মতামত
নির্বাচিত নারী, অলঙ্কার নয়: গণতন্ত্রে নারীর শক্তির সন্ধান

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারী প্রশ্ন বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নারী-প্রশ্নে যেমন নীতি ও অবস্থানের পার্থক্য রয়েছে, তেমনি আছে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকট। এখানে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি নারীদের ওপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমকে ধর্ম ও সমাজ রক্ষার পথ হিসেবে দেখে। অন্যদিকে প্রগতিশীল অংশ নারী স্বাধীনতার নামে রাজনৈতিক লেনদেনেই বেশি আগ্রহী।
গত কয়েক দশকজুড়ে নারী শরীর, শ্রম ও সম্পত্তির অধিকার নিয়ে অধিকাংশ সময় পুরুষেরাই রাজনীতি করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কৌশল বদলেছে: এখন ইসলামপন্থী রাজনীতির মধ্যেও নারী বক্তা আনা হচ্ছে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য—যাতে বার্তাটি গ্রহণযোগ্য হয়, মনে হয় নারীর প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে কেননা নারী কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবে মূল ন্যারেটিভ বদলায়নি। এই প্রবণতা সাময়িকভাবে দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক হলেও, তা নাগরিক হিসেবে নারীর মর্যাদা ও অধিকার অর্জনের পথে বড় প্রতিবন্ধক। এ প্রেক্ষিতে সরাসরি নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি রাজনীতিকে বদলে দিতে পারেন। কারণ, যখন একজন নারী সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদে যান, তখন তিনি আর কেবল দলের 'দয়ার ফল' নন—তাঁর পেছনে থাকে রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা ও জনআস্থা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হবে। কিন্তু এর কোনো আসনেই সরাসরি ভোট হবে না—সবই মনোনয়নের ভিত্তিতে। দলের প্রধানরাই নির্ধারণ করবেন কে হবেন সাংসদ। এটি দলীয় স্বার্থে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু নারী অধিকারের প্রশ্নে এটি একটি বড় ব্যর্থতা। ৫০ শতাংশ নারী নাগরিকের জন্য এমন এক কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে যেখানে তাঁরা নিজের অধিকার নিয়ে ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
বহু নারী সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়নে গিয়ে সংসদে গেছেন, কিন্তু তাঁদের মধ্যে খুব কমই ছিলেন যারা নারীর অধিকার প্রশ্নে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। অধিকাংশই ছিলেন অলঙ্কারস্বরূপ। তাঁরা সংসদে ‘উপস্থিত’ ছিলেন, কিন্তু ‘অর্থবহ ভূমিকা’ রাখতে পারেননি। কারণ, তাঁদের কোনো নির্বাচনী দায় ছিল না, জনগণের ভোটে নয়, বরং দলের দয়ায় তাঁরা সংসদে গিয়েছেন। সেই কাঠামোর ভেতরে থেকে তাঁরা পুরুষতান্ত্রিকতা ভাঙার সাহস পাননি। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে প্রয়োজন সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারীর সংসদে যাওয়া।
যুক্তরাজ্যে ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের ‘নিউ লেবার’ সরকার ১০১ জন নারী এমপি নির্বাচিত করে। এদের বলা হত “Blair’s Babes”। সমালোচনা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো—এই নারীরা সংসদে গিয়ে নারীর স্বাস্থ্য, পারিবারিক সহিংসতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, শিশুকেয়ার সুবিধা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর আইন প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তীতে এটি ব্রিটিশ সংসদে নারীবান্ধব সংস্কারের ভিত গড়ে দেয়। চিন্তা করুন, বাংলাদেশে এমন অসাধারণ কিছু যদি হয় তবে কেমন হবে?
যুক্তরাষ্ট্রেও একই চিত্র দেখা যায়। ২০১৮ সালের "Year of the Woman" নির্বাচনে ১০২ জন নারী প্রতিনিধি কংগ্রেসে নির্বাচিত হন। Alexandria Ocasio-Cortez, Ilhan Omar, Rashida Tlaib—এদের অনেকের নাম আমরা জানি। এরা শুধু রাজনৈতিক প্রতীক হননি, বরং শিক্ষাব্যবস্থা, অভিবাসন, পরিবেশনীতি, গর্ভপাত অধিকার, এবং লিঙ্গ-সমতা বিষয়ক সিদ্ধান্তে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন।
আমেরিকা কিংবা ব্রিটেন উন্নত গণতন্ত্রের দেশ—মানছি। হয়তো আমাদের দেশে এমন হওয়া পুরোপুরি সম্ভব নয়। তাই বলে কি আমরা স্বপ্ন দেখব না? অন্তত নারী সাংসদদের নির্বাচন নিয়ে কি জাতীয় ঐকমত্য করতে পারব না?
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে শুধু সংখ্যা নয়, নির্বাচন প্রক্রিয়াও গুরুত্বপূর্ণ। সংসদের ৫০ এর জায়গায় ১০০ নারী সদস্য হলে কি বা উপকার হবে? তবে যদি সরাসরি ভোটে ১০০ নির্বাচিত নারী সদস্য হয়, তবে এর মাধ্যমে নারীরা কেবল নারী হিসেবে নয়, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেও গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেট পান। আরেকবার ভাবুন, চিন্তা করে দেখুন—যদি সংসদে ১০০ জন সরাসরি নির্বাচিত নারী সাংসদ থাকতেন, তবে কি কেউ সাহস করতেন একজন নারীকে প্রকাশ্যে লাথি মেরে ভাইরাল হতে? তখন কি শাহবাগ থানার সামনে দাঁড়িয়ে একদল লোক নারী নির্যাতনকারীর গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরিয়ে নায়কের মতো বরণ করত? না, তখন তারা দ্বিতীয়বার ভাবত—কারণ জানত, সংসদে বসে আছেন এমন ১০০ নারী, যারা জবাব চাইবেন, প্রতিবাদ করবেন, নীতি প্রস্তাব করবেন এবং জনগণকে সাথে নিয়ে রাস্তায়ও নামবেন।
গণতন্ত্রে নারীর গলা উঁচু করে কথা বলার একমাত্র পথ—ভোট।নারী অধিকারের নামে মনোনয়নভিত্তিক অলঙ্কারিক প্রতিনিধিত্ব নারীকে ‘দুঃখিনী দেবী’ করে রাখে। এই দেবীর নাম আছে, পদ আছে, কিন্তু ক্ষমতা নেই। এর পরিবর্তন দরকার। বাংলাদেশের নারীরা রাজনীতি করতে জানেন, নেতৃত্ব দিতে পারেন, জনসম্পৃক্ত হতে পারেন—শুধু দরকার নির্বাচনের মঞ্চ।
নারীর স্বাধীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক ক্ষমতার কাঠামোতে নারীর সরাসরি অংশগ্রহণ। এবং একমাত্র পথ—খোলা নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে প্রবেশ। এইটাই সময়। নারীকে কোটায় নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে দিতে হবে।
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- ভবিষ্যতের গণতন্ত্র না পুরাতনের পুনরাবৃত্তি? ইউনুস-তারেক সাক্ষাৎ পর্যালোচনা
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক: সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ
- নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়িতে সেনা অভিযান:উদ্ধার ইয়াবা ও ধারালো অস্ত্র!
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- তারেক রহমানের দেশেফেরার সম্ভাব্য সময় জানালেনমির্জা ফখরুল
- তারেক-ইউনূস বৈঠক: উত্তপ্ত রাজনীতিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট?
- মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন কৌশল: চীন ও রাশিয়া কী করবে?
- উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?
- লন্ডনে তারেক-ইউনূসের বৈঠকের পরে পর পর ২টি স্ট্যাটাসে কি বললেন পিনাকী?
- ইসরায়েলে ইরানি মিসাইল, নিহত অন্তত ৭
- সাক্ষাৎ চাইলেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড. ইউনূস
- ডিএসইতে সাধারণ বীমা খাতের প্রান্তিক বিশ্লেষণ:মুনাফা বৃদ্ধির শীর্ষে কারা?