রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন কেন জমা দিতে পারছেনা সিআইডি

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০২ ১৭:১৯:২৫
রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন কেন জমা দিতে পারছেনা সিআইডি

২০১৬ সালের আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তদন্তে দীর্ঘসূত্রিতার মধ্যে আবারও সময় চাওয়ায় এবার আদালত সিআইডিকে (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) আগামী ২৪ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্ধারিত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে।

বুধবার (২ জুলাই) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হলে ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসেন এ নির্দেশ দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মামলাটি দায়েরের পর থেকে সিআইডি ৮৬ বার সময় নিয়েছে, যা এক নজরে বিচার ব্যবস্থায় একটি অস্বাভাবিক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের নামে জালিয়াতি করে অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠায়, যার মধ্যে মাত্র একটি অনুরোধ ব্যর্থ হয় তাতে প্রায় ৮৫১ মিলিয়ন ডলার রক্ষা পায়। বাকি অর্থের মধ্যে কমপক্ষে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (RCBC)-এর মাধ্যমে দেশটির ক্যাসিনো খাতে পৌঁছে যায়। আরও ২০ মিলিয়ন ডলার শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে পাঠানো হলেও তা আটকানো হয়।

চুরির এ ঘটনার প্রায় এক মাস পর, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক (হিসাব ও বাজেটিং) জোবায়ের বিন হুদা ঢাকার মতিঝিল থানায় মামলা করেন। মামলার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক হলেও তদন্ত প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরেই স্থবির।

চুরি যাওয়া অর্থের মধ্যে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার আরসিবিসি থেকে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কা থেকে ২০ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করতে পেরেছে। বাকিটুকু অর্থ বিশেষ করে ক্যাসিনো জুয়ার মাধ্যমে ম্যানিলায় পাচার হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলারের প্রায় পুরোটাই এখনও অনুদ্ধারিত রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি আদালতে আরসিবিসির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে, ৬৬ মিলিয়ন ডলার ফেরতের দাবি জানিয়ে। মামলার অন্যতম দাবি ছিল, আরসিবিসি ইচ্ছাকৃতভাবে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থ গ্রহণ ও তা লুকানোর প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে।

২০২৩ সালের ২ মার্চ, নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি চলমান রাখার অনুমতি দেয়, তবে একইসঙ্গে আরসিবিসির বিরুদ্ধে আনা কিছু অভিযোগ খারিজ করে দেয়। এর ফলে মামলার কাঠামো কিছুটা দুর্বল হলেও মূল বিষয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ চুরি আদালতের বিচারাধীন হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।

দুই দেশের আদালতে মামলা চললেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে সিআইডির ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রায় ৮ বছরেও তদন্ত শেষ না হওয়া, ৮৬ দফা সময় চাওয়া, এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধীর গতি সব মিলিয়ে এটি এখন এক ‘আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অপরাধের’ গৌরবহীন উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এত বড় একটি অর্থনৈতিক অপরাধে বাংলাদেশ যেভাবে তদন্তে ধীরতা দেখাচ্ছে, তা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক আর্থিক নেটওয়ার্কে দেশের অবস্থান দুর্বল করতে পারে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা আন্তর্জাতিক ক্লিয়ারিং হাউসগুলোর কাছে এটি দেশীয় সক্ষমতা নিয়ে নেতিবাচক বার্তা দিতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনাটি শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অপরাধ ইতিহাসের অন্যতম চাঞ্চল্যকর ঘটনা। সিআইডির ৮৬ দফা সময় গ্রহণ এবং এখনও পর্যন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার কারণে মামলার গ্রহণযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আদালতের এবারকার সময়সীমা ২৪ জুলাই তদন্তে গতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে কি না, তা এখন সময়ই বলে দেবে।

এই ঘটনায় যারা দায়ী ছিল চক্রটি দেশি হোক বা বিদেশি তাদের শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনতে না পারলে এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাষ্ট্রীয় নৈতিকতা ও কূটনৈতিক সক্ষমতার ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে থাকবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ