অবশেষে আশুরার রাতে প্রকাশ্যে এলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৬ ০৯:৫২:০০
অবশেষে আশুরার রাতে প্রকাশ্যে এলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি

শনিবার রাতে তেহরানের ইমাম খোমেনি হোসাইনিয়াতে আয়োজিত আশুরা রাতের শোকানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ইরানের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মীয় আলেমরা। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ইরানের পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালি’বাফ, বিচার বিভাগের প্রধান গোলাম হোসেইন মোহসেনি এজেই এবং ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার যারা শীর্ষ পর্যায়ের এই অনুষ্ঠানে সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উপস্থিত হন।

শোকানুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিশিষ্ট ধর্মীয় চিন্তাবিদ হোজাতুল ইসলাম মাসউদ আলি। তিনি কারবালার শহীদ ইমাম হোসাইন (আ.)-এর আত্মত্যাগের ইতিহাস ও তা থেকে ইরানি জাতির গ্রহণ করা আদর্শিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার ভাষায়, “আশুরা কেবল অতীতের ঘটনা নয়; এটি একটি চিরন্তন নৈতিক দর্শন। এই দর্শন আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়, দখলদারি ও রাজনৈতিক নির্লজ্জতার বিরুদ্ধে মাথা নত না করার নীতি। ইরানি জাতি আশুরা থেকে ‘অপমান কখনো নয়’ এই মূলনীতি ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং যেকোনো ধরনের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করেছে।”

মাসউদ আলি তার বক্তব্যে সাম্প্রতিক ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রসঙ্গও টানেন এবং বলেন, “আজকার বিশ্ব রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ মিথ্যা হচ্ছে জায়নবাদী কাঠামো, যা একাধারে দমননীতি, গণহত্যা ও গণমাধ্যম-নির্ভর বিভ্রান্তির আশ্রয় নিয়েছে। আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বে ইরান এই মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের বার্তাবাহক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আমরা কারবালার চেতনা নিয়ে এগোচ্ছি যেখানে শেষ পর্যন্ত বিজয় হয় নৈতিকতার।”

আয়াতুল্লাহ খামেনি শোকানুষ্ঠানে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও তার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পুরো সময় তিনি গভীর মনোযোগ ও ধ্যানমগ্নতায় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। একপর্যায়ে তিনি খ্যাতিমান শোকসংগীত শিল্পী মাহমুদ কারিমিকে নিজের কাছে ডাকেন এবং তার কানে একটি বিশেষ পঙক্তি পাঠের অনুরোধ জানান। সেই পঙক্তিটি ছিল—“তুমি থাকবে আমার আত্মা ও হৃদয়ে, হে স্বদেশ…”। এই কথাটি প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেকের মতে, এটি কেবল দেশপ্রেমের প্রকাশ নয়, বরং বর্তমান সময়ের জন্য একটি গভীর বার্তা বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন ইরান আন্তর্জাতিক চাপ, নিষেধাজ্ঞা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে রয়েছে।

ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান এক্স-এ দেওয়া এক বার্তায় শোকানুষ্ঠানে সর্বোচ্চ নেতার উপস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং লেখেন, “কারবালার বীর আবুল ফজল আলামদারের কাছে আমি সর্বোচ্চ নেতার সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা জানাই। তাঁর উপস্থিতিই জাতির মনোবল ও একতা দৃঢ় করে।” পেজেশকিয়ানের এই বক্তব্য মূলত একটি রাজনৈতিক ইঙ্গিতও বহন করে যেখানে নবনির্বাচিত সরকার সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে চায় এবং জাতীয় ঐক্য রক্ষায় আশুরার চেতনার প্রতি নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই শোকানুষ্ঠান এবং সর্বোচ্চ নেতার উপস্থিতি ইরানের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও ভূরাজনৈতিক বার্তার একটি কৌশলগত বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন ইসরায়েল-গাজা সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা বাড়িয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে, তখন আয়াতুল্লাহ খামেনির এই নীরব উপস্থিতি ও প্রতীকী বার্তাগুলো ইরানের আদর্শিক দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অনেকেই।

এই শোকানুষ্ঠানকে কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ‘মেসেজ প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ধর্ম, রাষ্ট্র এবং প্রতিরোধের এক অভিন্ন রূপ তুলে ধরেই যেন আয়াতুল্লাহ খামেনি একটি মৌলিক বার্তা দিয়েছেন ইরান কারবালার চেতনায় দৃঢ়, এবং কোনো বৈশ্বিক মিথ্যা বা আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করবে না।

এই বার্তাটি শুধু ইরানের জনগণের জন্য নয়, বরং গোটা মুসলিম বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও। কারণ আশুরা এবং কারবালার যে চেতনাকে ইরান তার রাষ্ট্রীয় আদর্শের কেন্দ্রে স্থাপন করেছে, তা আজকের বৈশ্বিক অসাম্য, দখলদারিত্ব ও ধর্মীয় নিপীড়নের বিপরীতে একটি অনন্য বিকল্প মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্ব করছে। আর সেই বার্তাকেই তেহরানের ইমাম খোমেনি হোসাইনিয়ার আশুরার শোকানুষ্ঠানে আয়াতুল্লাহ খামেনি তার উপস্থিতির মাধ্যমে নিঃশব্দে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন।

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ