৮১ মিলিয়ন ডলার উধাও: রিজার্ভ চুরির মূল হোতা যিনি

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ১০:১১:০৪
৮১ মিলিয়ন ডলার উধাও: রিজার্ভ চুরির মূল হোতা যিনি

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশের ১০১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার প্রায় রাতারাতি রহস্যজনকভাবে লোপাট হয়ে যায়। এই ঘটনায় শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিই নয়, বরং বিশ্বব্যাংকিং ব্যবস্থার নিরাপত্তা ও ডিজিটাল আর্থিক সুরক্ষার দুর্বলতা চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তদন্তে উঠে আসে যে, এটি কোনও সরল সাইবার হামলা নয়, বরং দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত একটি জালিয়াতির চক্র, যেখানে ভেতরের কিছু কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিদেশি নাগরিক, আন্তর্জাতিক অপরাধী ও রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।

এই কাণ্ডের মূলে রয়েছে একটি জটিল ও বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র। ভারতের নাগরিক নীলা ভান্নান এবং রাকেশ আস্তানা নামক হ্যাকাররা মূল ভূমিকা পালন করেন। তারা বাংলাদেশের রিজার্ভ অ্যাকাউন্টের সুইফট সিস্টেমে প্রবেশের জন্য পরিকল্পিত ম্যালওয়্যার আক্রমণ চালিয়ে দেশের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার কম্পিউটার হ্যাক করে তথ্য ও সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ নেয়। এর মাধ্যমে তারা দেশের ফেডারেল রিজার্ভে থাকা অর্থ স্থানান্তরের জন্য ভুয়া ট্রান্সফার মেসেজ পাঠায়। এসব তথ্য গোপনে রাখা এবং প্রমাণ ধ্বংস করার কাজও ভারতে বসবাসরত রাকেশ আস্তানার দায়িত্বে ছিল।

অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান এবং রাজশাহীর অফিসের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এই চক্রের অন্যতম মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। তারা ব্যাংকের সিস্টেমে দুর্বলতা সৃষ্টি ও নীরব সমর্থন দিয়ে অপরাধকে সহজ করেছে। তদন্তে জানা গেছে, কাজী ছাইদুরের দীর্ঘ ৩৫ বছরের অধিপত্যের সময় ব্যাংকের ফরেক্স ও ট্রেজারি বিভাগে কেউ তার অনুমতি ছাড়া কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তিনি নিয়োগ থেকে শুরু করে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেন।

হ্যাকিংয়ের সময় ৫ হাজারেরও বেশি কম্পিউটারকে একযোগে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এনে ভারতের নীলা ভান্নান ও তার সহযোগীরা ৩৫টি ভুয়া ট্রান্সফার বার্তা তৈরি করেন, যার মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলারের অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশ পাঠানো হয়। যদিও কিছু অর্থ আটকে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে চুরি হয়ে যায়। তদন্তে দেখা গেছে, এই অর্থ চুরি করার সময় সরকারের ঊর্ধ্বতনরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী বিভিন্নভাবে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। এদিকে, তথ্য ফাঁস রোধে গভর্নর ড. আতিউর রহমান সহ অনেকেই চাপ প্রয়োগ করে ব্যাপারটি চাপা রাখার চেষ্টা করেন।

তদন্তের সূচনা হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘ ৮ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। তদন্ত সংস্থাগুলো বারবার সময় বাড়িয়েছে এবং বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়া ধীরগতি করেছে। মামলা হয়েছে, তবে বিচার এবং সম্পূর্ণ সত্য উদঘাটনের পথে নানা ধরনের বাধা রয়ে গেছে। এই কাণ্ডের অপরাধীদের মধ্যে অনেকেই এখনও দায়িত্বে আছেন বা নিরাপদ অবস্থানে রয়েছেন। আবার তাদের প্রভাবের কারণে অর্থ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আদালতেও সুচারু প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক সংস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল। কাজী ছাইদুর ও মেজবাউল হকের নেতৃত্বে এই সিন্ডিকেট গ্রাহকদের ঝুঁকিতে ফেলে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচার করেছিল। এর কারণে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও প্রভাবিত করেছে।

রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক শাসনব্যবস্থা এই সংকটের মুখে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে। এ কারণেই অনেকেই ‘রিজার্ভ চোর’ শব্দগুচ্ছ দিয়ে কাজী ছাইদুরদের নিশানা করে আসছেন। এই দুর্নীতি ও অপরাধ কাণ্ডের দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করে ক্ষতিপূরণ ও অর্থ উদ্ধারের ব্যবস্থা না হলে দেশের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ভবিষ্যতে আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।

সবশেষে, এই ঘটনা বাংলাদেশের আর্থিক নিরাপত্তা, আইটি অবকাঠামো, প্রশাসনিক সততা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর এক অমোঘ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু অর্থের লোপাট নয়, বরং একটি দেশের রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতার প্রতিফলন। এ জন্য প্রয়োজন সার্বিক পুনর্মূল্যায়ন ও কাঠামোগত সংস্কার, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্নীতি আর ঘটতে না পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড শক্তিশালী হয়।

-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ