মতামত

ঐক্যমত কমিশন বর্জন: জামায়াতের রাজনীতি কোন পথে?

ড. বাতেন মোহাম্মদ
ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
২০২৫ জুন ১৮ ০১:২০:৪৪

আজকের ঐক্যমত কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে জামায়াতে ইসলামী (জামায়াত) অংশ নেয়নি। এটি নিঃসন্দেহে একটি আত্মঘাতী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এতদিন দলটি সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং জনসমক্ষে এমন একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে—সরকার পরিচালনায় তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব রয়েছে। এমনকি তারা নীতিগতভাবেও সরকারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার—এমন ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিল। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের পর তাদের প্রতিক্রিয়া জামায়াতকে আবার সেই চিরচেনা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে—আসলেই তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কী?

জামায়াত এপ্রিলের নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের পর সেই সুযোগ আর তাদের হাতে থাকছে না। তবে জামায়াতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি অন্যত্র।

প্রথমত, লন্ডন বৈঠকের প্রেক্ষিতে জামায়াত নিজেদের যে ‘স্ট্রং প্লেয়ার’ হিসেবে উপস্থাপন করছিল, সেই কল্পচিত্র ভেঙে পড়েছে, ফলে রাজনৈতিক মহলে তারা এখন বিব্রত। কিন্তু আরও গভীর সংকট তৈরি হবে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে। এতদিন বহু নীতিগত ইস্যুতে জামায়াত এনসিপির (নতুন রাজনৈতিক শক্তি) সহায়তা পেয়েছিল। এমনকি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার মতো গুরুতর রাজনৈতিক প্রস্তাবেও, জামায়াত-শিবির পর্দার আড়ালে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু সংস্কার কমিশনের বৈঠকে অনুপস্থিত থাকায় এনসিপি এখন নৈতিক কারণেই জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হবে।

আরেকটি গুরুতর ঝুঁকি হলো—সরকার এই বার্তাটি কীভাবে নিচ্ছে। বিএনপি মাঠের রাজনীতিতে প্রভাব খাটিয়ে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে নিজের অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সরকার বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে। কারণ বিএনপি এখনো রাজপথে সবচেয়ে বড় শক্তি। এখন প্রশ্ন হলো—জামায়াত কি আদৌ সেই মাঠের শক্তি দিয়ে সরকারকে নমনীয় করতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, এবং সরকারও আর তাদের ‘মান ভাঙাতে’ কোনো আগ্রহ দেখাবে না।

আর যদি সরকার সত্যিই জামায়াতের ‘অভিমান’ ভাঙাতে এগিয়ে না আসে, তবে ভবিষ্যতে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের বড় ভূমিকা গ্রহণের যে স্বপ্ন জামায়াত লালন করছে, তা গভীর সংকটে পড়বে।

রাজনীতিতে ‘মান-অভিমান’ এক ধরনের ক্যালকুলেটেড স্ট্র্যাটেজি—তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু জামায়াত কোনো সুস্পষ্ট দাবি ছাড়াই কেবল এ কারণে সংলাপে অংশ নেয়নি যে সরকার কেন লন্ডনে বৈঠক করল এবং নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করল—এমন কারণ দেখিয়ে একটি জাতীয় ও সর্বজনীন ইস্যু যেমন সংস্কার কমিশন বর্জন করা একটি হাস্যকর ও অগভীর অভিমান বলেই প্রতীয়মান হয়।

এটি দলটিকে গুরুত্বহীন করে তুলবে। জামায়াত স্পষ্টভাবে নিজেকে বিএনপির সমকক্ষ দেখাতে চাচ্ছে—কিন্তু সে অবস্থান নিতে হলে অন্তত কিছু দাবিও সামনে আনতে হয়। শুধু অভিমান করে দূরে সরে গেলে সেটা রাজনীতি নয়, দাম্পত্য জীবনের ভঙ্গিমা। রাজনীতি ত্যাগে-তিতিক্ষায় চলে, অভিমানে নয়।

একটি মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—জামায়াতের এই অভিমান আসলে কার প্রতি? তারা কি এই সরকারকে সত্যিই তাদের ‘রাজনৈতিক সংগী’ মনে করেছিলো? এবং সেই সংগী ‘বেইট্রেয়াল’ করায় হতাশ হয়ে অভিমান দেখাচ্ছে? কিন্তু পরবর্তী বৈঠকে যদি তারা ফিরে আসেই—তাহলে কোন অজুহাতে ও কোন মুখে আসবে?

এই প্রশ্নের উত্তর তারা নিজেরাও হয়তো জানে না।

এত ঠুনকো ইগো বা আত্মম্ভরিতা নিয়ে রাজনীতি করা যায় না। আওয়ামী লীগের পনেরো বছর ধরে তারা যে 'স্পাইনলেস ক্ল্যামোফেজ' (কৌশলগত নীরবতা ও তোষণমূলক রাজনীতি) করেছে, এখন সামান্য সুযোগ আসতেই তার উল্টো দিক—অভিমান ও আত্মপ্রচারের রাজনীতি দেখাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দলটা কবে দেশের এবং সাধারণ মানুষের রাজনীতি করবে?

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত