সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদাপাথর লুটপাটের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ও সুবিধাভোগী ৫২ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত প্রতিবেদনে। এই তালিকায় বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপি-এর নেতাদের পাশাপাশি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর নামও রয়েছে।
দুদকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা থেকে কয়েকশ কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে। এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধাভোগী হিসেবে খনিজ সম্পদ অধিদপ্তর, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বিগত এক বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করা চারজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও বিজিবি-এর নাম উঠে এসেছে। সরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও পাথর লুটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্থানীয় বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপিসহ ৪২ জন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকার এনফোর্সমেন্ট বিভাগের নির্দেশে গত ১৩ আগস্ট দুদকের সিলেট সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাতের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল সাদাপাথরে অভিযানে যায়। বুধবার (২০ আগস্ট) সেই প্রতিবেদন জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়।
দুদকের দল তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, স্থানীয় প্রশাসনের কিছু পর্যটন সেবা এবং নদীর তীরেই বিজিবি ক্যাম্প টহল চালু থাকা সত্ত্বেও বিগত কয়েক মাসে কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় প্রশাসন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইন্ধন ও সরাসরি সম্পৃক্ততায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে সরানো হয়েছে। পাথর আত্মসাতের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ও যোগসাজশ ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি না থাকলেও গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে, বিশেষ করে গত ৩ মাস ধরে পাথর উত্তোলন চলতে থাকে। পর্যটন এলাকাটি সংরক্ষিত পরিবেশ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও ১৫ দিন আগে থেকে নির্বিচারে পাথর উত্তোলন ও আত্মসাৎ হয়েছে। প্রায় ৮০ ভাগ পাথর তুলে এলাকায় অসংখ্য গর্ত ও বালুচরে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীকে দায়ী করে বলা হয়, ৮ জুলাই তিনি পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহণ শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছিলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন?’ তার এই বক্তব্যটি বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হলে সাদাপাথর লুটপাটে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের সদিচ্ছার অভাব, অবহেলা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাথর লুটপাট ঠেকাতে তিনি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতে চরম ব্যর্থ হয়েছেন।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধের নির্দেশ দিলেও তিনি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে বর্তমানে কর্মরত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চারজন ইউএনওকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পাথরকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে। তারা হলেন আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাছনাত, ঊর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনিসহ সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যরা অবৈধ পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কমিশন গ্রহণ করে পাথর লুটপাটে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, অবৈধভাবে উত্তোলিত প্রতি ট্রাক পাথর থেকে ১০ হাজার টাকা পুলিশ ও প্রশাসনের জন্য আলাদা করা হয়। যার মধ্যে পুলিশের জন্য ৫ হাজার টাকা এবং উপজেলা প্রশাসনের জন্য ৫ হাজার টাকা বণ্টন হতো।
প্রতিবেদনে সাদাপাথর লুটে বিজিবিকেও দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সাদাপাথর এলাকায় বিজিবির ৩টি পোস্ট থাকা সত্ত্বেও কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল হোসেনসহ বিজিবি সদস্যদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ও নিষ্ক্রিয়তার কারণে অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীরা খুব সহজেই পাথর লুটপাট করতে পেরেছে। বিজিবি সদস্যরা প্রতি নৌকা থেকে ৫০০ টাকার বিনিময়ে এলাকায় প্রবেশের অনুমতি দিত এবং পাথর উত্তোলনের সময় কোনো বাধা দিত না।
রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের নাম:
প্রতিবেদনে পাথর লুটে জড়িত হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন:
বিএনপি: সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিন, সদস্য হাজি কামাল, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি লাল মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে দুদু, সিলেট জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক রুবেল আহমেদ বাহার, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মুসতাকিন আহমদ ফরহাদ, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক মো. দুলাল মিয়া ওরফে দুলা, যুগ্ম আহ্বায়ক রজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুবদল নেতা জসিম উদ্দিন, সাজন মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির কর্মী জাকির হোসেন, সদস্য মোজাফর আলী, মানিক মিয়া, সিলেট জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মকসুদ আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম ওরফে শাহপরান, কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম ওরফে স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেম এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।
আওয়ামী লীগ: কার্যক্রম নিষিদ্ধ সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কর্মী বিলাল মিয়া, শাহাবুদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওদুদ আলফু, কর্মী মনির মিয়া, হাবিল মিয়া এবং সাইদুর রহমান।
জামায়াত: সিলেট মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির মো. ফকরুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন।
এনসিপি: সিলেট জেলা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগর প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।
অন্যান্য: আনর আলী, উসমান খাঁ, ইকবাল হোসেন আরিফ, দেলোয়ার হোসেন জীবন, আরজান মিয়া, মো. জাকির, আলী আকবর, আলী আব্বাস, মো. জুয়েল, আলমগীর আলম এবং মুকাররিম আহমেদ।
দুদকের প্রতিবেদনে নাম আসায় সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কয়েস লোদী, মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক পার্টির সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন সাহান প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগগুলোকে ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, তারা এর নিন্দা জানান।
/আশিক