বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানলে রাজধানী ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম নগরীর ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে দেশের এই প্রধান তিন শহরের লাখ লাখ ভবন ধসে পড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার মতো মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষ করে পুরান ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ভবনই বড় ধরনের কম্পন সহ্য করার মতো সক্ষমতা রাখে না।
বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস অনুযায়ী সামনে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন কোনো দুর্যোগ ঘটলে রাজধানী ঢাকার প্রায় ছয় লাখ ভবন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এর মধ্যে সিংহভাগই পুরান ঢাকার অপরিকল্পিত ও জরাজীর্ণ স্থাপনা। জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন নির্মাণ এবং অপ্রশস্ত সড়ক অবকাঠামোর কারণে এই ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প গবেষক মেহেদি আহমেদ আনসারী জানান বিল্ডিং কোড অমান্য করে ভবন তৈরির কারণেই এই ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাঁর মতে এখনই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, অন্যথায় বড় শহরের অপরিকল্পিত ভবনগুলো বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অন্যদিকে দেশের অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভূকম্পন এলাকার বা ডেঞ্জার জোনের মধ্যে অন্যতম অবস্থানে রয়েছে সিলেট। এই জেলাটি পার্শ্ববর্তী ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট ও স্থানীয়ভাবে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের আওতাভুক্ত। ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে সিলেটকে দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ডাউকি ফল্ট থেকে উৎপত্তি হওয়া ৮ দশমিক ৭ মাত্রার সেই ‘বড় ভুইছাল’ বা ভূমিকম্পে বৃহত্তর সিলেটের বড় অংশ মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই সিলেটের পুরোনো ভবনগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।
সিলেট অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা স্থানীয় ফল্ট বা চ্যুতিগুলো নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে। ২০২১ সালের মে মাসে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে সিলেটে ২০ বার ভূকম্পন অনুভূত হয়, যার কয়েকটির উৎপত্তিস্থল ছিল ডাউকি ফল্টের কাছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম জানান ঢাকায় সম্প্রতি অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পটি সিলেটের জন্য অশনিসংকেত। তাঁর মতে মধুপুর ফল্ট লাইনটি এতদিন নিষ্ক্রিয় থাকলেও হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে ঢাকায় ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে নতুন ভবনের ক্ষতি কম হলেও সিলেটে একই মাত্রার কম্পনে পুরোনো ও নন-ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনগুলো টিকে থাকতে পারবে না। এছাড়া সিলেট শহরের উপশহর আবাসিক এলাকাটি জলাশয় ভরাট করে তৈরি করায় এবং সেখানে বহুতল ভবন বেশি থাকায় বড় ভূমিকম্পে ওই এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের চিত্রও ভীতিজাগানিয়া। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) তথ্য অনুযায়ী নগরীতে বর্তমানে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১১টি ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ভবনই বড় ভূমিকম্পে ধসে পড়ার মতো ঝুঁকিতে আছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শহরে একতলা ভবন আছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৫টি এবং দুই থেকে পাঁচ তলা ভবন আছে ৯০ হাজার ৪৪৪টি। এছাড়া ১০ তলার ওপরে থাকা ৫২৭টি ভবনও ঝুঁকির বাইরে নয়। চউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস উল্লেখ করেন চট্টগ্রাম একটি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা এবং বড় ধরনের কম্পন হলে নগরের অধিকাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) সাবেক উপাচার্য ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান ভূমিকম্পের তিনটি প্রধান উৎসই চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। তাই রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে নগরের ৭৫ শতাংশ ভবন বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এতে কেবল আবাসিক ভবন নয়, চট্টগ্রাম বন্দর, ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে নগরীর অধিকাংশ ভবনই বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি এবং সেগুলোতে ভূমিকম্প প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা নেই।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো উদ্ধার তৎপরতার অপ্রতুলতা। ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকার গলিগুলো অত্যন্ত সরু হওয়ার কারণে বড় কোনো মানবিক বিপর্যয় ঘটলে সেখানে উদ্ধারকারী গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। সিলেটেও বড় দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোও এই ঝুঁকির তালিকায় ওপরের দিকে রয়েছে যা দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে।