চীনের নৌমহড়া ও জাপানের উদ্বেগ—প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন সামরিক উত্তেজনা

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৯ ১৬:২৯:১৮
চীনের নৌমহড়া ও জাপানের উদ্বেগ—প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন সামরিক উত্তেজনা

চীনের দুটি বিমানবাহী রণতরী—‘শানডং’ ও ‘লিয়াওনিং’—সম্প্রতি একযোগে প্রশান্ত মহাসাগরে বড় পরিসরের নৌমহড়া পরিচালনা করেছে, যা জাপানের জন্য এক অভূতপূর্ব ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। টোকিও শুধুমাত্র কূটনৈতিক পর্যায়ে নয়, বরং ব্যতিক্রমধর্মীভাবে জনসমক্ষে চীনের সামরিক গতিবিধি প্রকাশ করেছে। জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২৫ মে থেকে দৈনিক ভিত্তিতে চীনা রণতরীগুলোর অবস্থান চিহ্নিত করে একটি মানচিত্র প্রকাশ করেছে—এমন পদক্ষেপ তারা সচরাচর নেয় না।

চীনের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এই মহড়ায় ৫০০-র বেশি বার উড্ডয়ন ও অবতরণ সম্পন্ন করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি জাপানের নজরদারি বিমানের খুব কাছাকাছি চলে আসে, এমনকি একটি ক্ষেত্রে ৪০ মিনিট এবং পরের দিন ৮০ মিনিট পর্যন্ত একটি চীনা ফাইটার জাপানি বিমানকে অনুসরণ করে। এসব ঘটনাকে টোকিও আখ্যা দিয়েছে “অস্বাভাবিক ও বিপজ্জনক ঘনিষ্ঠতা”, যা আকাশে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এ সব কর্মকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইনসিদ্ধ দাবি করে বলেছে, “জাপানের যুদ্ধজাহাজ ও নজরদারি বিমান চীনের স্বাভাবিক সামরিক কর্মকাণ্ডের উপর নজরদারি করে উল্টো নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছে।” চীন জাপানকে “বিপজ্জনক কার্যক্রম” বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

মানচিত্রে আরও দেখা গেছে, ‘লিয়াওনিং’ রণতরী প্রথমবারের মতো তথাকথিত ‘সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন’ ("second island chain") অতিক্রম করেছে—যেটি যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক কৌশলে একটি কৌশলগত প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা জাপান থেকে শুরু হয়ে গুয়ামে গিয়ে শেষ হয়। এই অঞ্চল পেরোনো মানে চীনা নৌ-সক্ষমতার গতি ও পরিসর আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে—এটি ওয়াশিংটনের জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা।

চীনের এই মহড়া এমন সময় হচ্ছে, যখন তারা তাদের তৃতীয় ও সর্বাধুনিক বিমানবাহী রণতরী 'ফুজিয়ান'–এর সাগরপথে পরীক্ষামূলক চলাচলের অগ্রগতি জানাচ্ছে। এই জাহাজ হবে বিশ্বের দ্বিতীয়, এবং চীনের প্রথম, যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপল্ট ব্যবহার করে যুদ্ধবিমান উৎক্ষেপণ করতে পারবে—এ প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত কেবল যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্রুত ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিমান উৎক্ষেপণ সম্ভব, ফলে একক রণতরী থেকেই আরও বেশি সংখ্যক অভিযানে অংশগ্রহণ করা যাবে।

এই অঞ্চলে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ফেব্রুয়ারির তাসমান সাগরে চীনের নৌমহড়ারও স্মরণ করিয়ে দেয়, যা অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। পর্যাপ্ত পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই মহড়া হওয়ায়, কিছু বাণিজ্যিক বিমান শেষ মুহূর্তে পথ বদলাতে বাধ্য হয়। যদিও পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া স্বীকার করে নেয়, মহড়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হয়েছে, তবে চীনের “বিরল স্বচ্ছতা” নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

চীনের এই শক্তিপ্রদর্শন এমন সময়ে ঘটছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের অবস্থান ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ঘনীভূত হওয়ায় সেখানে সম্পদ স্থানান্তর করছে। সম্প্রতি ইউএসএস নিমিটজ বিমানবাহী রণতরী দক্ষিণ চীন সাগর ত্যাগ করে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে বলে খবর মিলেছে।

এ প্রেক্ষিতে জাপানের প্রতিরক্ষা উদ্বেগ কেবল আঞ্চলিক নয়, বরং তা বৈশ্বিক ভূরাজনীতির পরবর্তী ধাপের ইঙ্গিতও বহন করছে। চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নড়াচড়া আজ কেবল সমুদ্রেই নয়, কূটনৈতিক মানচিত্রেও ঢেউ তুলছে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত