মতামত
মতবিরোধ মানেই নিষিদ্ধের দাবি কি ঠিক?

আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক

সম্প্রতিছাত্র ইউনিয়ন সংবাদ সম্মেলন করে "সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি" করেছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই ধরনের দাবি অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক। আমি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সমালোচনার পক্ষে—একই রকমভাবে আমি মনে করি, রাজনীতি করার পূর্ণ অধিকার তাদের আছে।
এই বিষয়ে সন্দেহ নেই, ছাত্রশিবির ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসগুলোতে সনামে ও বেনামে (ইনকিলাব মঞ্চ, শাহবাগবিরোধী ঐক্য, স্টুডেন্টস ফর সোভরেইনটি) নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ইতোমধ্যে তারা সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও নেবে। যখন যেটা সুবিধা, তারা সেটাই দিয়ে রাজনীতি করেছে। যেমন, পাঠ্যপুস্তকে ‘আদিবাসী’ শব্দসংবলিত গ্রাফিতি নিয়ে বিতর্কের ঘটনায় তারা ঢাকা শহরে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা করেছে। আবার শাহবাগবিরোধী ঐক্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থিদের উপর হামলা করেছে। অন্যদিকে ইনকিলাব মঞ্চ তো জুলাই চেতনার নামে সেই ৫ আগস্টের পর থেকেই মব তৈরি করে যাচ্ছে। তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি ভাঙা। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবির ‘সাধারণ ছাত্র’ নামের ব্যানারে নানা ভাবে প্রশাসনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে; এমনকি এই নামে তারা ভিসি অপসারণের নেতৃত্ব দিয়েছে।
তবে এসবের পরেও প্রশ্ন থাকে—এই কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ কি রাজনৈতিক নিষিদ্ধতাই হওয়া উচিত? আমি মনে করি না। কারণ, নিষিদ্ধকরণ রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে না, বরং তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠিয়ে আরও সহিংস ও গোপন করে তোলে। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক সংগঠনকে নিষিদ্ধ করলে তা ‘মার্টিরডম ন্যারেটিভ’ (শহীদত্বের কাহিনি) তৈরি করে। যেটি পরবর্তীতে আরও চরমপন্থা জন্ম দেয়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যখন সহনশীলতার বাইরে চলে যায়, তখন তা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে।
শিবিরকে যেমন প্রকাশ্যে রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করা উচিত, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের রাজনৈতিক নিষিদ্ধতা চাইতে হবে। নিষিদ্ধের রাজনীতি কাজ করে না। রাজনৈতিক শক্তিকে রাজনীতি দিয়েই উত্তর করতে হয়। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে উদার রাজনীতি দিয়েই উত্তর করতে হয়।
হ্যাঁ, সেখানে যদি এক পক্ষ সহিংসতার আশ্রয় নেয়, তবে কী হবে—এই প্রশ্ন আসতেই পারে। এক পক্ষ যদি সহিংসতার আশ্রয় নেয়, তার পরও জবাব হতে হবে সু-রাজনীতির। কেননা দিন শেষে মনে রাখতে হবে—ক্যাম্পাসগুলোতে যারা আধিপত্য বিস্তারের নামে নিজ দলের মতাদর্শ ও ধর্মীয় এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে চায়, তাদের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঠিক সময়মতো প্রত্যাখ্যান করে। ঠিক যেমন ছাত্রলীগকে করেছে (আমি ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে, তবে তাদের দোষী সদস্যদের বিচারের পক্ষে—এবং এই বিচার হওয়া জরুরি, যেন ভবিষ্যতে কোনো ছাত্র সংগঠন তাদের মূল দলের হয়ে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না পারে)।আমরা যদি বিশ্বাস করি ভিন্নমতের অধিকার গণতন্ত্রের একটি শর্ত, তাহলে এই নিষিদ্ধকরণ বা বিতাড়নের রাজনীতি গণতন্ত্রবিরোধী হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র কোনো দলের বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়।দেখুন, বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো—সব ছাত্র সংগঠনই ক্ষমতার রাজনীতি করতে চায়। তা সে ধর্মের নামেই হোক কিংবা জাতীয়তাবাদের নামেই হোক—ছাত্রলীগ, শিবির, ছাত্রদল কিংবা বামপন্থিরা—সবারই দিন শেষে লক্ষ্য হলো ক্ষমতার রাজনীতি।
বাংলাদেশের সমাজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে ঢোকার একটি কার্যকর পথ হলো ছাত্ররাজনীতি। যারা এতে যুক্ত হন, তারা এখান থেকে একটি বড় সোশ্যাল ক্যাপিটাল নিয়ে বের হন—যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও বামপন্থিরা নিজেদের রাষ্ট্রীয় কাজে লোক দরকার হলে, ছাত্ররাজনীতি করা এসব সোশ্যাল ক্যাপিটালধারী লোকদের মেধা বা জ্ঞানের তোয়াক্কা না করেই আনুগত্যের ভিত্তিতে কাজে নিয়োগ দেয়, ক্ষমতার ভাগীদার করে তোলে। এ এক দুষ্টচক্র। এর থেকে বের হওয়া বাংলাদেশে আদৌ সম্ভব কি না জানি না। তবে এত কিছুর পরও এই সমস্যার সমাধান এ নয় যে, যে দলটি আপনার পছন্দ নয়, তাকে আপনি নিষিদ্ধ করে দেবেন। কারণ, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করে বাস্তব লাভ হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—ছাত্র ইউনিয়নের দাবিকে নিয়ে এত বড় আলোচনা কেন? এদের তো ক্ষমতা নেই ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করার। বিষয়টি শুধু ছাত্র ইউনিয়নের দাবি নয়, এর একটি সামগ্রিক দিক রয়েছে—তা হলো ক্যানসেল কালচার। আমার বন্ধু তালিকায় ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, ছাত্রলীগ ও বামপন্থিদের অনেকেই আছে। মাঝেমধ্যে দেখি, তারা একে অপরকে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। যেমন সেদিন এক পরিচিতকে দেখলাম, যিনি ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন নির্যাতিত হয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে—তিনি একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন: “বাংলাদেশে শাহবাগিদের ঠাঁই নাই।”খুব ইচ্ছা হয়েছিল জিজ্ঞেস করি, তাহলে আপনার কথা মতন এই শাহবাগিরা কোথায় যাবে? (আমার মনে করি যে ‘শাহবাগি’ বা ‘শাপলাবাগি’ বলে কোনো স্পষ্ট ক্যাটাগরি নেই, তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—এই যে একজন আরেকজনকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে, দেশ থেকে বের করে দিতে চাইছে—এর শেষ কোথায়?)
অনেকেই বলে থাকেন, জুলাই আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির ফলাফল। আমি দ্বিমত করি। জুলাই আন্দোলন ছাত্র রাজনীতির ফল নয়, এটি বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনৈতিক সচেতনতার ফল। রাজনৈতিকভাবে সচেতন হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাস্তায় নেমেছিল বলেই জুলাই আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনের পরে তারা আবার নিজেদের কাজে ফিরে গেছে। এখন তারা অদৃশ্য, নিজের কাজে ব্যস্ত। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তারা আছে। তারা আবার আসবে—যখন দেশের দরকার হবে। তাহলে এখন ছাত্ররাজনীতি করছে কারা? তারা করছে, যারা ঐ যে বললাম, ক্ষমতার ভাগ চায়। ক্ষমতা ও অর্থের দুষ্টচক্রে নিজেদের জায়গা চায়—আর তা বৈধতা দিতে কেউ ব্যবহার করছে ধর্ম, কেউ মার্ক্স, আবার কেউ জাতীয়তাবাদ। আবার তারাই একে অপরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে চায়।
আমাদের এই ধ্বংসকামী দাবিগুলোর বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার থাকতে হবে।আমরা যেমন বুঝে নিচ্ছি, আপনারা ছাত্ররাজনীতির নামে মূলত এই ক্ষমতা ও অর্থকেন্দ্রিক দুষ্টচক্রে আপনাদের অংশীদারিত্ব চাচ্ছেন, তেমনি আপনাদেরও বুঝতে হবে—একটা সীমা আছে। সেই সীমা হলো—কেউ কাউকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না, নিষিদ্ধ করতে পারবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিলান সোভেল বলেছিলেন, "When identity politics is used for exclusion, it undermines democracy itself." আমাদের এখন দরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক ছাত্র রাজনীতি—যেখানে মতভেদ থাকবে, কিন্তু সহাবস্থান ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি থাকবে।
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে চার্জ দাখিল, বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার
- বাহরাইনেরমানামায় বিএনপির সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নেতৃত্বে আক্তার হোসেন
- বাহরাইনে জাতীয়তাবাদী শক্তির পুনর্জাগরণ: গ্যালালী শাখায় নতুন নেতৃত্ব
- চীন না ভারত? উন্নয়ন না আনুগত্য? বুলেট ট্রেন বলছে স্পষ্ট জবাব
- অবশেষে বিসিবি সভাপতি ফারুককে নিয়ে মুখ খুললেন আসিফ
- বিশ্বশক্তির নজর এখন বাংলাদেশে: খনিজ ভাণ্ডারের নতুন মানচিত্র
- তারেক-ইউনুস উত্তপ্ত ফোনালাপ: যা জানা গেল
- নতুন বিসিবি সভাপতিবুলবুলের কাছে আশরাফুলের চাওয়া
- ঈদের দিন বৃষ্টি হবে কি?
- ভারতের গর্ব এস-৪০০ ধ্বংস: বাস্তবতা নাকি প্রচারযুদ্ধ?
- ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় হঠাৎ বিরতি: যুক্তরাষ্ট্র কি নতুন কৌশল নিচ্ছে?
- ২০২৬ সালের এপ্রিলেই জাতীয় নির্বাচন: জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা
- নির্বাচনের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া: বিএনপি অসন্তুষ্ট, জামায়াত সন্তুষ্ট, এনসিপি শর্তসাপেক্ষে সমর্থন
- স্বাস্থ্য কূটনীতিতে নীরব বিপ্লব:ভারতীয় ভিসা বন্ধ ও চীনের উষ্ণ অভ্যার্থনা
- কোন কারনে চুল ঝরে জানেন কি?