এই ‘জুলাই সনদ’ কেন জরুরি

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০১ ০৯:২৬:৫৮
এই ‘জুলাই সনদ’ কেন জরুরি

২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন, যা কোটাব্যবস্থার সংস্কার দাবির মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে এক ভয়াবহ গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, তা ছিল সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক রক্তাক্ত ও ঐতিহাসিক মোড়। শুধু একটি নীতিগত ইস্যু বা চাকরির কোটার প্রশ্ন নয়—এই আন্দোলন রূপ নেয় একটি জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও বঞ্চনার বিস্ফোরণে। রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, উচ্চমাত্রার বেকারত্ব, শিক্ষিত যুবসমাজের হতাশা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার মতো সংকটগুলো একত্র হয়ে এই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তোলে।

সবকিছুর সূচনা ঘটে ২০২৪ সালের ৫ জুন, যখন হাইকোর্ট ২০১৮ সালের কোটাব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে। এর পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। আন্দোলনের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের এই আন্দোলন দ্রুত গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ঢাকার রাজু ভাস্কর্য থেকে জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বাকৃবি, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর সবকিছু জ্বলতে থাকে বিক্ষোভে। বিক্ষোভ দমনে সরকার পুলিশ ও র‌্যাবসহ দলীয় সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত অনুযায়ী, ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে একটি পরিকল্পিত ও ব্যাপক মাত্রার দমন-পীড়ন এবং গণহত্যা সংঘটিত হয়। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ১,৪০০ জন মানুষ নিহত হন, যাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রছাত্রী, শ্রমিক, শিশু, শিক্ষক, নারী এবং পথচারী সাধারণ মানুষ।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় নিহতের সংখ্যা ১,৪২৩ জন, আহত প্রায় ২২,০০০ এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ৫৮৭। কালের কণ্ঠ পত্রিকার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করলে তার মৃত্যুর ছবি ‘জুলাই বিপ্লবের আইকনিক ছবি’ হয়ে ওঠে। এই ঘটনার প্রতিচ্ছবি ১৯৭৬ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার সোয়েটো বিদ্রোহে ছাত্র হেক্টর পিটারসনের মৃত্যুর ছবির মতোই আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়।

জুলাই বিপ্লব ছিল কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং জাতির এক গভীর রাজনৈতিক প্রত্যাশারও প্রতিফলন। আমরা যদি ইতিহাসে ফিরে তাকাই, তাহলে দেখি—বিশ্বের বিভিন্ন গণঅভ্যুত্থানের পর একটি ন্যায্য ও নীতিনির্ভর সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন হয় একটি ঐক্যবদ্ধ রূপরেখা। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার ১৯৬০ সালের শার্পভিল গণহত্যা ও ১৯৭৬ সালের সোয়েটো বিদ্রোহ দেশটিকে বর্ণবাদী শাসন থেকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে শামিল হয় এবং ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরই গঠিত হয় ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ যা গণহত্যা ও নিপীড়নের সত্য উদ্ঘাটনে মুখ্য ভূমিকা রাখে।

একইভাবে, ১৯৮০-এর দশকে পোল্যান্ডে গড়ে ওঠা সলিডারিটি আন্দোলন একসময় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যা ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। সেই গণঅভ্যুত্থান শুধু রাজনীতি বদলায়নি, পোলিশ সমাজে নতুন এক ঐক্যের ভিত্তি রচনা করেছিল। নাগরিক দায়িত্ব, অর্থনৈতিক সংস্কার, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এসবই আসে গণআন্দোলনের পর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে গৃহীত রূপরেখার মধ্য দিয়ে।

তিউনিসিয়ায় ২০১০-১১ সালের ‘জুঁই বিপ্লব’ শুরু হয় মোহাম্মদ বুআজিজির আত্মাহুতির মাধ্যমে। তার একাকী প্রতিবাদ যেমন জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ জাগিয়ে তোলে, তেমনি গণঅভ্যুত্থান শেষে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে গঠিত হয় তিউনিসিয়ান ন্যাশনাল ডায়ালগ কোয়ার্টেট, যা পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়।

এই অভিজ্ঞতাগুলোর আলোকে বাংলাদেশের ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবও একটি জাতীয় রূপান্তরের সুযোগ এনে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সুযোগটি আমরা কীভাবে গ্রহণ করছি? প্রায় এক বছর হতে চলল, অথচ এখনো ‘জুলাই সনদ’ নামে কোনো জাতীয় রূপরেখা দৃশ্যমান হয়নি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে এবং ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠিত হয়েছে, কিন্তু আলোচনা এখনো কেবল প্রক্রিয়াগত স্তরে সীমাবদ্ধ। জাতি এখনো অপেক্ষা করছে একটি কার্যকর এবং বৈপ্লবিক রূপরেখার, যা হবে একটি ঐতিহাসিক দলিল ‘জুলাই সনদ’।

এই ‘জুলাই সনদ’ কেন জরুরি, তা আমরা কয়েকটি পয়েন্টে বিশ্লেষণ করতে পারি:

১. জাতীয় ঐক্যের দলিল: এটি হবে নতুন বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সামাজিক চুক্তি, যা জাতির মধ্যে বিভাজন নয়, সংহতি সৃষ্টি করবে।

২. সংস্কারের ভিত্তি: এই সনদের ওপর ভিত্তি করেই হতে পারে যাবতীয় কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কার, যেমন চাকরির কোটাব্যবস্থা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

৩. গণতান্ত্রিক রক্ষাকবচ: এটি স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে একটি রাজনৈতিক ও আইনি প্রতিরোধ কাঠামো প্রদান করবে।

৪. আইনের শাসনের নিশ্চয়তা: ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়’ এই নীতি নিশ্চিত করতে হবে সাংবিধানিকভাবে।

৫. শহীদদের স্বীকৃতি ও ক্ষতিপূরণ: শহীদদের তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং পরিবারগুলোর পুনর্বাসন নিশ্চিত করা।

৬. সাম্য ও ন্যায্যতার ভিত্তি: জাতিকে এগিয়ে নিতে হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে একটি মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে হবে।

এক কথায়, এই সনদ হতে পারে বাংলাদেশের ‘ম্যাগনাকার্টা’ যেমনটি ছিল ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডে রাজা জন ও তার প্রজাদের মধ্যে এক চুক্তি, যা রাজতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা রোধের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশের জনগণও আজ এমন একটি ঐতিহাসিক সনদের অপেক্ষায় আছে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যে একটি নতুন সামাজিক চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই চুক্তি শুধু অতীতকে মোকাবিলা করবে না এটি ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও দেবে। তাই কালক্ষেপণ নয়, এখনই সময় ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের। একটি জাতি তার ইতিহাসকে অস্বীকার করে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে পারে না। ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে জাতীয় পুনর্জাগরণের এক অসাধারণ সুযোগ। রাষ্ট্রের উচিত হবে সেই সুযোগটি গ্রহণ করা, নতুবা ইতিহাসের আদালতে এর জবাবদিহিতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ