ভাষান্তর

শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—প্রথম পর্বের প্রথমাংশ 

ইতিহাস ও দর্শন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১১ ২১:৩৫:৪৮
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—প্রথম পর্বের প্রথমাংশ 

বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই লেখাটি তৈরি করেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। এটি লেখা হয় কমিউনিস্ট লীগ নামক একটি সংগঠনের কমিশনে।

এই ইশতেহারটি ছিল মার্কস ও এঙ্গেলসের প্রথম বড় প্রচেষ্টা, যেখানে তারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বা Historical Materialism ধারনাকে সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরেন। এর মূল বক্তব্য—"এখন পর্যন্ত বিদ্যমান সব সমাজের ইতিহাস হলো শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস।"

এখানে সমাজকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে কে উৎপাদনের উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রেণিগত সম্পর্কের মাধ্যমে।

১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।

এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। আজ আমরা শুরু করছি প্রথম পর্বের ভাবানুবাদ দিয়ে— পাঠকরা যাতে সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারেন।

প্রথম পর্ব: বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত

আজ পর্যন্ত মানবসভ্যতার ইতিহাস বলতে যা বোঝানো হয়—সেটি মূলত শ্রেণি-সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীন মানুষ ও দাস, অভিজাত প্যাট্রিসিয়ান ও সাধারণ প্লেবিয়ান (রোমান সমাজে অভিজাত বনাম সাধারণ), জমিদার ও ভূমিস্বামী, সামন্ত প্রভু ও সের্ফ (মধ্যযুগে কৃষক), কারিগর সমিতির গিল্ড-মাস্টার ও শিক্ষানবিশ—সংক্ষেপে বললে, শোষক এবং শোষিত—সবসময়ই একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এই সংঘাত কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে, কিন্তু কখনোই বন্ধ হয়নি। প্রতিবারই এর পরিণতি হয়েছে হয়তো একটি বিপ্লবী সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে, অথবা দুই পক্ষেরই ধ্বংসে।

ইতিহাসের প্রাচীন যুগগুলোতে সমাজকে আমরা নানা স্তরে বিভক্ত দেখতে পাই। যেমন, প্রাচীন রোমে ছিল—প্যাট্রিসিয়ান (উচ্চবিত্ত), নাইট (সামরিক অভিজাত), প্লেবিয়ান (সাধারণ জনতা), ও দাস। মধ্যযুগে ছিল—সামন্ত প্রভু, ভ্যাসাল (অধীনস্ত জমিদার), গিল্ড-মাস্টার (কারিগর সমিতির পূর্ণ সদস্য), শিক্ষানবিশ, এবং সের্ফ (ভূমিহীন কৃষক)।প্রায় প্রতিটি শ্রেণির মধ্যেই আবার নানা উপস্তর বা অবস্থান ছিল। এই শ্রেণিবিন্যাস সমাজকে এক ধরনের জটিল সামাজিক কাঠামোতে পরিণত করেছিল।

মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্র ভেঙে যে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ গড়ে উঠেছে, সেটা পুরনো শ্রেণি-সংঘাত দূর করতে পারেনি। বরং, সেটি নতুন শ্রেণি তৈরি করেছে, নতুন শোষণের ধরন প্রতিষ্ঠা করেছে, এবং পুরনো সংঘাতের জায়গায় নতুন সংঘাত সৃষ্টি করেছে। বুর্জোয়া বনাম প্রলেতারিয়েত শ্রেনী।

এখানে ‘বুর্জোয়া শ্রেণি’ বলতে বোঝানো হয়েছে—আধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণি, যারা উৎপাদনের উপায়ের মালিক এবং মজুরি দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করে। অন্যদিকে, ‘প্রলেতারিয়েত’ হচ্ছে সেই শ্রেণি, যাদের নিজেদের কোনো জমি, কারখানা বা উৎপাদন উপায় নেই। তারা জীবিকার তাগিদে তাদের একমাত্র সম্পদ—নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই দুই শ্রেণির সম্পর্ক শোষণ ও নির্ভরতার সম্পর্ক। একদিকে মালিক—যার হাতে পুঁজি; অন্যদিকে শ্রমিক—যার হাতে শুধু পরিশ্রম।

মার্কস ও এঙ্গেলস যখন ১৮৪৭ সালে এই বক্তব্য দিচ্ছেন, তখনও ইতিহাসের প্রাক-লিখিত বা প্রাক-সভ্যতাগত সমাজের গঠন নিয়ে আমাদের তেমন ধারণা ছিল না। পরবর্তীতে জানা যায়—রাশিয়ায়, জার্মানিতে এবং পৃথিবীর বহু অঞ্চলে এক সময় সমাজ ব্যবস্থা ছিল সামষ্টিক জমির মালিকানা ও গ্রামভিত্তিক সামাজিক সংগঠন। ভারত থেকে শুরু করে আয়ারল্যান্ড পর্যন্ত, একক পরিবারভিত্তিক সমাজ নয়, বরং গোষ্ঠীভিত্তিক বা গোত্রভিত্তিক সামাজিক কাঠামো বিদ্যমান ছিল। আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ লুইস হেনরি মরগ্যান তার গবেষণায় এসব প্রাথমিক সমাজের অভ্যন্তরীণ কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন—প্রথমদিকে সমাজ ছিল সাম্যবাদী ও যৌথ সম্পত্তি-ভিত্তিক। কিন্তু এই কাঠামো ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই সমাজ শ্রেণিভিত্তিক রূপ নিতে শুরু করে।

আমাদের যুগ—অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণির যুগ—এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সমাজের শ্রেণি-সংঘাতকে অনেকটা সহজ ও সরল করেছে। আগে যেখানে বহু ধরণের শ্রেণি, উপশ্রেণি, পেশা বা পদমর্যাদার ভিত্তিতে সমাজ ভাগ হতো, এখন সমাজটি মূলত দুইটি বিরোধী শিবিরে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে বুর্জোয়া শ্রেণি (অর্থাৎ পুঁজিপতি ও মালিক শ্রেণি), অন্যদিকে প্রলেতারিয়েত (অর্থাৎ মজুরি নির্ভর শ্রমজীবী শ্রেণি)।

মধ্যযুগে যারা ছিলেন সের্ফ বা সার্ফ (ভূমির সঙ্গে বাধা ভূমিহীন কৃষক), তাদের মধ্য থেকেই শহরের প্রথম নাগরিক শ্রেণি গড়ে ওঠে, যাদের বলা হতো চার্টার্ড বার্গার। এই বার্গার শ্রেণির ভিতর থেকেই ধীরে ধীরে গঠিত হয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রথম উপাদান।

আমেরিকা আবিষ্কার ও আফ্রিকা ঘুরে সামুদ্রিক পথ খোলার মাধ্যমে, বুর্জোয়াদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। চীন ও পূর্ব ভারতের বাজার, আমেরিকার উপনিবেশ, এবং এই উপনিবেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য—সব মিলিয়ে বাণিজ্য, জাহাজ চালনা এবং শিল্পের এক অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে, মধ্যযুগীয় ফিউডাল সমাজব্যবস্থার ভিত নড়ে ওঠে, এবং তার মধ্যে জন্ম নেয় এক বিপ্লবী পরিবর্তনের ধারা।

মধ্যযুগের গিল্ডভিত্তিক শিল্পব্যবস্থা—যেখানে পণ্য উৎপাদন ছিল গিল্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন—নতুন বাজারের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়। এর পরিবর্তে গড়ে ওঠে ম্যানুফ্যাকচারিং সিস্টেম, যেখানে গিল্ড-মাস্টারদের স্থান দখল করে নেয় নতুন শ্রেণির কারখানা মালিকরা। আগে গিল্ডগুলো একেকটা নির্দিষ্ট পেশাভিত্তিক হতো—কিন্তু এখন একেকটি কারখানার ভিতরেই বিভাজিত হয়েছে নানা রকম শ্রমের দায়িত্ব। শিল্পের চাহিদা বাড়তেই থাকে, ম্যানুফ্যাকচারিং-ও তা সামলাতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখনই বাষ্প শক্তি ও যন্ত্র শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব আনে।

ম্যানুফ্যাকচারিং-এর স্থান দখল করে নেয় আধুনিক বৃহৎ শিল্প ব্যবস্থা (Modern Industry), আর কারখানার মধ্যবিত্ত মালিকদের স্থান দখল করে নেয় শিল্পপতি কোটিপতিরা—যারা আজকের আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণির নেতৃত্ব দিচ্ছে।

এই আধুনিক শিল্পব্যবস্থা গড়ে তোলে বিশ্ববাজার—যার পথ তৈরি হয়েছিল আমেরিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই বিশ্ববাজার ব্যাপকভাবে বাণিজ্য, সমুদ্রযাত্রা, এবং স্থলভাগে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে বিকাশ ঘটায়। পরবর্তী ধাপে শিল্প, বাণিজ্য, জাহাজ, রেলপথের যে বিস্তার ঘটে—তা সরাসরি বুর্জোয়া শ্রেণির উন্নতি, পুঁজি সঞ্চয় এবং মধ্যযুগের অন্যান্য শ্রেণিকে পেছনে ফেলে দেওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিটি অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতারও বিস্তার। শুরুর দিকে তারা ছিল সামন্ত রাজাদের শাসনে নিপীড়িত শ্রেণি।পরে তারা গড়ে তোলে সশস্ত্র ও স্বশাসিত শহর সমাজ (যাকে মধ্যযুগে ফ্রান্স ও ইতালিতে বলা হতো “কম্যুন”)। ইতালিতে ও জার্মানিতে এরা স্বাধীন নগর প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।ফ্রান্সে তারা ছিল রাজতন্ত্রের অধীন “তৃতীয় শ্রেণি”, যারা কর প্রদান করত কিন্তু পূর্ণ অধিকার পেত না। পরে ম্যানুফ্যাকচারিং যুগে তারা হয় সামন্ত বা একনায়ক রাজতন্ত্রের সঙ্গে একধরনের সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি, আবার কোথাও কোথাও রাজতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি হয়ে ওঠে।

সবশেষে, আধুনিক শিল্প ও বিশ্ববাজারের বিকাশের মাধ্যমে, বুর্জোয়া শ্রেণি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে। এই রাষ্ট্র মূলত একটি কমিটি, যা পুরো বুর্জোয়া শ্রেণির সাধারণ স্বার্থগুলো পরিচালনা করে।

ইতিহাসে বুর্জোয়া শ্রেণি একটি চরম বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে। যেখানেই তারা ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই তারা ফিউডাল, পিতৃতান্ত্রিক, এবং কল্পিত আদর্শে গড়া সামাজিক সম্পর্কগুলিকে ভেঙে দিয়েছে। মানুষের সঙ্গে তার “প্রাকৃতিক উচ্চতর শ্রেণির” সম্পর্ক—যেমন রাজা, ধর্মগুরু, জমিদার ইত্যাদি—সেগুলো ছিঁড়ে ফেলে, তারা সম্পর্ককে এনে দাঁড় করিয়েছে একমাত্র স্বার্থনির্ভর আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে। ধর্মীয় আবেগ, মানবিক সম্পর্ক, পারিবারিক মূল্যবোধ—সব কিছুই তারা “ক্যাশ পেমেন্ট”-এ নামিয়ে এনেছে।

বুর্জোয়া শ্রেণি ধর্মীয় উন্মাদনা, বীরত্বপূর্ণ আবেগ, এবং ছোটবুর্জোয়া ভাবাবেগের মহত্ত্বকে ডুবিয়ে দিয়েছে স্বার্থকেন্দ্রিক হিসেব-নিকেশের বরফশীতল জলে। ব্যক্তিত্ব বা চরিত্রের মূল্যকে তারা নামিয়ে এনেছে শুধু বিনিময়মূল্যে, আর অসংখ্য ঐতিহাসিক অধিকার ও স্বাধীনতার পরিবর্তে দাঁড় করিয়েছে একটিমাত্র, নীতিহীন ‘স্বাধীনতা’—মুক্ত বাণিজ্য (Free Trade)। এক কথায়, আগে যেখানে ধর্ম বা রাজনীতির ছায়ায় শোষণ আড়াল হয়ে থাকত, এখন সেখানে এসেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সরাসরি ও নির্মম শোষণ।

বুর্জোয়া শ্রেণি সমাজে আগে যেসব পেশাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো, যেগুলোর ছিল এক ধরণের ‘পবিত্রতা’—সেইসব পেশার মহিমা তারা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। চিকিৎসক, আইনজীবী, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী—সবাইকে তারা পরিণত করেছে মজুরি-নির্ভর শ্রমিকে, অর্থাৎ একেকজন পেশাদার কর্মচারী, যাদের শ্রমও কেনাবেচার পণ্য।

বুর্জোয়া শ্রেণি পরিবারকেও অর্থনৈতিক লেনদেনের কাঠামোতে রূপান্তর করেছে।সংবেদনশীলতা, ভালোবাসা ও পারস্পরিক নির্ভরতার পরিবর্তে তারা তৈরি করেছে টাকার সম্পর্ক, যেখানে আবেগের জায়গায় এসেছে হিসেবের খাতা। যে মধ্যযুগীয় বলিষ্ঠতা ও পুরুষত্বের বহিঃপ্রকাশকে প্রতিক্রিয়াশীলরা আজও প্রশংসা করে, বুর্জোয়ারা দেখিয়েছে যে সেই বাহ্যিক বলের পেছনে ছিল অলসতা ও নিষ্ক্রিয়তা। এর বিপরীতে, আধুনিক মানুষ কী করতে পারে—তা প্রথম দেখিয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণি। তারা এমন সব কীর্তি অর্জন করেছে যা মিশরের পিরামিড, রোমান অ্যাকুয়াডাক্ট কিংবা গথিক ক্যাথেড্রালেরও অতীত। তারা পরিচালনা করেছে এমনসব অভিযান, যা পেছনে ফেলেছে জাতিগোষ্ঠীর স্থানান্তর কিংবা ধর্মযুদ্ধের ইতিহাসকেও।

বুর্জোয়া শ্রেণি টিকে থাকতে পারে শুধুমাত্র তখনই, যখন তারা উৎপাদনের উপায়ে ধারাবাহিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এ পরিবর্তনের মাধ্যমে পাল্টে যায় উৎপাদন সম্পর্ক, এবং তার সঙ্গে সমগ্র সামাজিক সম্পর্ক। পুরনো সমাজব্যবস্থাগুলো টিকে থাকত তাদের নিজস্ব উৎপাদন পদ্ধতির অপরিবর্তিত রূপ ধরে রেখে। কিন্তু বুর্জোয়া যুগে প্রতিনিয়ত ঘটে চলে সামাজিক সম্পর্কের ভাঙচুর, দোলাচল, অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনা। যেসব সম্পর্ক এক সময় ছিল দৃঢ় ও অনড়, সেগুলো ভেঙে পড়ে; নতুন সম্পর্কগুলো স্থায়ী হওয়ার আগেই হয়ে যায় পুরোনো। সবকিছু যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়, আর যা কিছু পবিত্র ছিল, তা অপবিত্র হয়ে পড়ে। মানুষ এখন বাধ্য—নিজ জীবনের প্রকৃত বাস্তবতা ও অন্য মানুষের সঙ্গে সম্পর্ককে নির্মম বস্তুনিষ্ঠ চোখে দেখতে।

নিজস্ব উৎপাদনের বাজার সম্প্রসারণের চাহিদা বুর্জোয়াদের পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা প্রতিটি দেশে ঘাঁটি গেঁড়েছে, বসতি স্থাপন করেছে, সংযোগ গড়ে তুলেছে।বিশ্ববাজারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি প্রতিটি জাতির উৎপাদন ও ভোগকে আন্তর্জাতিক চরিত্র দিয়েছে। এর ফলে, যেসব শিল্প একসময় জাতীয় গর্ব ছিল, সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে বা প্রতিদিন ধ্বংস হচ্ছে। তাদের জায়গা নিয়েছে এমন শিল্প, যেগুলো দূরবর্তী অঞ্চল থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে, এবং পণ্য সরবরাহ করে বিশ্বের প্রতিটি কোণে।

আগে দেশের নিজের চাহিদা পূরণ করত দেশের উৎপাদন, কিন্তু এখন সেই জায়গায় এসেছে নতুন চাহিদা, যেগুলো পূরণ করতে হয় বিদেশি পণ্যের মাধ্যমে। যেখানে আগে ছিল স্থানীয় ও জাতীয় বিচ্ছিন্নতা ও আত্মনির্ভরতা, এখন সেখানে গড়ে উঠেছে বহুমুখী আন্তঃনির্ভরতা, বিশ্বব্যাপী সংযোগ।

শুধু বস্তুগত উৎপাদনই নয়—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও জাতীয় সংকীর্ণতা আর সম্ভব নয়।একেকটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃষ্টিগুলো এখন সারাবিশ্বের সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে স্থানীয় ও জাতীয় সাহিত্যের ভিতর থেকে গড়ে উঠছে একটি নতুন বিশ্বসাহিত্য।

উৎপাদনের প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং যোগাযোগব্যবস্থার বিস্ময়কর প্রসারের মাধ্যমে, বুর্জোয়া শ্রেণি এমনকি সবচেয়ে বর্বর জাতিগুলোকেও টেনে এনেছে সভ্যতার কাতারে। পণ্যের কম দাম তাদের প্রধান অস্ত্র—যার মাধ্যমে তারা ভেঙে ফেলেছে “চীনের প্রাচীরের” মতো প্রতিরোধ, আর বিদেশি বিদ্বেষকেও করেছে পরাস্ত।

বুর্জোয়ারা প্রতিটি জাতিকে বাধ্য করেছে—বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। ‘সভ্যতা’ নাম দিয়ে, তারা প্রতিটি সমাজকে নিজের মতো করে রূপান্তর করেছে। এক কথায়, বুর্জোয়া শ্রেণি গোটা দুনিয়াকে গড়ে তুলছে তাদের নিজের প্রতিচ্ছবিতে। এঙ্গেলস তার বিখ্যাত বই The Origin of the Family, Private Property, and the State (১৮৮৬)-এ এই সমাজ ভাঙনের বিশ্লেষণ করেন এবং দেখান, কীভাবে ব্যক্তিমালিকানা, পরিবার, রাষ্ট্র ও শ্রেণিভেদ গঠিত হয়েছে।

চলবে... প্রথম পর্বের বাকি অংশ পাবেন আগামীকাল।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত