চীনের প্রথম সম্রাটের সমাধি: রহস্য ঘেরা যে কবর খুলতে আজও ভয়ে কাঁপে বিজ্ঞানীরা!

মোঃ আশিকুজ্জামান

২,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চীনের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াং-এর সমাধি আজও এক অমীমাংসিত রহস্যের আড়ালে ঢাকা। বিশাল এক মাটির ঢিবির নিচে, বিখ্যাত টেরাকোটা আর্মির ঠিক পাশেই লুকিয়ে আছে এই সুবিশাল ভূগর্ভস্থ সাম্রাজ্য। প্রচলিত আছে, এর ভেতরে এমন সব ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে, যা মানবজাতির জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে এসেও বিজ্ঞানীরা এর দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। ঠিক কী কারণে এই প্রাচীন সমাধির অন্ধকার এত ভয়ংকর, তা নিয়েই এই বিশেষ প্রতিবেদন।
এক অদম্য সম্রাট এবং তার অমরত্বের ভয়:
খ্রিষ্টপূর্ব ২৫৯ সালে জন্ম নেওয়া ইয়েং ঝেং, যিনি পরে ছিন শি হুয়াং নামে পরিচিত হন, মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। প্রায় ১০ বছরের সামরিক অভিযানে তিনি চীনের ছয়টি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যকে পরাজিত করে খ্রিষ্টপূর্ব ২২৬ সালে সমগ্র চীনকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসেন। তিনিই ছিলেন চীনের প্রথম সম্রাট, যিনি একক লিপি, একক মুদ্রা এবং একক পরিমাপের প্রবর্তন করেন। তার সময়েই চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
কিন্তু এই পরাক্রমশালী সম্রাটের ভেতরে লুকিয়েছিল মৃত্যুর এক গভীর ভয়। অমরত্বের নেশায় তিনি ঋষি, চিকিৎসক এবং রসায়নবিদদের দূরদূরান্তে পাঠাতেন অমৃতের সন্ধানে। এমনকি চিরজীবী হওয়ার আশায় পারদের মতো বিষাক্ত পদার্থও তিনি পান করতেন। মৃত্যুকে পরাজিত করতে না পেরে, তিনি মৃত্যুর পরেও যেন রাজত্ব করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে শুরু করেন এক বিশাল ভূগর্ভস্থ সাম্রাজ্য নির্মাণের পরিকল্পনা।
ভূগর্ভস্থ সাম্রাজ্যের নির্মাণ ও তার প্রতিরক্ষা:
সম্রাট ছিন শি হুয়াং শুধু একটি সাধারণ কবর চাননি, তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও তার নিজস্ব একটি সাম্রাজ্য থাকবে। প্রায় ৭ লাখ শ্রমিক, সৈন্য, কারিগর এবং বন্দীদের নিয়ে প্রায় ৪০ বছর ধরে চলেছিল এই বিশাল নির্মাণযজ্ঞ। লি পর্বতের কাছে এই সমাধির স্থান বেছে নেওয়া হয়েছিল শুভ প্রতীক এবং মূল্যবান ধাতু পাওয়ার আশায়।
রাজধানী শিয়াং ইয়াং শহরের আদলে তৈরি এই ভূগর্ভস্থ শহরে ছিল প্রাসাদ, শহরের দেওয়াল, টাওয়ার, কোর্টইয়ার্ড, বাগান, প্রশাসনিক ভবন এবং রাজকীয় ঘোড়ার আস্তাবল। মনে করা হতো, সম্রাট মৃত্যুর পরেও এখান থেকেই শাসনকার্য চালাবেন। মূল সমাধির পূর্ব দিকে স্থাপন করা হয়েছিল তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, কারণ পূর্ব দিকেই ছিল তার পরাজিত ছয়টি শত্রু রাজ্য।
টেরাকোটা আর্মি: মাটির সৈনিকদের বিস্ময়কর বাহিনী:
১৯৭৪ সালে চীনের শিয়ান শহরের কাছে কিছু কৃষক কুয়ো খুঁড়তে গিয়ে ঘটনাক্রমে মাটির নিচে কিছু ভাঙা মূর্তি খুঁজে পান। এরপর শুরু হওয়া খনন কাজে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে হাজার হাজার মাটির তৈরি সৈনিক, যারা আজ 'টেরাকোটা আর্মি' নামে পরিচিত। এখনো পর্যন্ত ৮,০০০-এর বেশি যোদ্ধা আবিষ্কৃত হয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোনো দুটি সৈনিকের চেহারা একরকম নয়; প্রতিটি মূর্তির মুখের অভিব্যক্তি, গোঁফ, চুল এবং পোশাক আলাদা। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এগুলো আসল সৈন্যদের আদলেই তৈরি করা হয়েছিল। শুধু সৈনিক নয়, ব্রোঞ্জের রথ, ঘোড়া, জেনারেল, অশ্বারোহী, ধনুকধারী, নর্তক, অ্যাক্রোব্যাট, সঙ্গীতশিল্পী, রাজকীয় কর্মচারীদের প্রতিরূপও এখানে পাওয়া গেছে, যেন সম্রাট মৃত্যুর পরেও তার রাজকীয় জীবন উপভোগ করতে পারেন।
কেন মূল সমাধি আজও খোলা হয়নি?
টেরাকোটা আর্মি আবিষ্কৃত হলেও, মূল পিরামিড আকৃতির সমাধি কক্ষটি আজও অক্ষত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা, প্রত্নতত্ত্ববিদরা বা সরকার কেউই সেই মূল সমাধি খুলতে সাহস করেননি। এর প্রধান দুটি কারণ হলো:
১. পারদের ভয়াবহ উপস্থিতি: বিখ্যাত চীনা ঐতিহাসিক সিমা কিয়ান, যিনি সম্রাটের মৃত্যুর ১০০ বছর পর জন্মেছিলেন, তার লেখায় উল্লেখ করেছেন যে সমাধির ভেতরে নদী ও সমুদ্রের মতো তরল পারদ দিয়ে পূর্ণ ছিল। ২০০৯ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা সমাধির চারপাশের মাটির রাসায়নিক পরীক্ষা করে স্বাভাবিকের চেয়ে শত গুণ বেশি পারদের উপস্থিতি খুঁজে পান, যা মারাত্মক বিষাক্ত। যদি এই পারদের বাষ্প আজও ভেতরে আটকে থাকে, তবে সমাধি খুললেই তা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। সামান্য পরিমাণ পারদবাষ্পও প্রাণঘাতী হতে পারে।
২. প্রাচীন ফাঁদের ভয়: সিমা কিয়ানের লেখায় আরও উল্লেখ আছে, সমাধিটি ভয়াবহ সব ফাঁদ দিয়ে সুরক্ষিত, যেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তীর ছোঁড়ার ব্যবস্থা রয়েছে, যা অনুপ্রবেশকারীর জন্য নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ২০০০ বছর পরেও এই ফাঁদগুলো সক্রিয় থাকতে পারে এবং ভুল করে যদি কেউ তা সক্রিয় করে ফেলে, তবে তার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।
ভবিষ্যতের ভাবনা:
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা রাডার স্ক্যান, রোবট প্রোবের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাইরে থেকেই সমাধির ভেতরের মানচিত্র তৈরি করছেন। এটি শুধুমাত্র ধনসম্পদের বিষয় নয়, এখানে লুকিয়ে আছে চীনের ইতিহাস, বিশ্বাস এবং সম্রাটের অমরত্বের স্বপ্ন। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, হয়তো ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আরও উন্নত হলে একদিন এটি খোলা সম্ভব হবে। আবার অনেকে মনে করেন, ভেতরের জিনিসগুলো অত্যন্ত নাজুক (যেমন, টেরাকোটা আর্মির গায়ের রঙ বাতাসের সংস্পর্শে আসতেই ধূসর হয়ে গিয়েছিল)। তাই এটিকে অক্ষত রাখাই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ।
এই বিস্ময়কর সমাধি মানবজাতির জন্য এক বিরাট রহস্য হয়েই রয়ে গেছে, যা হয়তো আরও বহু বছর ধরে আমাদের কৌতুহল জাগিয়ে রাখবে।
জামায়াতে ইসলামী: অতীতের ছায়া ছাপিয়ে কি নতুন শুরু সম্ভব?
লাহোর প্রস্তাব, পাকিস্তান আন্দোলন, ভারত ভাগ, তারপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত উপমহাদেশের মুসলিম রাজনীতির এক জটিল অধ্যায়ের নাম জামায়াতে ইসলামী। দলটি কখনো পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠোর বিরোধী, কখনো সেই পাকিস্তানেরই শরিক, আবার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ভেতরেও নিষেধাজ্ঞা, পুনরুত্থান, জোট রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার, সাম্প্রতিক নিষিদ্ধ ঘোষণা, সব মিলিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে প্রশ্নের শেষ নেই। আজকের আলোচনায় তাই গোড়া থেকে বর্তমান পর্যন্ত জামায়াতের রাজনৈতিক চিন্তা, কৌশল, অর্জন, ব্যর্থতা এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ অনুসন্ধান।
লাহোর প্রস্তাব, রাষ্ট্রধারণার জন্ম এবং পাকিস্তান আন্দোলনের ভূমিকা
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে রাষ্ট্র গঠনের একটি প্রস্তাব পেশ করলেন। তার সেই প্রস্তাবকে হিন্দু বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত পত্রপত্রিকাগুলো প্রচার করতে লাগল পাকিস্তান প্রস্তাব হিসেবে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে কোথাও পাকিস্তান নামটির উল্লেখ ছিল না। এমনকি মুসলিম লীগের মুখপাত্রদেরও এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না।
হিন্দু মহলের ধারাবাহিক প্রচারণার ফলেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের মাঝে রাষ্ট্রধারণার স্পষ্ট বোধ তৈরি হতে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪১ সালের ১৫ই এপ্রিল মাদ্রাজ অধিবেশনে তথাকথিত পাকিস্তান প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের শাসনতন্ত্রে মূল নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে পাকিস্তান আন্দোলন। অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনও প্রবল হয়ে উঠছিল। ইতিহাসের এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে মুসলিম রাজনীতির আরেকটি নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে, যেখান থেকে পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী আত্মপ্রকাশ করে।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, মুসলিম লীগ এবং মতাদর্শিক বিভক্তি
যখন পাকিস্তান আন্দোলন জোরালো হচ্ছিল, সেই সময় উপমহাদেশে মুসলিমদের বড় দুটো রাজনৈতিক শিবির ছিল মুসলিম লীগ ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। পাকিস্তান প্রশ্নে এই দুই পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট মতানৈক্য দেখা দেয়। মুসলিম লীগ ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে, আর জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিল ভারতের অখণ্ডতার পক্ষে।
জমিয়তের চিন্তা ছিল, ইতিপূর্বেই ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে, ভবিষ্যতের অখণ্ড ভারতেও মুসলিমরাই শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে। তাদের কাছে ভূখণ্ড অখণ্ড রাখা এবং তার ভেতরেই মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ছিল বেশি যৌক্তিক। কিন্তু মুসলিম লীগের চোখে রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল ভিন্ন, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের ভিত্তিতে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে মুসলিম নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নের পথ খুঁজছিল।
তৎকালীন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মুখপত্র ছিল ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকা, যেই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী। জমিয়তের সাথে মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে তিনি ধীরে ধীরে সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে সরে যান এবং পৃথক রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠা লাভ করে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।
জামায়াতে ইসলামী হিন্দের জন্ম ও পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ৭৫ জন সদস্যের উপস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী ঘোষণার পর মওদুদী জামাতের আমির হিসেবে মনোনীত হন। সেখান থেকেই শুরু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ও আদর্শিক যাত্রা।
সে সময় থেকেই তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধিতা করতে থাকেন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে দাবি করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করা মুসলিম লীগ, জিন্না, এরা কেউই খাঁটি মুসলিম নন। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও পক্ষে ছিল না। প্রশ্ন জাগে, তাহলে জামাত তথা মওদুদীর উদ্দেশ্য কী ছিল?
মওদুদী সম্পর্কে একটি বিষয় আগে জানা দরকার। যৌবনে ভারতের মার্ক্সবাদী নেতা আব্দুস সাত্তার খায়রীর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন তিনি, আবার ছিলেন সিদ্ধহস্ত লেখক। মুসলিম সমাজের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে তার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মাসিক ‘তরজমানুল কোরআন’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তিনি নিজের মতবাদ প্রচার শুরু করেন। এই পত্রিকার ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওদুদী পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে লেখেন, পাকিস্তান নামক কোন রাষ্ট্রের জন্ম হলে সেটা আহাম্মুকের বেহেশত এবং মুসলমানদের কাফেরানা রাষ্ট্র হবে।
এই ধরনের লেখালেখি ও প্রচারণার ফলে মুসলিম লীগ সমর্থকরা জামাতকে ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের দালাল বলে মনে করতে শুরু করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কঠোর বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, এবং পরিহাসের বিষয় হচ্ছে সেই পাকিস্তানেরই মাটিতে গিয়ে ঠাঁই নিতে হয় পাকিস্তানবিরোধী জামায়াতে ইসলামী হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীকে।
পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী: গ্রেপ্তার, দাঙ্গা ও মৃত্যুদণ্ডাদেশ
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর জামায়াতে ইসলামী হিন্দ ও জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সংগঠনটি। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের আমির হন মওলানা মওদুদী, আর জামায়াতে ইসলামী হিন্দের আমির হন আবুল লাইস ইসলাহী নাদভী।
পাকিস্তানে গিয়ে মওদুদী ইসলামী সংবিধান ও ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য জোরালো প্রচারণা শুরু করেন। এই কারণে পাকিস্তান সরকার জননিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করে। একই বছরে পাকিস্তানি জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তান শাখা খোলে। এরই মধ্যে জামায়াতের সাংগঠনিক তৎপরতায় সংগঠনটির শক্তি ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৯৫০ সালে মওদুদীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৫৩ সালে পাকিস্তানে কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করে আইন পাশ করার দাবিতে আবারো আন্দোলন শুরু করে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান। মওদুদী পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং পাকিস্তান সরকারকে আহমদীয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণা দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। সে সময় জামায়াতের কিছু সমর্থক লাহোরে আহমদীদের উপর হামলা চালায়, এর জের ধরে শুরু হয় দাঙ্গা। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে দাঙ্গা দমে গেলেও, এই সহিংসতায় প্রায় দুই হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। ভারত–পাকিস্তান বিভাজনের পর কোনও একক দাঙ্গায় এত মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা এটি প্রথম।
ঘটনার পর মওলানা মওদুদীকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রেফতার করে। বিচারে তাকে দাঙ্গার মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মুসলিম দেশের মধ্যস্থতায় তার মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করা হয়। ১৯৫৫ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯৫৬ সালে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র শাখা ‘ছাত্র সংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা এখন ইসলামী ছাত্রশিবির নামে পরিচিত।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ: স্বাধীনতা যুদ্ধ, বিরোধিতা ও নিষেধাজ্ঞা
জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সম্পর্ক এক জটিল ও বিতর্কিত অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী জামাত ১৯৭১ এ এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়। অনেকের বিশ্লেষণে ধরা হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতার যে ঐতিহাসিক ভুল তারা মনে করেছিল, তার কাফফারা দিতেই একাত্তরে জামায়াত শুধু বাংলাদেশের বিরোধিতাই করেনি, বরং স্বাধীনতা আন্দোলন রুখে দিতে শান্তি কমিটি গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে।
জামায়াতের প্রেসক্রিপশন অনুসারেই তাদের ছাত্র উইং ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই রাজাকার, আল বদর ও আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জামায়াত নানা কার্যক্রম পরিচালিত করে, যার ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে গোলাম আজম লন্ডনে গিয়ে পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করেন।
কিন্তু পাকিস্তানের বিরোধিতার মতো বাংলাদেশের বিরোধিতাও শেষ পর্যন্ত অকার্যকর প্রমাণিত হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় যখন সুনিশ্চিত, তখন জামায়াত নেতারা পালিয়ে যান সেই পাকিস্তানেই, যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা তারা একসময় করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জামাতসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সকল দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের বিরোধিতা ও গণহত্যায় সহায়তার জন্য ১৯৭৩ সালে যে ৩৮ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়, তার অন্যতম ছিলেন গোলাম আজম। তবু প্রহসনের মতো কিছুদিন পরই গোলাম আজমকেও মওদুদীর মতো সেই রাষ্ট্রেই ফিরতে হয়, যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি এবং তার দল কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের পুনরুত্থান, জোটরাজনীতি ও যুদ্ধাপরাধের বিচার
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জামায়াতের সামনে নতুন সুযোগ তৈরি হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করেন, যা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ করেছিল। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে জামাত সমমনোভাবাপন্ন ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আইডিএল) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে। আইডিএলের ছায়ায় জামাতের নেতা–কর্মীরা রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
জিয়াউর রহমানের বহুদলীয় গণতন্ত্র নীতি ইসলামী দলগুলোর জন্য, বিশেষ করে জামায়াতের জন্য, সাপে বর হয়ে আসে। ফলস্বরূপ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ছয়টি আসন জিতে নেয়, যা জামাতের শক্তি ও মনোবল বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টির উত্থান ঘটে। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন লাভ করে এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে যোগ দিয়ে ১৭টি আসন ও দুটো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পায়। যদিও ১৯৯৬ ও ২০০৮ এর নির্বাচনে যথাক্রমে মাত্র ৩টি ও ২টি আসন পায় তথাপিবাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত এক বড় ফ্যাক্টরে পরিণত হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করলে, কিছুদিন পর থেকেই যুদ্ধপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই বিচার কতটা প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্য নিয়ে আর কতটা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন অবশ্যই ওঠে। কারণ সেই বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই জামায়াতকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার আওয়ামী লীগের নীলনকশা অনেকটা বাস্তবায়িত হয়ে যায় বলে বিশ্লেষণ রয়েছে।
তবে আওয়ামী লীগ সরাসরি জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে দলটিকে নানা উপায়ে ব্যবহার করারও চেষ্টা করেছে বলে এক ধরনের মত প্রচলিত আছে। তবু আসল সত্য এই যে, এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জামায়াত কোনোভাবে টিকে আছে, এটাকেই অনেকে তাদের সবচেয়ে বড় সফলতা হিসেবে তুলে ধরেন। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তাদের কমই হয়েছে, প্রশ্ন থাকে কেন?
বাংলাদেশের সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও জামায়াতের সীমাবদ্ধতা
উপমহাদেশের ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামী অন্যতম প্রাচীন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। তথাপি রাজনীতির এই দীর্ঘ সময়ে দলটির আহামরি কোনও অর্জন নেই। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের মতন সুসংগঠিত ইসলামী দল কেন একবারের জন্যও এককভাবে ক্ষমতার স্বাদ নিতে পারেনি, কিংবা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি যেতে পারেনি, তা ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ ভক্তিপ্রবণ হলেও বিশ্বাসের দিক থেকে তুলনামূলক উদার। এই অঞ্চলের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক বাস্তবতার পাশাপাশি সুফি ঐতিহ্য মানুষের ধর্মীয় আবেগকে নরম ও আধ্যাত্মিক রেখেছে। ধর্মের র্যাডিকাল ব্যাখ্যা কখনোই এই অঞ্চলের মানুষের মূল চরিত্র গড়ে দিতে পারেনি। যার ফলে জামায়াত কিংবা জামায়াতের মত রেডিক্যাল মতাদর্শের দল কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি।
দ্বিতীয়ত, জামায়াতসহ অনেক ইসলামী দল সেই অর্থে ‘গণমানুষের অংশ’ হয়ে উঠতে পারেনি। এজন্য আমরা দেখি ১৯৪৭ কিংবা ১৯৭১ সালের মতো জনজাগরণের সময়ও গণআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে তারা অবস্থান নিয়েছে। এ ধরনের অবস্থান তাদের প্রতি বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর আস্থা গড়ে ওঠার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৃতীয়ত, ইসলামপন্থীদের মধ্যে শতধা বিভক্তিও এই ব্যর্থতার বড় কারণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের মনে ইসলাম ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের পক্ষপাতিত্ব আছে, কিন্তু বাস্তবে ইসলামপন্থী রাজনীতি নানা দল এবং উপদলে বিভক্ত। এতে জামায়াতের সম্ভাব্য ভোটব্যাংক ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে।
দেওবন্দী, সুফি, ওয়াহাবি: আকিদাগত দ্বন্দ্ব এবং জামায়াতের অবস্থান
বাংলাদেশ মূলত সুন্নি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সুন্নিদের মধ্যে দেওবন্দী, সুফিবাদী ধারা এবং ওয়াহাবি মতাদর্শ একটি ডমিনেন্ট উপগোষ্ঠী হিসেবে বিদ্যমান। জামায়াতে ইসলামীর ধর্মীয় আকিদা মধ্যপ্রাচ্যের ওয়াহাবিজম দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত, আর রাজনৈতিক দিক থেকে জামায়াত ইসলাম মিশরের ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মতাদর্শধারী। তাদের এই মতাদর্শিক কাঠামোর সাথে প্রচলিত সুন্নি ও দেওবন্দী ধারার দ্বন্দ্ব সুস্পষ্ট। অনেক সময় একদল অন্যদলকে কাফের বা ভণ্ড হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে।
এছাড়াও সুফিদের মাধ্যমে ইসলাম আসা এই ভূখণ্ডে সুফিজম বা মিস্টিসিজমের প্রভাবও লক্ষণীয়। যাদেরকে জামাত অনেকটা প্রকাশ্যেই ‘বেদাতি’ হিসেবে গণ্য করে। ফলে ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল জনগোষ্ঠীও নানাভাবে দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এই মতবিরোধের ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে। জমিয়ত তথা দেওবন্দী সিলসিলার আলেমগণ, বিশেষ করে হুসাইন আহমদ মাদানীর সাথে সায়েদ আবুল আলা মওদুদীর মতানৈক্য এবং সেখান থেকে উদ্ভূত দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই জামায়াতে ইসলামীর জন্ম। মওদুদীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, মুসলমানদের জাতীয়তা বা পরিচয় দেশ বা স্থানের সাথে নয়, বরং বিশ্বাসের সাথে যুক্ত। অপরদিকে ওলামায়ে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, জাতীয়তা দেশ এবং ভূখণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত।
তারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন, কওমে আদ এবং কওমে সামুদের মত কওমগুলোর পরিচয়ও স্থান এবং দেশের সাথে জড়িত, আল্লাহ পবিত্র কোরআনেও তাদেরকে কওম হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ওলামায়ে দেওবন্দের সাথে জামায়াতের আরেকটি মৌলিক মতবিরোধ ছিল সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে সব সাহাবী ঈমান, আমল, আদর্শ – সব ক্ষেত্রে সত্যের মাপকাঠি, কিন্তু মওদুদী তার ‘মিয়ারে হক’ বইতে সাহাবায়ে কেরামকে সেই অর্থে হকের একমাত্র মাপকাঠি নন বলে মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে।
তার ‘খেলাফত ও মলিকিয়াত’ এবং ‘রাসায়েল মাসায়েল’ বইয়ে উটের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধ ইত্যাদি প্রসঙ্গে আমিরে মুয়াবিয়া সহ কিছু সাহাবীর প্রসঙ্গে তাঁর কিছু সমালোচনামূলক মন্তব্যকে দেওবন্দী আলেমরা সাহাবাবিরোধী মনোভাব হিসেবে দেখেন। তাদের মতে, যারা সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনায় লিপ্ত থাকে, তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ভেতর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে না। এই আকিদাগত মতপার্থক্য থেকে রাজনৈতিক মতবিরোধ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। হোসাইন আহমদ মাদানীর নেতৃত্বে তৎকালীন ওলামায়ে দেওবন্দ মওদুদীকে ‘গোমরাহ’ বলে ফতোয়া দেন বলে প্রচলিত। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের কওমী আলেম ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ – দুই ধারার মধ্যেও এই দ্বন্দ্ব এখনো কমবেশি বিদ্যমান।
জামায়াত কি ইসলামী দল, নাকি রাজনৈতিক ব্র্যান্ড?
এই প্রশ্নটি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আছে: জামায়াতে ইসলামী কি আসলেই ইসলামী দল, নাকি ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল হিসেবে অভিনয় করছে? অনেক বিশ্লেষকের মতে, ধর্মের কথা বলা হলেও মূলত ভারতের কমিউনিজমবিরোধী শক্তি হিসেবেই একটি সংগঠনের জন্ম হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসকরাও তখন তাদের কিছুটা আনুকূল্য দিয়েছিল বলে ধারণা প্রচলিত।
মওলানা মওদুদীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামকে বাংলাদেশের অনেক ইসলামপন্থী দল ইসলামী দল হিসেবে গ্রহণ করে না। অনেক কওমী ঘরানার ও পীরপন্থী দলগুলো জামাতকে ‘গোমরাহ’ মনে করে। অন্যদিকে জামাতের ভেতরের অনুরাগীরা নিজেদেরকে একটি আদর্শ ইসলামী আন্দোলনের বাহক হিসেবে দেখেন।
নিষেধাজ্ঞা, টিকে থাকা এবং সাম্প্রতিক পুনর্নিষেধাজ্ঞা
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত অন্তত চার দফায় জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হয়েছে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৮ ও ১৯৬৪ সালে, আর বাংলাদেশে ১৯৭২ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালে মোট দুইবার নিষিদ্ধ হয় দলটি। তারপরও সংগঠনটি আন্ডারগ্রাউন্ড বা বিকল্প প্ল্যাটফর্মে থেকে সাংগঠনিক উপস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
জামাত দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তি দিয়ে আসছে, নিষেধাজ্ঞা, দমন–পীড়ন সত্ত্বেও টিকে থাকা – এটাই তাদের রাজনৈতিক সফলতা। সমালোচকদের মতে, এটি টিকে থাকা হলেও গণআকাঙ্ক্ষার মূলধারায় প্রবেশ করতে না পারার এক দীর্ঘ ব্যর্থতার ইতিহাসও বটে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট: ইসলামী ঐক্যের কথা, জেনারেশন জেড এবং ‘হিন্দু শাখা’ বিতর্ক
বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের মধ্যে জামাতের সাথে মতাদর্শিক বিবাদ থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার কিছু প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে। কিছুদিন আগে ইসলামী দলগুলোর কিছু নেতা–কর্মীকে নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়, সেখান থেকে ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ তথা চরমোনাই পীরও এক পর্যায়ে জামাতের সঙ্গে ঐক্যের সম্ভাবনার কথা ইঙ্গিত করেছেন, যদিও ইতিহাস বলে, ইসলামপন্থী দলগুলো ইতিপূর্বেও একাধিকবার ঐক্যের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে জুলাই অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা জেনারেশন জেড বা জেনজি প্রজন্মের বড় অংশের মধ্যে জামায়াতকে নিয়ে বিরূপ বা অন্তত মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যুদ্ধাপরাধের ইস্যু, ৭১-এর ভূমিকা, নারী ও সংখ্যালঘু প্রশ্নে জামাতের ভাবমূর্তি – সব মিলিয়ে তরুণদের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়নি।
তারপরও এখন পর্যন্ত জামাতের নেতৃস্থানীয়রা তুলনামূলক ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। জামাত যদি তাদের ঐতিহাসিক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে গণআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, তবে আগামী সংসদ নির্বাচনে তারা এযাবতকালের সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে – এমন সম্ভাবনার কথাও অনেকে বলছেন। তবে জামাত শক্তিশালী হলেই দেশে সরাসরি শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত হবে – এমন ধারণা করারও সুযোগ নেই। কারণ ইতিপূর্বে বিএনপির সঙ্গে দুটো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এবং ১৮ জন সংসদ সদস্য নিয়ে সরকারে থেকেও ইসলামের প্রশ্নে তারা কার্যত উল্লেখযোগ্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন আনেনি।
২৬ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডি টপিক হিসেবে দেখা যায়, রংপুরে জামাতের ‘হিন্দু শাখা’র কমিটি গঠন করা হয়েছে। জামাত দেশি–বিদেশি পরিমণ্ডলে এই বার্তাই দিতে চাইছে যে তারা কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠন নয়, বরং ‘মডারেট ইসলাম’-এর ধারক। ঐতিহাসিক এসব দিক পর্যালোচনা করলে অনেকে মনে করছেন, জামাতকে ইসলামী দলের চেয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করাই বেশি যুক্তিযুক্ত।
ইতিহাসের ভার, বর্তমানের হিসাব, ভবিষ্যতের প্রশ্ন
উপমহাদেশের এক বিরল রাজনৈতিক অর্গানাইজেশন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী একই সঙ্গে পাকিস্তানবিরোধী, পাকিস্তানের শরিক, স্বাধীনতা–বিরোধী এবং আবারও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিজেদের মানিয়ে নিতে চাওয়া এক সংগঠন। লাহোর প্রস্তাব থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ – এই দীর্ঘ পথচলায় তাদের আদর্শ, অবস্থান, কৌশল বহুবার বদলেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জনগণের ঐতিহাসিক চরিত্র, ইসলামপন্থীদের ভেতরের বিভক্তি, আকিদাগত দ্বন্দ্ব, এবং যুদ্ধাপরাধের প্রশ্ন – সব কিছু মিলিয়ে জামাত কখনোই এই দেশে মূলধারার সর্বজনগ্রাহ্য শক্তি হতে পারেনি। তবু তারা টিকে আছে, এবং আবারও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে জায়গা করে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন রয়ে যায়, আগামী দিনে কি জামায়াতে ইসলামী নিজেদের অতীতের ছায়া থেকে সত্যিই বেরিয়ে আসতে পারবে? নাকি ইতিহাসের ভারই শেষ পর্যন্ত তাদের সম্ভাবনাকে বারবার থামিয়ে দেবে? এই উত্তর সময়ই দেবে।
-সালেহিন
উড়ন্ত সরীসৃপের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে ধারণা বদল ৩২০টি ফাইটোলিথ পেলেন গবেষকরা
ডাইনোসরের যুগে আকাশে রাজত্ব করত বিশাল আকৃতির উড়ন্ত সরীসৃপ 'টেরাসর'। এই রহস্যময় প্রাণীদের বিভিন্ন প্রজাতি আবিষ্কৃত হলেও তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরেই ধোঁয়াশা ছিল। এতদিন কেবল তাদের মৎস্যভোজী বা মাছখাদক হওয়ার বিষয়েই প্রমাণ মিলেছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক যুগান্তকারী আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা প্রথমবার এক প্রজাতির টেরাসরের তৃণভোজী বা উদ্ভিদভোজী হওয়ার পক্ষে অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন।
বেইজিং-এ অবস্থিত চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেসের জীবাশ্মবিদ্যা বিভাগের গবেষক শাওলিন ওয়াং এবং তার সহযোগীরা এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারটি করেছেন। তারা 'সিনোপটেরাস অটাভিসামাস' (Sinopterus atavisamus) নামক এক প্রজাতির টেরাসরের জীবাশ্ম পরীক্ষা করছিলেন। উত্তর-পূর্ব চীনে খুঁজে পাওয়া এই জীবাশ্মের পেটের অংশে বিজ্ঞানীরা অসংখ্য ছোট ছোট 'গ্যাস্ট্রোলিথ' (পাকস্থলীর পাথর) এবং ৩২০টি 'ফাইটোলিথ' শনাক্ত করেন।
ফাইটোলিথ হলো একটি আণুবীক্ষণিক সিলিকা কণা, যা প্রাকৃতিকভাবে গাছের মধ্যেই তৈরি হয়। এর আগে কোনো টেরাসরের পাকস্থলীতে এই ধরনের নমুনা পাওয়া যায়নি, যা সরাসরি উদ্ভিদ খাওয়ার প্রমাণ দেয়।
যেভাবে নিশ্চিত হলেন বিজ্ঞানীরা: বিজ্ঞানীরা এই আবিষ্কারে যেন কোনো ভুল না থাকে, তা নিশ্চিত করতে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।
প্রথমে তারা নিশ্চিত হন যে এই ফাইটোলিথগুলো অন্য কোথাও থেকে জীবাশ্মের পেটে এসে জমেনি। এর জন্য তারা জীবাশ্মের আশপাশের পাথর পরীক্ষা করেন, কিন্তু সেখানে কোনো ফাইটোলিথের চিহ্ন মেলেনি।
এরপর তারা খতিয়ে দেখেন যে, এই টেরাসরটি অন্য কোনো তৃণভোজী প্রাণীকে খাওয়ার ফলে ফাইটোলিথগুলো তার পেটে এসেছে কিনা। কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর হাড়, আঁশ বা দেহের অন্য কোনো অংশের নমুনাও পেটে থাকার কথা। সিনোপটেরাসের এই জীবাশ্মে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।
এই দুই দফা পরীক্ষার পর বিজ্ঞানীরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত হন যে, 'সিনোপটেরাস অটাভিসামাস' প্রজাতিটি সরাসরি উদ্ভিদ বা গাছপালা খেয়েই জীবনধারণ করতো, অর্থাৎ তারা তৃণভোজী ছিল।
এর আগে টেরাসরদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিভিন্ন অনুমান প্রচলিত ছিল। শারীরিক গঠন দেখে কোনো প্রজাতিকে মাংসাশী, পতঙ্গভুক, মৎস্যভোজী বা তৃণভোজী বলে ধারণা করা হতো। তবে পাকস্থলীর নমুনা ছাড়া তা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। এখন পর্যন্ত মাত্র পাঁচটি টেরাসরের জীবাশ্মের পাকস্থলীর নমুনা পাওয়া গিয়েছিল, যেগুলোতে মাছের আঁশ জাতীয় বস্তু মেলায় কেবল তাদের মৎস্যভোজী হওয়ার বিষয়েই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন।
'সায়েন্স বুলেটিন' সাময়িকীতে প্রকাশিত এই নতুন গবেষণাপত্রটি ডাইনোসর যুগের বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে ধারণাকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, উড়ন্ত এই সরীসৃপদের মধ্যেও খাদ্যাভ্যাসের বৈচিত্র্য ছিল এবং তারা শুধু মাংস বা মাছের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং উদ্ভিদের উপরও নির্ভরশীল ছিল।
যেভাবে ইউরোপের ধ্বংসস্তূপে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ হয়ে উঠলো আমেরিকা!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, ইতিহাসের এক এমন প্রলয়ঙ্করী অধ্যায় যা কেবল লক্ষ লক্ষ প্রাণই কেড়ে নেয়নি, বদলে দিয়েছিল গোটা পৃথিবীর মানচিত্র ও ক্ষমতার ভারসাম্য। ইউরোপ যখন এই যুদ্ধের আগুনে পুড়ছিল, তখন আটলান্টিকের ওপারে থাকা একটি দেশ সুচতুরভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছিল। সেই দেশটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা। একসময়কার দেনাদার এই দেশটিই একটি মাত্র যুদ্ধের ডামাডোলে পরিণত হয় বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে।
যুদ্ধের সূচনা ও আমেরিকার নিরপেক্ষতা
১৯১৪ সালে অস্ট্রিয়ার আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিনান্দের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যখন ইউরোপের দুই বৃহৎ শক্তি—মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া) এবং কেন্দ্রীয় শক্তি (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য)—এক বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন আমেরিকা নিজেদেরকে এই সংঘাত থেকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ঘোষণা করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের স্লোগানই ছিল, "তিনি আমাদের যুদ্ধ থেকে দূরে রেখেছেন।"
আমেরিকার অর্থনৈতিক উত্থান
আমেরিকা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও, অর্থনৈতিকভাবে তারা এই যুদ্ধকে এক বিশাল ব্যবসায়িক সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। যুদ্ধরত ইউরোপীয় দেশগুলোর, বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের, তখন খাদ্যের গুদাম থেকে শুরু করে অস্ত্রের কারখানা—সবকিছুই প্রয়োজন। আমেরিকা হয়ে ওঠে তাদের প্রধান সরবরাহকারী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের কাছে জাহাজ ভর্তি করে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিক্রি করতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। ইউরোপ যখন তার সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে এই যুদ্ধের আগুন জ্বালাচ্ছিল, সেই সম্পদগুলোই সরাসরি স্থানান্তরিত হচ্ছিল আমেরিকার কোষাগারে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে, যে আমেরিকা ছিল বিশ্বের অন্যতম ঋণগ্রস্ত দেশ, সেই দেশই পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম ঋণদাতা দেশে।
যেভাবে আমেরিকা যুদ্ধে জড়ালো
তবে এই ব্যবসায়িক নিরপেক্ষতা বেশিদিন টেকেনি। জার্মানি যখন 'আনরেস্ট্রিক্টেড সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার' (অবাধ সাবমেরিন যুদ্ধ) ঘোষণা করে, তখন পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। জার্মান সাবমেরিনগুলো আটলান্টিকে মিত্রশক্তির জাহাজগুলোকে নির্বিচারে ডোবাতে শুরু করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল 'লুসিতানিয়া' নামক একটি ব্রিটিশ জাহাজ, যা ডোবানোর ফলে অনেক আমেরিকান নাগরিকও প্রাণ হারান।
কিন্তু আমেরিকার যুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত কারণটি ছিল 'জিমারম্যান টেলিগ্রাম'। এই গোপন বার্তায় জার্মানি মেক্সিকোকে প্রস্তাব দেয় যে, মেক্সিকো যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়, তবে জার্মানি মেক্সিকোকে তার হারানো অঞ্চল (টেক্সাস, অ্যারিজোনা) পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। এই টেলিগ্রাম ফাঁস হওয়ার পর আমেরিকান জনমত পুরোপুরি জার্মানির বিরুদ্ধে চলে যায়।
যুদ্ধের পরিণতি ও নতুন বিশ্বশক্তি
১৯১৭ সালে আমেরিকা জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের তাজা সৈন্য এবং অঢেল সামরিক সরঞ্জাম মিত্রশক্তির বিজয়কে ত্বরান্বিত করে। ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে ইউরোপ সম্পূর্ণ দেউলিয়া। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের শিল্প-কারখানা ধ্বংসস্তূপে পরিণত এবং তারা আমেরিকার কাছে বিপুল ঋণে জর্জরিত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ব্রিটেনের কাছ থেকে বিশ্বের অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট কেড়ে নেয় এবং তা পরিয়ে দেয় আমেরিকার মাথায়। ইউরোপের ধ্বংসযজ্ঞের উপর দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবির্ভূত হয় পৃথিবীর নতুন এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে, যে অবস্থান তারা আজও ধরে রেখেছে।
মশলা কিনতে এসে দেশ দখল: যেভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাইভেট আর্মি!
কল্পনা করুন এমন একটি প্রাইভেট কোম্পানির কথা, যা এতটাই শক্তিশালী যে সে তার গ্রাহকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে, দেশ দখল করে ফেলতে পারে এবং এক পর্যায়ে ৪০০ মিলিয়ন মানুষের ওপর রাজত্ব কায়েম করে। এটি কোনো কল্পকাহিনী নয়, এটি ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত এবং প্রভাবশালী কোম্পানি—ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গল্প।
শুরুটা হয়েছিল শুধু মশলার লোভে
১৬০০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর, নিউ ইয়ারের ঠিক আগের রাতে। রানি এলিজাবেথ লন্ডনের একদল ব্যবসায়ীকে 'দ্য গভর্নর অ্যান্ড কোম্পানি অফ মার্চেন্টস অফ লন্ডন ট্রেডিং ইনটু দ্য ইস্ট ইন্ডিজ' বা সংক্ষেপে 'ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' নামে একটি কোম্পানি খোলার অনুমতি দেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল খুবই সরল—পূর্বের দেশগুলো, বিশেষ করে ভারতবর্ষ ও সাউথ-ইস্ট এশিয়া থেকে মশলা (মরিচ, দারুচিনি, জিরা) কিনে এনে ইউরোপে চড়া দামে বিক্রি করা। তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্রিটিশরা ডাচ, পর্তুগিজ ও স্প্যানিশদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। এই কোম্পানি ছিল সেই পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি ব্যবসায়িক প্রচেষ্টা মাত্র।
ভাগ্যবশত ভারতবর্ষে আগমন
কোম্পানির প্রথম জাহাজগুলো ইন্দোনেশিয়ার দিকে যাত্রা শুরু করে, কারণ সেখানেই মশলার ভাণ্ডার ছিল। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার বাণিজ্যে ডাচদের একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে ব্রিটিশরা সেখানে ভিড়তে না পেরে বাধ্য হয়েই ভারতবর্ষের দিকে জাহাজ ঘোরায়। কিন্তু ভারতবর্ষে এসে তারা নতুন এক সমস্যায় পড়ে—এখানে ইন্দোনেশিয়ার মতো পর্যাপ্ত মশলা নেই। তখন তারা নতুন পরিকল্পনা করে। তারা বুঝতে পারে, ভারতবর্ষের টেক্সটাইল বা বস্ত্রশিল্প বিশ্বমানের। তারা মশলার বদলে টেক্সটাইল বাণিজ্যের সিদ্ধান্ত নেয়।
মুঘলদের সেই ঐতিহাসিক ভুল
তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে স্যার জেমস নামক এক ব্রিটিশ প্রতিনিধি প্রচুর উপঢৌকন ও ঘুষ নিয়ে হাজির হন। তার উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা করার অনুমতি নেওয়া। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাদের সুরাট, মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলকাতায় অফিস স্থাপনের অনুমতি দেন। শর্ত ছিল, ব্রিটিশরা ব্যবসা করবে এবং আয়ের ওপর মুঘল সাম্রাজ্যকে একটি বড় অঙ্কের ট্যাক্স দেবে। ইতিহাসবিদরা মুঘলদের এই সিদ্ধান্তকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্তগুলোর একটি বলে মনে করেন।
ব্যবসা থেকে যেভাবে সেনাবাহিনীতে রূপান্তর
পরের কয়েক দশক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা রমরমা হয়ে ওঠে। তারা শুধু টেক্সটাইলই নয়, ভারতবর্ষেও মশলার সন্ধান পায়। জাহাজ ভরে ভরে সম্পদ ব্রিটেনে যেতে থাকে। কোম্পানি যত ধনী হচ্ছিল, মুঘল সাম্রাজ্যও তত বেশি ট্যাক্স পাচ্ছিল। স্থানীয় মানুষরাও কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ায় সবাই খুশি ছিল। কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হতে শুরু করে এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
১৭১৭ সালে সম্রাট ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও মাদ্রাজে ট্যাক্স-মুক্ত বাণিজ্যের এক বিতর্কিত অনুমতি আদায় করে নেয়। এর পেছনেও ছিল প্রচুর ঘুষ। ট্যাক্স মওকুফ পাওয়ায় কোম্পানির মুনাফা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। এই সুযোগে কোম্পানি তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা বলে ধীরে ধীরে প্রাইভেট আর্মি বা নিজস্ব সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে শুরু করে।
কোম্পানির উত্থান ও ভারতবর্ষের পতন
১৭৫০ সাল আসতে আসতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিজস্ব সৈন্য সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়, যা অনেক মুঘল সম্রাটের সম্মিলিত সেনাবাহিনীর চেয়েও বড় ও শক্তিশালী ছিল। তাদের হাতে ছিল আধুনিক ব্রিটিশ অস্ত্রশস্ত্র। মুঘল শাসকরা যখন বুঝতে পারেন যে তারা 'দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষেছেন', তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানির এই ঔদ্ধত্য মেনে না নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে এবং মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব পরাজিত ও নিহত হন। এরপরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার পুতুল শাসক বসিয়ে আক্ষরিক অর্থেই লুটপাট শুরু করে। আজকের হিসাবে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের সোনা বাংলার কোষাগার থেকে ব্রিটেনে পাচার করা হয়। জনগণের ওপর চাপানো হয় অসহনীয় কর, শুরু হয় জোরপূর্বক নীল চাষ।
দুর্ভিক্ষ ও চূড়ান্ত দখল
এই ভয়াবহ শোষণের ফলে বাংলায় নেমে আসে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষগুলোর একটি (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর), যাতে এক কোটিরও বেশি মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে মারা যায়। কোম্পানি এরপর শাহ আলমের সাথে যুদ্ধে জিতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার পূর্ণ দখল নেয়। টিপু সুলতানের মতো যারা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিলেন, তাদেরও নির্মমভাবে পরাজিত ও হত্যা করা হয়।
মাত্র দেড়শ বছরের মধ্যে নিছক মশলা কিনতে আসা একটি প্রাইভেট কোম্পানি গোটা ভারতবর্ষের রাজা হয়ে বসে। এটি এমন এক ঘটনা যা যেকোনো কল্পনাকেও হার মানায়। ১৮০০ সাল নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান এবং শক্তিশালী কোম্পানিতে পরিণত হয়। এই পুরো দখলদারিত্বে ব্রিটিশ সরকারের গোপন মদদ ও সরাসরি ইন্ধন ছিল, যা ১৭৮৪ সালের 'পিটস ইন্ডিয়া অ্যাক্ট'-এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কীভাবে একটি জাতির পরাধীনতার কারণ হতে পারে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার সবচেয়ে নির্লজ্জ উদাহরণ।
হাউসকা দুর্গের ভূগর্ভ আর ‘শয়তানের বাইবেল’ কোডেক্স গিগাস: কিংবদন্তি, ইতিহাস ও ভয়ের মনস্তত্ত্ব
বোহেমিয়ার অরণ্যমালায় একটি দুর্গ, হাউসকা ক্যাসেল, আর তার কয়েক মাইল দূরে এক সন্ন্যাসীর লেখা বিশাল এক পুঁথি, কোডেক্স গিগাস। শতাব্দীজুড়ে এই দুই নামকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে অজস্র রহস্য, ধর্মীয় প্রতীক, লোককথা, নাৎসি আগ্রহ, আর মধ্যযুগীয় মানুষের ভয়ের ভাষা। একদিকে সন্ন্যাসী হারমান দ্য রিক্লুসের অলৌকিক এক রাতের লেখনী, অন্যদিকে নাকি নরকের মুখ বলে পরিচিত এক অতল গহ্বর। ইতিহাস কী বলে, কিংবদন্তি কোথায় জন্ম নেয়, আর কেনই বা এই টেক্সট ও স্থাপত্য মানুষের মনে আশংকা ও আশার দ্বৈত অনুভূতি জাগিয়ে রাখে, এই ফিচারে তারই অনুসন্ধান।
হারমানের রাত ও ‘শয়তানের সঙ্গে চুক্তি’ শিরোনাম কিংবদন্তি
লোককথা বলে, ১২২৯ সালে অপরাধের জন্য হারমান নামের এক সন্ন্যাসীকে জীবন্ত প্রাচীর তুলে কারাবন্দি করার রায় হয়। প্রাণভিক্ষা চেয়ে তিনি অঙ্গীকার করেন যে এক রাতের মধ্যে এমন এক পুঁথি লিখে দেবেন যা বিশ্বজ্ঞানকে একত্র করবে। অসম্ভবকে সম্ভব, সকালে দেখা গেল ৬২০ পৃষ্ঠার এক বিশাল পাণ্ডুলিপি, নিখুঁত ল্যাটিন ক্যালিগ্রাফি, ত্রুটি বা কাটাকুটি নেই। জিজ্ঞেস করলে হারমান বলেন, তিনি সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, তবে ঈশ্বরের কাছে নয়, অন্য এক সত্তার কাছে। সেই থেকে এটি ‘ডেভিল’স বাইবেল’ নামেও পরিচিত, কারণ ৫৭৭ নম্বর পাতায় আছে শয়তানের পূর্ণাঙ্গ এক প্রতিকৃতি।
কোডেক্স গিগাস, বাস্তবের মাপে এক অস্বাভাবিক পাণ্ডুলিপি
কোডেক্স গিগাস ল্যাটিনে ‘বৃহৎ পুঁথি’। এর উচ্চতা প্রায় ৩৬ ইঞ্চি, প্রস্থ ২০ ইঞ্চি, পুরু ৯ ইঞ্চি, ওজন প্রায় ১৬৫ পাউন্ড। পুরনো ও নতুন নিয়মসহ বিশাল বাইবেলীয় অংশ, ইহুদি ইতিহাসবিদ জোসেফাসের ‘অ্যান্টিকুইটিজ’, ইসিদোর অব সেভিলের ‘এটিমোলজিস’ থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিজ্ঞান, অ্যানাটমি, রোগনির্ণয়, ভেষজ, এমনকি আচার ও মন্ত্রের অধ্যায়, বহু ভাষার বর্ণমালা, সব মিলিয়ে এক ধরনের মধ্যযুগীয় জ্ঞানকোষ। পাতাভেদে স্বর্ণালংকরণ, দুষ্প্রাপ্য কালি, চামড়া, আনুমানিক একশ ষাটটিরও বেশি প্রাণীর চর্ম থেকে প্রস্তুত পার্চমেন্ট। ১৬৪৮ সাল থেকে বইটি সুইডেনের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত, আজ ডিজিটাল স্ক্যান উন্মুক্ত।
কিংবদন্তি বনাম ইতিহাস
ইতিহাসবিদেরা দেখিয়েছেন, এক রাতে লেখা সম্ভব নয়। হাতের লেখার সামঞ্জস্য, কালি ও পার্চমেন্টের স্তরবিন্যাস, কার্বন ডেটিং, সব মিলিয়ে বাস্তবসম্মত সময়সীমা ২০ থেকে ৩০ বছর। অর্থাৎ একনিষ্ঠ, দীর্ঘ পরিশ্রম, নির্ভুলতা, পুনরাবৃত্ত অনুশীলন। হারমানের অস্তিত্ব প্রামাণ্য, তবে তার বিরুদ্ধে তথাকথিত ধর্মদ্রোহের মামলা বা জীবন্ত দেওয়াল তুলে মৃত্যুদণ্ডের নথি নেই। শয়তানের প্রতিকৃতি মধ্যযুগীয় গ্রন্থচিত্রে অস্বাভাবিক নয়, নৈতিক সতর্কবার্তা হিসেবে এটি প্রচলিত ছিল। রহস্য আছে অবশ্য, ভূতগ্রাস তাড়ানোর অংশের পর ১০ পৃষ্ঠা পরিকল্পিতভাবে কেটে নেওয়া, যা আজও নিখোঁজ।
হাউসকা ক্যাসেল, সিল করা গহ্বর এবং ভয়ের স্থাপত্য
বোহেমিয়ার লাইমস্টোন শিলাস্তরে গড়া হাউসকা ক্যাসেলকে ঘিরে আরেক কিংবদন্তি, দুর্গটি নাকি বাইরের শত্রুকে নয়, ভেতরের এক অতল গহ্বরকে আটকে রাখতে তৈরি। রান্নাঘর বা আবাসের মতো প্রাত্যহিক কাঠামো অনুপস্থিত, দুর্গপ্রাচীরও মুখ করে আছে আঙিনার দিকে। স্থানীয়দের স্মৃতিতে এটি ছিল ‘নরকের ছিদ্র’, যেখানে পাথর ফেললে শব্দ শোনা যেত না, দড়ি নামালে শেষ পড়ত না। তেরো শতকে ডিউক অটাকার দ্বিতীয় এ জায়গায় বন্দিদের দড়ি বেঁধে নামানোর পরীক্ষা চালান বলে নথি আছে। প্রত্যেকে ফিরে আসে শোকে পাথর, চুল পেকে যায়, কেউ কেউ উন্মাদ, কেউ আর ফেরেই না। শেষে প্রার্থনাপাঠে আশীর্বাদ দেওয়া চুনাপাথরের স্ল্যাব, কাঠ, প্রার্থনার মশলা মিশিয়ে গহ্বরটি ঢেকে উপরেই তৈরি হয় সেন্ট মাইকেলের চ্যাপেল। অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সিলমোহর দিয়ে ভূতুড়ে এক শূন্যতাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা।
নাৎসি অধ্যায়, নথি ধ্বংস, এবং অবরুদ্ধ স্মৃতি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসএস প্রধান হিমলারের নির্দেশে ১৯৪০ সালে জার্মান বাহিনী দুর্গ দখল করে। লোকমুখে আছে, তারা চ্যাপেলের মেঝে ভেঙে আবার খোঁড়াখুঁড়ি করে, বন্দিদের গহ্বরে নামিয়ে পরীক্ষা চালায়। ফিরে আসা কয়েকজনের চুল পেকে যায়, কেউ অচেনা ভাষায় বলতে থাকে, কেউ নিজের চোখ নষ্ট করে, তিনজনের খোঁজ মেলে না। ১৯৪৫ সালে বার্লিন থেকে নির্দেশ আসে, সব সরঞ্জাম ধ্বংস, রেকর্ড পুড়িয়ে ফেলো, গহ্বর কংক্রিটে ভরাট, উপরে ধাতব প্লেট, তালা, আশেপাশে ল্যান্ডমাইন। যুদ্ধশেষে দুর্গ বহুদিন অচল, ১৯৯৯ সালে পর্যটকদের জন্য খোলে। আজও অদ্ভুত শব্দ, আলো, অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার কাহিনি শোনা যায়, তবে নিশ্চিত নথি অপ্রতুল।
এক পুঁথি কেন এত অন্ধকার, এক দুর্গ কেন এত ভীতিকর
মধ্যযুগের মানুষ অসুখ, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের অনিশ্চয়তায় বাস করত। অদৃশ্য বিপর্যয়ের ভাষা ছিল দানব, অশুভ শক্তি, ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা অশরীরী। কোডেক্স গিগাসে তাই বাইবেল, ইতিহাস, চিকিৎসা, প্রাকৃতিক বিদ্যার সঙ্গে মন্ত্র, প্রতিরক্ষামূলক আচার, দুষ্টশক্তি শনাক্ত করার উপায় পাশাপাশি। মানুষের প্রয়োজন ছিল একটি ‘অপারেশনাল ম্যানুয়াল’, যাতে অশুভকে চেনা, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিহত করার পদ্ধতি থাকে। তাই এই পুঁথি টিকে গেছে, দামী, বিরল, প্রতীকী। অন্যদিকে হাউসকা দুর্গ এক ধরনের প্রতিরোধ স্থাপত্য, বাইরে নয় ভেতরের উত্তরণের মুখে প্রাচীর, ধর্মীয় আচার মিশিয়ে ভয়কে সিল করা। উভয়েই মানুষকে বার্তা দেয়, অশুভকে লড়ে জেতা যায়।
গবেষণার আলো, লোককথার ছায়া
কোডেক্সের এক রাতের জন্ম অকল্পিত, তবে এক সন্ন্যাসীর ত্রিশ বছরের পরিশ্রম সম্ভব। হাউসকার অতল গর্তকে ভূতত্ত্ব বলে ক্যাভার্ন বা সিঙ্কহোল বলা যায়, তবে প্রমাণ সংগ্রহ কঠিন, ইতিহাসের ধারা প্রায়ই ধ্বংস, ল্যান্ডমাইনের ভয়ও আছে। নাৎসিদের তন্ত্রানুরাগ নথিভুক্ত, কিন্তু এই দুর্গে তারা কী পেয়েছিল তা অনিশ্চিত। লোককথা এখানে শূন্যতা পূরণ করে, অজানাকে নাম দেয়, ভয়কে রূপ দেয়, আর মানুষকে প্রতিরোধের ভাষা শেখায়।
কিংবদন্তি থেকে ইতিহাস, ইতিহাস থেকে আশা
কোডেক্স গিগাস আর হাউসকা ক্যাসেল দুটিই আছে, দুটিই কিংবদন্তিতে মোড়া, কিন্তু দুটোরই কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের সাহস, শৃঙ্খলা, সংগঠিত প্রতিরোধ। হারমানের গল্প হয়তো অলৌকিক নয়, কিন্তু তা একনিষ্ঠ শ্রমের পৌরাণিক প্রতিমা। হাউসকার গহ্বর হয়তো ভূতত্ত্ব, কিন্তু উপরেই নির্মিত চ্যাপেল মানুষের মনস্তত্ত্ব, অশুভকে সীলমোহর দেওয়ার প্রতীক। ভয় বাস্তব, দানব বাস্তব না হলেও মানুষের প্রতিরোধ বাস্তব, লিখিত জ্ঞান বাস্তব, আর সেখানেই আছে আশার জায়গা।
ইতিহাসের কাজ কেবল রহস্য বর্ণনা নয়, বরং বোঝানো, কেন, কীভাবে, কোন সামাজিক প্রয়োজনে এই গল্পগুলো জন্ম নেয়। কোডেক্স গিগাস তাই শয়তানের সঙ্গে চুক্তির কাহিনি নয়, বরং অন্ধকার সম্পর্কে জ্ঞান, চিকিৎসা, ইতিহাস, এবং প্রতিরক্ষার নকশা। হাউসকা দুর্গ কোনো হরর সেট নয়, বরং ভয়ের উপর আচ্ছাদিত এক ধর্মীয় প্রতিরক্ষা স্থাপত্য। এই দুই স্মারক আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অজানার মুখোমুখি হলে মানবতা কলম তোলে, প্রার্থনা করে, প্রাচীর তোলে, আর সবচেয়ে বড় কথা, একে অপরের পাশে দাঁড়ায়।
যুদ্ধ ও মহানুভবতা: সুলতান সালাউদ্দিন যেভাবে জেরুজালেম জয় ও শত্রুর মন জিতেছিলেন
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু নেতা আছেন, যাদের সামরিক দক্ষতার চেয়েও বেশি আলোচিত হয় তাদের মহানুভবতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। সুলতান সালাউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবী, বা পশ্চিমা বিশ্বে যিনি 'সালাদিন' নামে পরিচিত, তিনি তেমনই এক কিংবদন্তি। তিনি শুধু মুসলিম বিশ্বকে একত্রিত করে ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেমই মুক্ত করেননি, বরং তার উদারতা ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের মনেও সম্মানের স্থান করে নিয়েছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ক্রুসেডের জন্ম দেয়।
ইরাকের তিকরিত শহরে ১১৩৭ বা ১১৩৮ সালে এক প্রভাবশালী কুর্দি পরিবারে সালাউদ্দিনের জন্ম। তার সামরিক জীবনের শুরু হয় চাচা শিরকুর হাত ধরে, যিনি ছিলেন সিরিয়ার শাসক নূর আল-দীনের অন্যতম সেরা সেনাপতি। ১১৬৯ সালে তারা মিশর দখল করেন এবং চাচার মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন মিশরের উজির হন। পরবর্তীতে ১১৭১ সালে তিনি নূর আল-দীনের আদেশে ফাতেমীয় খিলাফতের অবসান ঘটিয়ে আইয়ুবীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। নূর আল-দীনের মৃত্যুর পর সালাউদ্দিন তার বিচক্ষণতা দিয়ে সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, মিশর ও ফিলিস্তিনকে একত্রিত করে এক বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।
ক্রুসেডারদের সাথে একটি শান্তি চুক্তিকার্যকর থাকলেও, রেনল্ড অফ শ্যাটালিয়ন নামক এক ক্রুসেডার নাইট মুসলিম বাণিজ্য কাফেলার উপর আক্রমণ করে এবং নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে কটূক্তি করে। এই ঘটনায় সালাউদ্দিন চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই 'ব্যাটল অফ হাত্তিন'-এ সালাউদ্দিনের বাহিনী ক্রুসেডারদের সম্মিলিত বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
এই বিজয়ের পর সালাউদ্দিনের সামনে খুলে যায় জেরুজালেমের দরজা। তিনি শহরটি শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের জন্য দুবার প্রস্তাব দেন, এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে কোনো নাগরিকের ক্ষতি করা হবে না, এমনকি ক্রুসেডারদেরকেও তাদের সম্পদসহ নিরাপদে শহর ত্যাগের সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।
শহর দখলের সময় ফরাসি অভিজাত ব্যালিয়ান অফ ইবেলিনের ঘটনাটি সালাউদ্দিনের মহানুভবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ব্যালিয়ান সুলতানের কাছে তার পরিবারকে জেরুজালেম থেকে বের করে আনার অনুমতি চান। সালাউদ্দিন তাকে অনুমতি দেন। কিন্তু ব্যালিয়ান শহরে ঢোকার পর তাকেই শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নেতা বানানো হয়। ব্যালিয়ান যখন এই অনাকাঙ্ক্ষিত 'বিশ্বাসঘাতকতা'র কথা সালাউদ্দিনকে জানান, সুলতান তখন ক্রুদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে তার পরিস্থিতি বোঝেন এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। এমনকি জেরুজালেম বিজয়ের পর সুলতান ব্যালিয়ান ও তার পরিবারকে নিজের তাঁবুতে দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করান এবং উপহার সামগ্রীসহ নিরাপদে পৌঁছে দেন।
জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাউদ্দিন কোনো প্রতিশোধ নেননি। তিনি সমস্ত বন্দীদের জন্য সামান্য মুক্তিপণ ধার্য করেন। অসংখ্য মানুষ সেই টাকা দিতে না পারায় সুলতান সালাউদ্দিন এবং তার ভাই সাফাদিন নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিয়ে তাদের মুক্ত করে দেন। তার এই উদারতায় জেরুজালেমের সাধারণ মানুষ মুগ্ধ হয়ে যায় এবং ৮৮ বছর পর আল-আকসা মসজিদে আবার জুম্মার নামাজ আদায় করা হয়।
জেরুজালেমের পতনে ইউরোপে আগুন জ্বলে ওঠে এবং পোপ তৃতীয় ক্রুসেডের ডাক দেন। এই ক্রুসেডে যোগ দেন ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি রাজা রিচার্ড 'দ্য লায়নহার্ট'। ১১৯১ সালে রিচার্ড 'আকরে' শহরটি দখল করেন। কিন্তু বিজয়ের পর তিনি সালাউদ্দিনের মহানুভবতার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র প্রদর্শন করেন—প্রায় আড়াই হাজার মুসলিম যুদ্ধবন্দীকে তিনি ঠাণ্ডা মাথায় মৃত্যুদণ্ড দেন।
রিচার্ড এরপর জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। আরসুফের ময়দানে রিচার্ডের বাহিনী জয় পেলেও সালাউদ্দিনের বিচক্ষণ সামরিক কৌশলের কারণে মুসলিম বাহিনীর তেমন বড় ক্ষতি হয়নি। সালাউদ্দিন সরাসরি বড় যুদ্ধের পরিবর্তে 'হিট অ্যান্ড রান' কৌশল প্রয়োগ করতে থাকেন। রিচার্ডের বাহিনী জেরুজালেম থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে এসেও শহরটি আক্রমণ করার সাহস পায়নি। কারণ রিচার্ড বুঝতে পেরেছিলেন, শহর দখল করতে পারলেও সালাউদ্দিনের গেরিলা আক্রমণের মুখে তা ধরে রাখা অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত, রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন এবং উভয় পক্ষ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ১১৯২ সালে সালাউদ্দিন ও রিচার্ডের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, জেরুজালেম মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে, তবে খ্রিস্টান তীর্থযাত্রীদের শহরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
সুলতান সালাউদ্দিন কেবল একজন দক্ষ সামরিক নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের নেতা, যিনি যুদ্ধের ময়দানেও তার মানবিকতা ও ন্যায়বিচারবোধ হারাননি। তার এই গুণাবলী তাকে মুসলিম বিশ্বের পাশাপাশি পশ্চিমা ইতিহাসেও এক সম্মানিত আসনে আসীন করেছে।
চেঙ্গিস খানের অজানা গল্প: এক গরীব বালক যেভাবে পৃথিবীর ৪০% মানুষের যমদূত হয়ে উঠেছিল!
প্রায় ৯০০ বছর আগে, ১১৬২ সালে মঙ্গোলিয়ার এক অত্যন্ত গরীব পরিবারে এক ছেলের জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয় তেমুজিন। কেউ তখন কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই ছেলেই একদিন 'চেঙ্গিস খান' নামে পরিচিত হবে এবং পৃথিবীর প্রায় ৪০% মানুষকে একাই শেষ করে দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যগুলোর একটি প্রতিষ্ঠা করবে। শুধু তাই নয়, সে-ই পৃথিবীর প্রথম কার্যকরী কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কও তৈরি করবে।
তেমুজিনের বাবা মঙ্গোলিয়ান একটি ছোট্ট এলাকার রাজা হলেও খুব ধনী ছিলেন না। তেমুজিনের বয়স যখন মাত্র ৯ বছর, তখন মঙ্গোলিয়ান প্রথা অনুযায়ী তার বাবা তাকে বিয়ে করানোর জন্য অন্য গ্রামে নিয়ে যান এবং সেখানে ঘর জামাই হিসেবে রেখে আসেন। কিন্তু ফেরার পথে 'তাতারস' নামক এক শত্রু গ্রামে বিশ্রাম নেওয়ার সময় তাকে বিষ মেশানো দুধ খাইয়ে হত্যা করা হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে তেমুজিন তার ট্রাইবের রাজা হলেও, এই বালকের কথা কেউ শুনত না। তার পরিবারকে চরম দারিদ্র্য ও অবহেলার মধ্যে দিন কাটাতে হয়; তার মা অন্যের বাসায় কাজ করে এবং শস্য ফলিয়ে কোনোমতে সংসার চালাতেন। এই কঠিন পরিস্থিতি তেমুজিনকে অল্প বয়সেই কঠোর করে তোলে। তার প্রথম খুনের ঘটনাটিও ঘটে মাত্র ১৩ বছর বয়সে, যখন সে খাবারের বন্টন নিয়ে বিবাদের জেরে তার নিজের সৎ ভাইকে খুন করে ফেলে।
বাবার মৃত্যুর পর তাদের গ্রাম অরক্ষিত হয়ে পড়ায় প্রায়ই বাইরের শত্রুরা আক্রমণ করত। এমনই এক আক্রমণে তেমুজিন বন্দি হয় এবং তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে গলায় কুকুরের মতো বেল্ট পরিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। এক পরিবারের দয়ায় সে কোনোমতে খাবার ও পানি পেত এবং শেষ পর্যন্ত তাদের সাহায্যেই সে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। পালিয়ে এসে সে যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে শান্তিতে জীবন কাটানোর পরিকল্পনা করছে, ঠিক তখনই আবার আক্রমণে তার স্ত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ঘটনায় তেমুজিন প্রায় পাগলের মতো হয়ে যায়। বাবার প্রতি অনুগত কিছু পুরনো মানুষের সাহায্যে সে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের একটি ছোট্ট বাহিনী গঠন করে এবং তার জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই যুদ্ধে সে শুধু তার স্ত্রীকেই উদ্ধার করে না, বরং আক্রমণকারী গ্রামটিকে সম্পূর্ণ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।
এই যুদ্ধের মাধ্যমেই তেমুজিন প্রথম উপলব্ধি করে যে, নেতৃত্ব শুধু ক্ষমতা বা ভীতি প্রদর্শনের বিষয় নয়, বরং সঠিক নেতৃত্বদানের গুণাবলী থাকলে ক্ষমতা ছাড়াই মানুষকে একত্র করা সম্ভব। সে তার সেনাবাহিনী গঠনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। মঙ্গোলিয়ান প্রথা ভেঙে সে বয়সের বদলে যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্কিলের ভিত্তিতে সেনাপতি নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। সে ঘোষণা করে, যুদ্ধে জেতার পর সমস্ত সম্পদ সৈন্যদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হবে। একই সাথে, সে আনুগত্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং বিশ্বাসঘাতকদের জনসমক্ষে ভয়ঙ্কর শাস্তি প্রদান করে (যেমন এক জেনারেলকে সে জীবন্ত সিদ্ধ করে হত্যা করে)।
এই কঠোরতা ও উদারতার মিশ্র কৌশলে তেমুজিন একের পর এক বিভক্ত মঙ্গোলিয়ান ট্রাইবগুলোকে একত্রিত করতে শুরু করে। ১২০৬ সাল নাগাদ সে এমন এক অসাধ্য সাধন করে, যা তার আগে মঙ্গোলিয়ার ইতিহাসে কেউ করতে পারেনি – সে সমস্ত বিভক্ত ট্রাইবকে এক পতাকার নিচে নিয়ে আসে। তখন তাকে 'চেঙ্গিস খান' বা 'ইউনিভার্সাল রুলার' (বিশ্বজনীন শাসক) উপাধি দেওয়া হয়।
চেঙ্গিস খান শুধু মঙ্গোলিয়াতেই থেমে থাকেনি। সে পৃথিবী দখলের পরিকল্পনা শুরু করে। সে তার সাম্রাজ্যের জন্য নতুন আইন তৈরি করে, যেখানে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়া হয় এবং মিথ্যা বলা ও নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করাকে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন ছিল একটি অবিশ্বাস্য কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক। সে প্রতি ৩০ থেকে ৪০ মাইল পরপর একটি করে স্টেশন তৈরি করে, যেখানে রিফ্রেশমেন্ট, খাবার এবং তাজা ঘোড়ার ব্যবস্থা থাকত। এর ফলে মঙ্গোলিয়ান আর্মি ছিল তৎকালীন পৃথিবীর দ্রুততম বাহিনী, যা একদিনে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে পারত। এই নেটওয়ার্ককে ইন্টারনেটের আগের যুগের ইন্টারনেট বলা হয়। সে একে একে ইরান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্তান, চীন ও কোরিয়াসহ বিশাল ভূখণ্ড দখল করে নেয়।
চেঙ্গিস খানের এই বিজয়ের ফলে তৎকালীন সিল্ক রোড বা বাণিজ্যিক রুটগুলো অত্যন্ত নিরাপদ হয়ে ওঠে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। কিন্তু এই শাসক সারাজীবন শাসন করতে পারেননি। ১২২৭ সালে চীনাদের সাথে এক যুদ্ধে সে একটি তীরের আঘাতে আহত হয় এবং সেই ক্ষত থেকে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে সে নির্দেশ দেয়, তার কবর যেন এমনভাবে দেওয়া হয়, যা পৃথিবীর কেউ কখনো খুঁজে পাবে না। সৈন্যরা তাকে কবর দেওয়ার পর, যারা কবর দিয়েছিল তাদের সবাইকে হত্যা করা হয় এবং তারাও আত্মহত্যা করে।
চেঙ্গিস খান পৃথিবীর ইতিহাসে এক জটিল চরিত্র। সে যেমন উদ্ভাবনী নেতা ছিল, তেমনই ছিল এক নির্মম বিজয়ী। তার এই বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে, সে তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ বা প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন মানুষকে হত্যা করেছিল, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ও ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ।
ধ্বংসস্তূপ থেকে মহাশক্তি: চীনের পুনর্জন্মের বিস্ময়গাঁথা

ইশরাত ওয়ারা
ডেস্ক রিপোর্টার
৭০ বছর আগেও চীনের এই সমুদ্রপথে প্রতিদিন ভেসে থাকত অসংখ্য মানুষের নিথর দেহ। তারা মরিয়া হয়ে মূল ভূখণ্ড চীন থেকে হংকংয়ের পথে রওনা দিত, একটি ভালো জীবনের আশায়। সেই সময় চীনে মানুষের পেটে দুবেলা খাবার জুটত না, শিক্ষা ছিল একপ্রকার অপরাধ। স্কুলে যেতে হলে বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হতো। বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছিল সাধারণ মানুষ। কমিউনিজমের কৃত্রিম পরীক্ষাগারে চীন তখন ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে এগোচ্ছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকেই এক সময় এমন এক রূপান্তর ঘটে যে মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে চীন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়।
নেপোলিয়ন এক সময় বলেছিলেন, চীন একটি ঘুমন্ত দৈত্য। যেদিন সে জেগে উঠবে, গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠবে। কথাটি আজ সত্য বলে মনে হয়। ভাবুন একবার, যে দেশের জিডিপি এক সময় তানজানিয়া কিংবা কেনিয়ার চেয়েও কম ছিল, সেই দেশের অর্থনীতি আজ ১৮ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আজকের সাংহাই, চংকিং বা শেনজেনের মতো শহরগুলো উন্নয়ন ও আধুনিকতার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ইউরোপকেও পেছনে ফেলছে। ধারণা করা হয়, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকেও অতিক্রম করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কীভাবে?
কীভাবে চীন এত দ্রুত, এত ব্যাপকভাবে ধনী হয়ে উঠল? চীনের এই জাদুকরী রূপান্তরের পেছনের রহস্য কী? আমাদের দেশে এমন পরিবর্তন কেন ঘটল না? এমনকি জাপানের মতো কর্মঠ জাতিও কেন এই গতিতে অগ্রসর হতে পারেনি? নিশ্চয়ই চীনের হাতে কোনো জাদুর কাঠি ছিল না। এর পেছনে ছিল দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, বাস্তবসম্মত ভিশন এবং জাতীয় স্বপ্ন।
১৯৩৭ সালে জাপান চীনের উপর আক্রমণ করে। মাত্র একদিনে দুই লক্ষাধিক চীনা নারী জাপানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন, নিহত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যাতে চীনের প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। যুদ্ধ শেষে যখন জাপান পরাজিত হয়, তখন চীনে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দীর্ঘ যুদ্ধের ধাক্কায় চীনের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্টরা বিজয়ী হয় এবং মেইনল্যান্ড চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট শাসন। কিন্তু যেই আশায় মানুষ কমিউনিস্টদের সমর্থন করেছিল, সেটিই পরে পরিণত হয় এক দুঃস্বপ্নে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও জেদং-এর আদর্শ ও নীতিমালা দেশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অথচ এই চীনই এক সময় ছিল বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র। প্রাচীন চীনের সম্পদ ও জ্ঞান এতই বিস্ময়কর ছিল যে, ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায়ও সে সময় চীন ছিল ধনী। বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ আসত চীন থেকে।
চীনের রেশম ছিল বিশ্ববিখ্যাত। সিল্ক রোডের মাধ্যমে তারা পৃথিবীর নানা প্রান্তের সঙ্গে বাণিজ্য চালাত। বিশ্বের প্রথম কম্পাস, বারুদ, কাগজ ও ছাপাখানার উদ্ভাবন হয়েছিল এই চীনেই। সামরিক শক্তিতেও চীন ছিল বলিষ্ঠ, যার সাক্ষ্য আজও বহন করছে দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না। কৃষি ও চিকিৎসাশাস্ত্রেও তারা ছিল অগ্রগামী। চীনের উর্বর মাটিতে কখনো খাদ্যের ঘাটতি পড়েনি। তারাই প্রথম আকুপাংচার ও হারবাল মেডিসিন আবিষ্কার করে, যা আজও সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এত সমৃদ্ধ, উদ্ভাবনী ও জ্ঞাননির্ভর এক দেশ কীভাবে একসময় চরম দারিদ্র্য ও হতাশার গভীরে তলিয়ে গেল? ইতিহাসের এই প্রশ্নের উত্তরই বোধহয় আমাদের আজ নতুন করে ভাবতে শেখায় যে একটি জাতি কেবল সম্পদে নয়, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সঠিক দিকনির্দেশনায়ই পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে।
শুধু কি জাপানের আগ্রাসন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চীনকে ধ্বংস করেছিল? না, এর পেছনে ছিল আরও গভীর ইতিহাস, যার শিকড় অনেক পুরোনো এবং যেখানে পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তির কূটচালও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
সময়টা ১৭৭৩ সাল। তখন চীনে চিং রাজবংশের শাসন চলছে। এদিকে ভারতে ইতিমধ্যে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়েছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে যেমন ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছিল, তেমনি তারা চীনের বাজারেও প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু চীনের সম্রাট ইংরেজদের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে নানা রাজনৈতিক চাপের পর সীমিত পরিসরে তাদের ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়। ইংরেজরা চীন থেকে বিপুল পরিমাণে চা আমদানি শুরু করে, কিন্তু বিনিময়ে তারা চীনকে দিতে শুরু করে আফিম, এক ভয়াবহ নেশাদ্রব্য।
চীনের সভ্যতা ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল এই আফিম দিয়ে। ভারতে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বিশাল পরিসরে আফিম চাষ করত এবং সেই আফিম চীনে রপ্তানি করত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চীনের তরুণ প্রজন্ম আফিমের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। পরিশ্রমী মানুষগুলো কাজ বন্ধ করে সারাদিন নেশায় ডুবে থাকত। উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
চীনের শাসকরা এই অবস্থা দেখে দেশে আফিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু ইংরেজরা তা উপেক্ষা করে গোপনে বিক্রি চালিয়ে যায়, কারণ এই ব্যবসায় তারা প্রচুর লাভ করছিল। এক পর্যায়ে চীনের প্রশাসন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের আফিমের গুদামঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ১৮৩৯ সালে শুরু হয় প্রথম আফিম যুদ্ধ।
যুদ্ধটি টানা চার বছর ধরে চলে এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা জয়লাভ করে। তারা হংকং দখল করে নেয়, চীনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও বিশাল অংশের ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়। এখান থেকেই শুরু হয় চীনের “শতবর্ষের অপমান” বা সেঞ্চুরি অব হিউমিলিয়েশন।
যখন পশ্চিমা বিশ্বে শিল্পবিপ্লবের জোয়ার বইছে, তখন চীনের উচিত ছিল বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তার করা। কিন্তু আফিম যুদ্ধের পর চীনের শাসকরা ভয় ও সন্দেহে নিজেদের চারপাশে দেয়াল তুলে দেয়। তারা বিদেশি বাণিজ্য নিষিদ্ধ করে এবং নিজেদের অর্থনীতি বন্ধ করে ফেলে। এর ফলে তারা দ্রুত আধুনিকায়নের স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
পরবর্তী একশ বছর ধরে চীন ক্রমাগত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। কখনো রাশিয়া, কখনো জাপান, আবার কখনো যুক্তরাষ্ট্র চীনের ভূখণ্ডে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। এইসব যুদ্ধ এবং বিদেশি আগ্রাসনের ফলে চীনের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
অবশেষে আসে ১৯৪৯ সাল। দীর্ঘ যুদ্ধ, আফিম বাণিজ্য, জাপানের দখল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পর চীনের সামনে আবার একবার পুনরুত্থানের সুযোগ আসে। মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে, মনে হয় নতুন এক যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই আশার মুহূর্তেই ক্ষমতায় আসেন এমন একজন নেতা, যার সিদ্ধান্ত চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনে। তিনি ছিলেন চীনের রাষ্ট্রপতি মাও জেদং।
মাও জেদং চীনের অর্থনীতিকে দ্রুত উন্নতির পথে নিতে কিছু নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করেন। এর মধ্যে ছিল গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড এবং কালচারাল রেভলিউশন। বড় জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করে তিনি ছোট চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেন, কিন্তু জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতেই রাখেন। সরকার নির্ধারণ করত কখন চাষ হবে, কী চাষ হবে এবং কতটা উৎপাদন হবে। কৃষকদের কাজ ছিল শুধু শ্রম দেওয়া। উৎপাদিত ফসলের সবটাই দিতে হতো সরকারের কাছে এবং বিনিময়ে তারা পেত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ।
এই নীতি খুব দ্রুত ব্যর্থ হয়। কৃষকদের কোনো স্বাধীনতা ছিল না, প্রযুক্তি ছিল পুরোনো এবং উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত কমতে থাকে। তারা কঠোর পরিশ্রম করেও দুবেলা আহার জুটাতে পারত না। এরই মধ্যে মাও আরেকটি নীতি চালু করেন, যার নাম ছিল ফোর পেস্ট কন্ট্রোল। তিনি চীনের সব চড়ুই, ইঁদুর, মশা ও মাছি নির্মূল করার আদেশ দেন। মাও তখন চীনে প্রায় ঈশ্বরসম মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাই জনগণ তার নির্দেশ অন্ধভাবে পালন করে। কয়েক বছরের মধ্যে চীনে লক্ষ লক্ষ চড়ুই পাখি মারা পড়ে, ফলে পঙ্গপালের সংখ্যা বেড়ে যায় এবং তারা ফসলে হানা দেয়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে দেশে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যেখানে প্রায় চার কোটি মানুষ প্রাণ হারায়।
মাও শিল্পায়নের দিকেও জোর দেন। গোটা দেশে স্টিল উৎপাদনের লক্ষ্যে বড় বড় ফ্যাক্টরি গড়ে তোলা হয়, এমনকি সাধারণ মানুষকেও ঘরে স্টিল তৈরি করতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও দক্ষতার অভাবে সেই স্টিলের গুণমান ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের, ফলে এই পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়।
১৯৬০-এর দশকে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নেমে আসে ঋণাত্মক চার শতাংশে। দেশে বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং খাদ্যসংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সাধারণ মানুষ মাওয়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করে। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টির অনেক শীর্ষ নেতা তার নীতির সমালোচনা করেন।
চীনের এই দীর্ঘ পতনের ইতিহাস দেখায়, একটি দেশ কেবল দেশপ্রেম বা শ্রম দিয়ে টিকে থাকতে পারে না। সঠিক নেতৃত্ব, বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা এবং স্বাধীন চিন্তাশক্তিই পারে একটি জাতিকে পুনর্জন্ম দিতে।
হীরক রাজা একবার বলেছিলেন, “পড়াশোনা করে যে, অনাহারে মরে সে।” মাও জেদংও প্রায় একই বিশ্বাস পোষণ করতেন। তিনি মনে করতেন, শিক্ষিত ও চিন্তাশীল মানুষরা বা বুদ্ধিজীবীরা তার শাসনের জন্য হুমকি। তাই তিনি তাদের দমন করার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৬৬ সালে চীনে শুরু হয় কালচারাল রেভলিউশন। মাও ঘোষণা দেন, চীনে নতুন এক বিপ্লব ঘটবে যেখানে পুরনো প্রথা, ধর্ম, জ্ঞান ও সংস্কৃতির স্থান থাকবে না। তখন দেশের সমস্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শহরের শিক্ষিত মানুষদের জোর করে গ্রামে পাঠানো হয় যাতে তারা মাঠে কাজ করে কৃষকদের কাছ থেকে শেখে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করা হয়। কেউ যদি পড়াশোনা করতে চাইত, তবে তাকে কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিতে হতো।
এই নীতির উদ্দেশ্য ছিল একটাই। যে কেউ মাও-এর চিন্তার বিপরীতে কথা বলবে, তাকে রাষ্ট্রবিরোধী ঘোষণা করা হবে। সেই সময় শিক্ষিত মানুষদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। সমাজে ভয়, অরাজকতা ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০-এর দশকে এসে চীনের প্রায় আশি শতাংশ মানুষ কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শিল্প ও বাণিজ্য কার্যত থেমে যায়। দেশের অর্থনীতি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে তখন চীনের রাস্তায় মোটরগাড়ি প্রায় দেখা যেত না। যার কাছে একটি সাইকেল ছিল, তাকেই ধনী মনে করা হতো।
মানুষ তখন চরম দারিদ্র্য ও হতাশার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিল। তাদের জীবনে কোনো স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। অন্যদিকে, পাশেই ছিল হংকং, যা তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। হংকং-এ জীবনযাত্রা ছিল বহু গুণ উন্নত। সেখানে কাজের সুযোগ বেশি ছিল, বেতন অনেক বেশি ছিল এবং মানুষ অন্তত দুবেলা খেতে পারত। তাই হংকং চীনের মানুষের কাছে এক স্বপ্নরাজ্য হয়ে ওঠে।
এই সময় সেনজেন প্রদেশের প্রায় সাত লাখ মানুষ সমুদ্র পেরিয়ে হংকং যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র এক লাখ চল্লিশ হাজার মানুষ পৌঁছাতে পারে। কেউ কেউ ফিরে আসে, আর বাকিদের অনেকেই সমুদ্রের ঢেউয়ে প্রাণ হারায়। সেই উপকূল আজও পরিচিত “কোভ অফ কর্পস” নামে, যার অর্থ মৃতদেহের উপসাগর।
এই সময় কেউ ভাবতেও পারত না যে চীন কখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তখন চীনের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মাঠে কাজ করছিলেন এক খাটো মানুষ, যার উচ্চতা ছিল মাত্র পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি। তার নাম দেং জিয়াওপিং। কেউ তখন জানত না যে এই মানুষটিই একদিন চীনকে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশে পরিণত করবেন।
দেং জিয়াওপিং একসময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। কিন্তু মাও জেদং-এর সমালোচনা করার কারণে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং রাজধানী বেইজিং থেকে দূরে এক গ্রামে নির্বাসিত করা হয়। সেখানে তিনি তিন বছর কৃষিকাজ করেন।
১৯৭৬ সালে মাও জেদং-এর মৃত্যুর পর দেং জিয়াওপিং-এর ভাগ্য পরিবর্তন হয়। তার সমর্থকেরা তাকে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনে। তখন চীনের মানুষের একটাই লক্ষ্য ছিল, কীভাবে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যায়।
দেং জিয়াওপিং-এর আদর্শ ছিল মাও-এর চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাও চেয়েছিলেন জনগণ তাকে ঈশ্বরের মতো মানুক এবং তার প্রতিটি কথা যেন চূড়ান্ত সত্য বলে গণ্য হয়। তিনি বিপ্লব ও কঠোর নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু দেং ছিলেন বাস্তববাদী এবং প্রগতিশীল। তিনি কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু তিনি মনে করতেন উন্নতি ও সমৃদ্ধিই একটি দেশের আসল লক্ষ্য।
মাও-এর মৃত্যুর পর দেং-এর সামনে বড় বাধা ছিল সেই সব নেতারা, যারা এখনও মাও-এর পুরনো আদর্শে বিশ্বাস করতেন। একই সময়ে মাও-এর স্ত্রী জিয়াং ছিং ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন এবং গ্রেফতার হন।
দেং জিয়াওপিং কখনো চীনের রাষ্ট্রপতি বা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান হননি, তবুও তিনি হয়ে ওঠেন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, চীনের উন্নতির জন্য শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
১৯৭৭ সালে তিনি বেইজিংয়ে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আহ্বান করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পার্টির রক্ষণশীল নেতারা, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলার বিরোধিতা করছিলেন। তখন দেং জিয়াওপিং একটি ঐতিহাসিক কথা বলেন যা চীনের ভবিষ্যৎ বদলে দেয়। তিনি বলেন, “বিড়াল সাদা না কালো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যতক্ষণ না সে ইঁদুর ধরতে পারে।” অর্থাৎ দেশের উন্নতির জন্য কোনো নীতি কার্যকর হলে সেটা কে তৈরি করেছে বা কোন মতবাদ থেকে এসেছে তা বিবেচ্য নয়। মূল কথা হলো, তা কাজ করছে কি না।
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই তিনি স্পষ্ট করে দেন যে বাস্তবতা-নির্ভর নীতি গ্রহণই হবে চীনের অগ্রগতির মূলমন্ত্র। তিনি মাও-এর সময় বন্ধ করে দেওয়া স্কুল ও কলেজগুলো পুনরায় খুলে দেন। আবার শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষা।
১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে বড় পরিসরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ থেকে ৩৮ বছর বয়সী প্রায় ৫৭ লক্ষ মানুষ এই পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশ পাস করতে সক্ষম হয়। কিন্তু এই পরীক্ষাই ছিল চীনের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ। এখান থেকেই শুরু হয় নতুন চীনের পুনর্জাগরণের ইতিহাস।
চীনের অর্থনীতিকে নতুন পথে নেওয়ার পরবর্তী ধাপে দেং জিয়াওপিং তিরিশ জনের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করেন। দলটি ডেনমার্ক, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা দেশে পাঠানো হয়। সেখানে পৌঁছে তারা প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, উৎপাদনশীলতা ও সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইউরোপের ব্যাপক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করে বিস্মিত হয়। দেশে তাদের দীর্ঘদিন বলা হয়েছিল যে পুঁজিবাদ শ্রমিকশ্রেণিকে শোষণ করে এবং সমাজকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু বাস্তব পর্যবেক্ষণে তারা দেখতে পায় ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো কার্যকর নীতি, উচ্চ দক্ষতা ও আধুনিক অবকাঠামোর মাধ্যমে বহুগুণ এগিয়ে গেছে।
চীনা প্রতিনিধি দল ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা করে উন্নয়নের পথরেখা নিয়ে ধারণা নেয়। ইউরোপীয় দেশগুলোও চীনকে সহায়তায় আগ্রহ দেখায়, কারণ বিশাল বাজার হিসাবে চীন তাদের জন্য সম্ভাবনাময় ছিল। এ সময় দেং জিয়াওপিং নিজেও সিঙ্গাপুর ও জাপান সফর করেন। জাপানে তিনি ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটার গতির ট্রেন, রোবোটিক্স ও ইলেকট্রনিক্স শিল্পের আধুনিকতা, এবং নাগরিক জীবনের উচ্চমান দেখে অভিভূত হন। সিঙ্গাপুর ও জাপানের রাস্তা, কারখানা, বসতবাড়ি এবং জীবনযাত্রা তিনি ভিডিও করে দেশে এনে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। জাপানে সাধারণ শ্রমিকের ঘরেও টেলিভিশন ও ফ্রিজ আছে, উন্নত কৃষিযন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, এইসব দৃশ্য দেখে চীনের মানুষ নতুন করে আশা পেতে শুরু করে। দেং বুঝতেন যে দীর্ঘদিনের ভুল নীতিতে মানুষ স্বপ্ন দেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। তাই জাতির মনে আশাবাদ সঞ্চার করা ছিল তার প্রথম লক্ষ্য।
তবে ভেতরে ভেতরে অনেকে পরিবর্তন মানতে রাজি ছিলেন না। তাদের ধারণা ছিল, ইউরোপ বা জাপানের মতো উন্নয়ন মডেল গ্রহণ করলে বিপ্লবী আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির দুই শতাধিক সদস্যকে বেইজিংয়ে ডাকা হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দেং জিয়াওপিং। সেখানেই প্রথম তিনি অর্থনীতি উন্মুক্ত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। আফিম যুদ্ধের পর থেকে চীন কার্যত বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সীমিত করে রেখেছিল। দেং বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রসর না হলে সমৃদ্ধি সম্ভব নয়।
দেং ভালোভাবেই বুঝতেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রকে অংশীদার বানানো জরুরি। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রও চীনকে সোভিয়েত প্রভাববলয় থেকে দূরে টানতে আগ্রহী ছিল। ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পিপলস রিপাবলিক অব চায়নাকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। সে বছরই দেং ওয়াশিংটনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে বৈঠক করেন। শীতল যুদ্ধের দ্বিপাক্ষিক সন্দেহ সত্ত্বেও এই কূটনৈতিক অগ্রগতি ছিল ঐতিহাসিক।
আমেরিকা সফর শেষে দেং চীনের দক্ষিণে যান। হংকংয়ের লাগোয়া মৃতপ্রায় শিল্পকেন্দ্র গুয়াংজৌ ও তার আশপাশে তিনি পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা হাতে নেন। সেখানে তার ঘনিষ্ঠ চিন্তাধারার নেতা শি ঝোংসুনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেন। সরকার তহবিল দিতে পারবে না, তবে নীতিগত বাধা কমিয়ে উদ্যোগপতিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। হংকংয়ের নিকটবর্তী শহর শেনজেনকে বেছে নেওয়া হয় অগ্রাধিকারে। হংকংয়ে তৎকালীন নির্মাণ জোয়ারে স্টিলের চাহিদা আকাশছোঁয়া ছিল, কিন্তু উচ্চ মজুরি ও অবকাঠামো ব্যয়ের কারণে সেখানেই উৎপাদন লাভজনক ছিল না। শেনজেনে তুলনামূলক কম মজুরি এবং অতি স্বল্প দূরত্বের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় উদ্যোগীরা হংকংয়ের বিনিয়োগ আনেন, জাহাজ ভাঙা থেকে প্রাপ্ত স্ক্র্যাপ দিয়ে স্টিল উৎপাদন শুরু করেন এবং তা সমুদ্রপথে দ্রুত হংকংয়ে পাঠান। এটাই ছিল চীনে বিদেশি বিনিয়োগের প্রথম সার্থক গল্প।
এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শেনজেনে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। পরে মডেলটি অন্যান্য উপকূলীয় এলাকায় প্রসারিত করা হয়। করছাড়, শুল্কসহ নানা প্রণোদনায় বিদেশি পুঁজি প্রবাহ বাড়তে থাকে। ঝেজিয়াং প্রদেশের ওয়েনঝৌতে তুলনামূলক কম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থাকায় কয়েক বছরের মধ্যেই লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ গড়ে ওঠে। ১৯৭৯ সালে সরকার এসব বেসরকারি উদ্যোগকে আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন দিতে শুরু করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দেং সমষ্টিগত মতামত ও দায়িত্ববোধের নীতি চালু করেন। বড় সিদ্ধান্ত আগে আলাপ করতে হবে এবং ভুল হলে যৌথভাবে দায় নিতে হবে।
শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। মাওয়ের আমলে যেখানে স্কুলে পড়তে গেলেও পার্টির অনুমতি লাগত, সেখানে দেং উচ্চশিক্ষার দরজা খুলে দেন এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা পুনরায় চালু করেন। একই সঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে পুনর্গঠন করা হয়। নয় বছর মেয়াদি বাধ্যতামূলক ও বিনামূল্যের মৌলিক শিক্ষা চালু হয়। পরে ধাপে ধাপে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষার্থী পাঠানো শুরু হয়। অনেকে স্থায়ীভাবে না ফিরলেও দেং-এর বাস্তববাদী যুক্তি ছিল, দশজনের মধ্যে যদি একজনও ফিরে আসে, দেশের লাভই হবে। ধীরে ধীরে বিদেশফেরত তরুণরা দেশে উদ্যোগ গড়ে তোলে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নতুন গতি আনে।
১৯৯০–এর দশকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বড় বড় ব্র্যান্ড যখন উৎপাদন সম্প্রসারণের জায়গা খুঁজছিল, চীন তাদের আমন্ত্রণ জানায়। কম মজুরি, বিস্তৃত জমি, দক্ষ শ্রমশক্তি এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সুবিধা একত্রে বিদেশি কারখানা স্থাপনে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি শেখা, সরবরাহ শৃঙ্খলা গঠন এবং মান নিয়ন্ত্রণে চীন দ্রুত দক্ষ হয়ে ওঠে। স্থানীয় উদ্যোগীরাও একই শিল্পশৃঙ্খলে যুক্ত হয়ে ক্রমে নিজস্ব ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে থাকে।
ক্রমশ চীন বিশ্ব উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়। গবেষণা ও উন্নয়নে বড় বাজেট বরাদ্দ, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পের সংযোগ, এবং অবকাঠামোতে অভূতপূর্ব বিনিয়োগের ফলে উচ্চগতির রেল, উন্নত ইলেকট্রনিক্স, ড্রোন ও রোবোটিক্সসহ বহু ক্ষেত্রে তারা আত্মনির্ভরতা অর্জন করে। প্রাথমিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে স্মার্টফোন তৈরির বাজার অংশীদারিত্ব পর্যন্ত বহু খাতে চীনের প্রভাব সুদৃঢ় হয়।
সমান্তরালে দারিদ্র্য হ্রাসে তারা ব্যতিক্রমী সাফল্য দেখায়। কৃষি সংস্কার, কর্মসংস্থানমুখী শিল্পায়ন, নগরায়ন এবং সামাজিক খাতে ধারাবাহিক বিনিয়োগ মিলিয়ে কয়েক দশকে শত কোটি মানুষের জীবনমান উন্নত হয়। শিক্ষা খাতে ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। বাধ্যতামূলক শিক্ষার আওতা বিস্তৃত হয় এবং তরুণদের সাক্ষরতার হার প্রায় সার্বজনীন পর্যায়ে পৌঁছে।
উচ্চগতির রেলের উদাহরণটি দেং-এর স্বপ্ন পূরণের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৮ সালে তিনি জাপানে যে বুলেট ট্রেন দেখেছিলেন, ২০০৮ সালে চীন নিজের মাটিতে উচ্চগতির ট্রেন চালু করে। পরবর্তী দশকে প্রযুক্তি আয়ত্ত করে নিজেরাই নেটওয়ার্ক প্রসারিত করে। আজ দেশের ভেতরে হাজার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ উচ্চগতির রেলপথ জাতীয় সংযোগ ও উৎপাদনশীলতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে দেং জিয়াওপিং-এর পদক্ষেপগুলোর সারকথা ছিল বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেওয়া, উন্মুক্ততার দিকে অগ্রসর হওয়া, শিক্ষা ও দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং নীতিনির্ধারণে সমষ্টিগত জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা। এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়েই চীন কয়েক দশকে এক অনুন্নত অর্থনীতি থেকে একটি জটিল, প্রযুক্তিনির্ভর ও বিশ্বব্যাপী প্রভাবশালী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
১৯৩২ সালে জন্ম, ২০০৬ সালে যুবক: টাইম ট্র্যাভেলার 'সার্গেই' এর রহস্য!
ভূমিকা: সময় পরিভ্রমণ বা টাইম ট্র্যাভেল – কল্পবিজ্ঞানের এই ধারণা বহু বছর ধরে মানুষকে মুগ্ধ করে রেখেছে। কিন্তু যদি বলি, এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল? ২০০৬ সালে ইউক্রেনের কিয়েভের রাস্তায় আবির্ভূত হয়েছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ১৯৩২ সালে জন্মেছিলেন কিন্তু ২০০৬ সালেও ছিলেন যুবক। তার গল্প এতটাই রহস্যময় যে, তিনি কি সত্যিই সময়কে টপকে ভবিষ্যতে এসেছিলেন, নাকি এটি নিছকই এক মিথ? সেই অবিশ্বস্য ঘটনাটি নিয়ে এই প্রতিবেদন।
২০০৬ সালে 'অতীত' থেকে আগমন: ২০০৬ সালে ইউক্রেনের কিয়েভের রাস্তায় পথচারীরা এক অদ্ভুত লোককে দেখতে পায়। তার পরনে ছিল পুরোনো ফ্যাশনের পোশাক, দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন কাউকে খুঁজছেন, কিন্তু কিছুই চিনতে পারছেন না। এই লোকটির নাম ছিল সার্গেই পনমারেনকো। ভীত সার্গেই পুলিশের কাছে পৌঁছান, কারণ তিনি কোনো রাস্তাঘাট চিনতে পারছিলেন না। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী এই যুবকের পরনে ছিল নতুন কিন্তু পুরোনো ধরনের পোশাক এবং গলায় ছিল বহু পুরোনো মডেলের একটি ক্যামেরা।
পরিচয়পত্র ও বিস্ময়কর তথ্য: সার্গেই পুলিশকে জানান যে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বাসিন্দা এবং তার জন্ম ১৯৩২ সালে। তার দেখানো পরিচয়পত্রটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলের, যা দেখে সবার চক্ষু চড়কগাছ! একটি সময়ে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হলেও, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে প্রায় দুই দশক আগে। পুলিশ যখন তাকে জিজ্ঞেস করে, সে শেষ কোন দিনের কথা মনে করতে পারছে, সার্গেই জানায় যে তিনি সর্বশেষ ১৯৫৮ সালের ২৩ এপ্রিলের কথা মনে করতে পারছেন। অর্থাৎ, তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে ২০০৬ সালে এসেছেন, অথচ তার বয়স একটুও বাড়েনি।
ডাক্তারের কাছে বিস্ময়: সার্গেইকে একটি সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ডাক্তার পাবলো কুট্রিকফ তাকে জিজ্ঞেস করেন যে তিনি কীভাবে ১৯৫৮ সাল থেকে ২০০৬ সালে চলে এলেন, অথচ একটুও বৃদ্ধ হলেন না। তার সর্বশেষ কি মনে আছে? সার্গেই উত্তর দেন যে সেদিন তিনি দিনের বেলায় ঘুরতে বেরিয়েছিলেন এবং ছবি তোলার জন্য ক্যামেরাও সাথে নিয়েছিলেন। হঠাৎ তিনি 'বেল শেপের' একটি উড়ন্ত বস্তু দেখতে পান এবং এরপর তার আর কিছুই মনে নেই। তিনি ডাক্তারকে তার ক্যামেরা বাড়িয়ে দিলেন তার তোলা ছবিগুলো দেখার জন্য।
ক্যামেরার রহস্য ও উধাও হয়ে যাওয়া: ক্যামেরাটি ছিল একটি ইয়াসিমা ফ্লেক্স, যার ফিল্ম ১৯৭০ সালের পর থেকে আর তৈরি হয়নি। ফটোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ ভ্যাডিম পয়জনার জানান, ক্যামেরার ফিল্মটি ১৯৫৬ সালে তৈরি করা হয়েছে। ছবিগুলো উদ্ধারের পর দেখা গেল, ছবির রাস্তাঘাট, বিল্ডিং, স্থাপনা সবই পুরোনো ধাঁচের। ছবিগুলোর অনেক বিল্ডিং এখন আর নেই। সার্গেইয়ের সাথে একজন মেয়ের ছবিও দেখা গেল, জানা যায় মেয়েটি তার গার্লফ্রেন্ড। সবচেয়ে রহস্যময় শেষ ছবিতে সার্গেইয়ের কথা মতো একটি 'বেল শেপের' ইউএফও (UFO) বা স্পেসক্রাফট দেখা যায়। সার্গেই জানান, "যখনই আমি বস্তুটির ছবি এবং ক্যামেরার দিকে তাকাই, জানিনা আমি কিভাবে এই সময় চলে আসলাম।"
ডাক্তার পাবলো কুট্রিকফ আইনস্টাইনের থিওরি অনুযায়ী 'টাইম ডাইলেশন' ছাড়া এমনটা কিভাবে সম্ভব তা ভাবতে লাগলেন। সেই রাতেই শেষ দেখা যায় সার্গেই পনমারেনকোকে নিজ রুমের দিকে যেতে। এরপর দিনই তিনি যেন পুরোপুরি গায়েব হয়ে যান।
গার্লফ্রেন্ডের চিঠি ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত: এদিকে পুলিশ সার্গেইয়ের তৎকালীন গার্লফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করে। ৭০ বছর বয়সী সেই নারী জানান, সার্গেই নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে একটি ছবি পাঠান, যেখানে মধ্যবয়স্ক সার্গেইয়ের ছবি ছিল এবং তার পেছনে ছিল উঁচু দালান। ছবিতে লেখা ছিল, এটি ২০৫০ সালে তোলা!
উপসংহার: কীভাবে সার্গেই পনমারেনকো ১৯৫৮ সাল থেকে হঠাৎ করে ২০০৬ সালে চলে এলেন, তা আজও এক অমীমাংসিত রহস্য। রাশিয়ান একটি ডকুমেন্টারিতে এই পুরো ঘটনাটি তুলে ধরা হলেও এর কোনো অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইন্টারনেটে এই ঘটনার উপর অসংখ্য ভিডিও থাকলেও শত প্রমাণের অভাবে অনেকে এটিকে মিথ বা প্রচলিত ঘটনা বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তবে টাইম ট্র্যাভেলের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি জনপ্রিয় ও চমৎকার ঘটনা, যা আজও মানুষের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে: সার্গেই কি সত্যিই সময়ের বাঁধন পেরিয়ে গিয়েছিলেন?
পাঠকের মতামত:
- এনসিপির মনোনয়ন নিলেন সারজিস,একই আসনে বিএনপি-এনসিপি দুই হেভিওয়েট প্রার্থী
- সোমবার সকাল ১১টায় হাসিনার রায়: দেশজুড়ে কড়া নিরাপত্তা
- ইতিহাসের কুচক্রী নারী: ঘষেটি বেগম, যার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ডেকে এনেছিল বাংলার পতন
- জামায়াতে ইসলামী: অতীতের ছায়া ছাপিয়ে কি নতুন শুরু সম্ভব?
- ককটেল বিস্ফোরণে কাঁপল কারওয়ান বাজার
- রাজনীতিকে বিদায় জানালেন শমসের মবিন চৌধুরী
- সাভারে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি বাসে আগুন
- কোমল পানীয় থেকে মাছের ডিম, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় যে ৯ খাবার
- মহাসড়কে ভয়াবহ দুর্ঘটনা: সীতাকুণ্ডে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে শিশুসহ ৫ মৃত্যু
- ভোটার তালিকায় নাম নেই তারেকের, নির্বাচনে লড়তে পারবেন কীভাবে?
- ডলারের রিজার্ভে সুখবর, নভেম্বরের শুরুতেই বিপুল সাড়া
- পুলিশ প্রশাসনে ‘বড় নাড়া’: ডিআইজি-এসপিসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের রদবদল
- ইসরায়েলের গোপন ফাঁদেই উল্টো ধরা, ইরানের যে কৌশলে বোকা বনেছিল ইসরায়েল
- হাসারাঙ্গাকে ছেড়ে রিশাদের দিকে নজর? আইপিএল নিলামে টাইগারদের চাহিদা
- প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে মামলা, আদালতে আত্মসমর্পণ করলেন মেহজাবীন
- বয়স বাড়লেও তারুণ্য থাকবে অটুট, যদি পাতে থাকে এই শীতের সবজি!
- অতীতে ইসি সরকারের ‘মন্ত্রী’ ছিল: কাদের সিদ্দিকীর কড়া সমালোচনা
- জেন-জি বিক্ষোভে উত্তাল আরেক দেশ, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে হামলার চেষ্টা
- দেশের পরিস্থিতি খুব ভালো নয়, খারাপও নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- আমার প্রতি এত রাগ বা হিংসা কেন? সব অভিযোগ খণ্ডন করলেন নিগার সুলতানা
- বিদেশি কর্মী নিয়োগে 'ইউ-টার্ন' সৌদির,কমছে বেতন ও সুবিধা
- ২০২৬ সালের ব্যাংক ছুটির তালিকা প্রকাশ করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ডেঙ্গু বা ভাইরাসের পর দুর্বলতা? প্লেটলেট বাড়বে যা খেলে
- সাগর যেখানে সমাধিক্ষেত্র: ভূমধ্যসাগরে আবারও ডুবল স্বপ্নের নৌকা
- অতীতে কেউ হাত দেয়নি, প্রবাসীদের ভোট নিয়ে যা বললেন সিইসি
- অভিনেত্রী মেহজাবীন ও তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
- গণভোটের আইনি ভিত্তি নেই: রিজভী
- ১৬ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনের সারসংক্ষেপ
- ১৬ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ লুজার তালিকা প্রকাশ
- ১৬ নভেম্বর ডিএসই লেনদেনে শীর্ষ গেইনার তালিকা প্রকাশ
- হাসিনার রায় নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে: মির্জা ফখরুল
- ইসির সংলাপে নাটক: ঐক্যজোটের এক অংশকে বের করে দিল আরেক পক্ষ
- গাজা–ইরান ইস্যুতে রহস্যময় ফোনালাপ নেতানিয়াহুর সঙ্গে পুতিনের
- শেখ হাসিনাদের রায় সরাসরি দেখতে পাবেন যেভাবে
- ২৪টি বন্ডে লেনদেনহীন দিন: কেন স্থবির বাংলাদেশের ডেট মার্কেট
- তারল্য সংকটে চাপ বাড়ছে DSE–৩০ সূচকে
- ২০১৮ নির্বাচনের গোপন নীলনকশা: ‘কপোতাক্ষ কক্ষে’ কী ঘটেছিল
- ৩১ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য সপ্তাহে পাঁচ দিন পুষ্টিকর খাবার
- নির্বাচনের আগে সংলাপ ম্যারাথন- সকালে ৬ দল, বিকেলে আরও ৬ দল
- শীতে ত্বক বাঁচানোর কার্যকর উপায়
- শীতে ঘরোয়া উপায়ে চুলের পূর্ণাঙ্গ যত্ন
- রাহিমা ফুডসের প্রান্তিক ফলাফল যেমন
- সায়হাম টেক্সটাইল এর প্রথম প্রান্তিক প্রকাশ
- উপকরণ সংকটে নাভানা সিএনজি-এর মুনাফায় ধাক্কা
- নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের দুর্দান্ত Q1
- ১,৪৪৪ টন সোনার সবচেয়ে বড় স্বর্ণভান্ডার আবিষ্কার
- “আমার ভাই মেয়র হবে না, ভাগিনা চেয়ারম্যান নয়”
- বিএনপির মনোনয়ন সংকট ও আসন–সমঝোতা
- ১৬ নভেম্বর সকালে ঢাকার বাতাসের মান নেমে গেল বিপজ্জনক পর্যায়ে
- রাজধানীতে আজ রাজনৈতিক কর্মসূচির ছড়াছড়ি, জেনে নিন বিস্তারিত
- সিলেট টেস্টে আয়ারল্যান্ড অলআউট ২৮৬ রানে, দুর্দান্ত সূচনায় বাংলাদেশ
- গোলের রাজা কে, মেসি না রোনালদো? সংখ্যার হিসাবে কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে!
- কোরিয়ান ড্রামায় মুগ্ধ বিশ্ব: মিস্ট্রি থ্রিলার থেকে টাইম ট্রাভেল, দেখুন সেরা ১০ সিরিজ!
- সাদমানের পর মুমিনুলকে নিয়ে জয়ী রথ বাংলাদেশের ওপেনিংয়ে রেকর্ড জুটি
- মামলার রেশ না কাটতেই তিশার বিরুদ্ধে প্রাণনাশের অভিযোগ
- বাংলাদেশ নেপাল ম্যাচের আগে জেনে নিন হেড টু হেড পরিসংখ্যানে কারা চালকের আসনে
- নেপালের বিপক্ষে দুর্দান্ত হামজা জোড়া গোলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল বাংলাদেশ
- আজকের খেলাধুলা সূচি
- আজ বিশ্ব ব্যাচেলর দিবস: একাকীত্ব নয়, স্বাধীনতার উৎসব
- ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধরনের পতন: ৩৮৪ কোম্পানির মধ্যে মাত্র ১৫টি বেড়েছে
- আজ রাজধানীতে রাজনৈতিক যেসব কর্মসূচি, কোথায় কী হচ্ছে জেনে নিন
- লকডাউনের দিনেও দোকান-শপিংমল খোলা থাকবে: মালিক সমিতি
- রোনালদোর শেষ খেলার পরিকল্পনা নিয়ে বড় ঘোষণা
- কাদিয়ানী ইস্যু ও পাকিস্তানি সংযোগ: বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক অস্থিরতার ইঙ্গিত
- মুশফিক-তামিমদের ক্লাবে ঢোকার অপেক্ষায় লিটন দাস আজই কি গড়বেন রেকর্ড








