাহসী হয়ে উঠেন, কিন্তু অন্যদিকে অনৈতিকতার ফাঁদে জড়ান।

এক্ষেত্রে আমেরিকায় উধারন দেই। যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সির সময় নানা ‘লিকড’ অডিও, ভিডিও বা ব্যক্তিগত কথোপকথন প্রকাশ হয়, যেগুলোর কিছু হয়তো জনস্বার্থে প্রাসঙ্গিক ছিল, কিন্তু অনেক ছিল কেবল চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে। যেমন, “Access Hollywood” ভিডিও, যেখানে ট্রাম্প নারীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন, তা নির্বাচনের ঠিক আগে ফাঁস হয় এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রভাব ফেলে। যদিও এর মধ্যে নৈতিক ফাঁসের উপাদান ছিল (কারণ এটি একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর আচরণ নিয়ে), আবার এটিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছিল।

তথ্য ফাঁসের এই সংস্কৃতি রাজনৈতিক এবং সামাজিক অ্যাক্টিভিস্টদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যারা এটিকে ব্যবহার করে নিজেদের ভিক্টিম-হিরো জেনারেট করেন অর্থাৎ তারা একদিকে অন্যায় ফাঁস করছেন দাবি করে জনমত আদায় করছেন, অন্যদিকে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য বা অর্থনৈতিক লাভের জন্য এটি ব্যবহার করছেন।

তথ্য ফাঁসের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটা অনেক সময় সমাজের গভীরতর অসঙ্গতি উন্মোচনের হাতিয়ার। কিন্তু সেটি হতে হবে নৈতিক ও জবাবদিহিমূলক। এই নৈতিক তথ্য ফাঁসের কালচার তৈরি করা খুব সহজ নয়। কারণ এখানে খুব সহজেই পথ হারানো যায়। একজন এথিকাল তথ্য ফাঁসকারী ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রিডেটোরি তথ্য ফাঁসকারীতে পরিণত হতে পারেন, বিশেষ করে যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ এতে জড়িত হয়ে পড়ে।

আমরা যারা এই বিষয়ে কথা বলি, যাঁরা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে অ্যাক্টিভিজম করি, তাঁদের এই বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। যদি কেউ শুধুমাত্র এই ফ্রেমে তথ্য ফাঁসকে বিচার করেন "এটা আমার শিবিরের পক্ষে, না বিপক্ষে?"—তবে তিনি ভবিষ্যতে নিজের জন্য ফাঁদ তৈরি করছেন। কারণ আজ যে পদ্ধতি দিয়ে আপনি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করলেন, কাল তা আপনার বিরুদ্ধেও ব্যবহৃত হতে পারে।

তথ্য ফাঁসকারী যদি নৈতিক না হন, প্রিডেটোরি হন, তবে তিনি সমাজের কল্যাণের জন্য কাজ করছেন না; তিনি নিজের বা তাঁর গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। তাই এই ক্ষেত্রে আমাদের যেমন নৈতিক তথ্য ফাঁসের কালচার গড়ে তুলতে হবে, তেমনি প্রিডেটোরি তথ্য ফাঁসের প্রবণতা ও এর পলিটিক্যাল ইকোনমিকে প্রশ্ন করতে হবে। অন্যথায় সমাজে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্পেস বিষাক্ত হয়ে যাবে। আমরা নৈতিক সাংবাদিকতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা চাইছি, কিন্তু যদি তথ্য ফাঁসকে নৈতিকতা ছাড়া, পক্ষপাত নিয়ে পরিচালনা করা হয়, তবে সেটি একধরনের তথ্য-সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, যার পরিণতি কারও জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

আমেরযত কাহিনি

আমেরযত কাহিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণে পরিপূর্ণ ‘আম’ শুধু একটি ফল নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে গভীরভাবে প্রোথিত এক... বিস্তারিত