মতামত

কল্পনা চাকমা: অপহরণ না নাটক? তিন দশকের রহস্যের অন্তরালে

ওমর ফারুক
ওমর ফারুক
গবেষক, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
২০২৫ জুন ১৬ ২১:৫৯:১৬
কল্পনা চাকমা: অপহরণ না নাটক? তিন দশকের রহস্যের অন্তরালে

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনা রয়েছে, যেগুলোর প্রচার এত প্রবল যে প্রকৃত প্রমাণপত্র তার তুলনায় অনেকটাই দুর্বল। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাতের ঘটনা তেমনই এক রহস্যাবৃত অধ্যায়—রাঙামাটির বাঘাইছড়ির এক পাহাড়ি গ্রামে ‘কল্পনা চাকমা নিখোঁজ’–এর ঘটনা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বিতর্ক, অপপ্রচার ও পক্ষপাতমূলক ইতিহাসচর্চার কেন্দ্রবিন্দু।

প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেলেও আজও কল্পনা চাকমা ইস্যুতে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ সামনে আসেনি, বরং প্রতিবছর ১২ জুন ঘিরে রাষ্ট্রবিরোধী পাহাড়ি সংগঠনগুলো সরব হয়—দাবি তোলে সেনাবাহিনী অপহরণের সঙ্গে জড়িত, রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হবে, বিচার দিতে হবে।

কিন্তু কে ছিলেন কল্পনা চাকমা?অনেক বিতর্কের উৎস এই নাম। কিন্তু বাস্তবে কল্পনা ছিলেন এক তরুণ পাহাড়ি নারী, যিনি হিল উইমেন ফেডারেশন নামে একটি সংগঠনের নেত্রী ছিলেন। নারী অধিকার, শিক্ষা, এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিনি কাজ করতেন, যা এক অর্থে ইতিবাচক। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল সশস্ত্র সংঘাতের উত্তপ্ত মঞ্চ, যেখানে হিল উইমেন ফেডারেশন ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ছিল শান্তিবাহিনীর আদর্শে অনুপ্রাণিত। এখান থেকেই শুরু হয় কল্পনাকে ঘিরে সন্দেহ ও সংশয়ের জন্ম।

জানা যায়, কল্পনা চাকমা ছিলেন শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর একজন সক্রিয় সহযোদ্ধা, যিনি সরাসরি সশস্ত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর দৃষ্টিগোচর হয়। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে কল্পনা সক্রিয়ভাবে এক চাকমা স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারে যুক্ত হন, যিনি আবার শান্তিবাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। এর ফলে তাঁর কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা হিসেবেও চিহ্নিত হয়।

কল্পনা চাকমা যখন বক্তৃতা দিতেন, সভা করতেন, নারী অধিকারের পক্ষে কথা বলতেন—তখন তাঁকে কেউ আপত্তিকর মনে করত না। কিন্তু বিপত্তি শুরু হয় তখন, যখন তিনি প্রকাশ্যে বিজয় কেতন চাকমা নামের এক প্রার্থীকে সমর্থন করেন, যিনি শান্তিবাহিনীর রাজনৈতিক পছন্দের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

অপরদিকে সেনাবাহিনীর লে. ফেরদৌস তখন পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করে আলোচনায় আসেন। এই পটভূমিতে শান্তিবাহিনী চেয়েছিল তাঁকে ও সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করতে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, কল্পনা চাকমাকে সামনে রেখে ঠিক তখনই একটি অপপ্রচারমূলক পরিকল্পনার জন্ম নেয়।

ঘটনার পরপরই কল্পনা চাকমার পরিবার প্রথমে শান্তিবাহিনীকেই অপহরণের জন্য দায়ী করেছিল। পরে হঠাৎ করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে। ধারণা করা হয়, শান্তিবাহিনীর চাপ ও হুমকির মুখে পরিবারের বক্তব্য পাল্টে যায়।

অন্যদিকে পাহাড়ি সমাজের কিছু সূত্র, এমনকি সাবেক পিসিপি নেতারা দাবি করেন—কল্পনা আসলে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার সঙ্গে। পরিবারের অমতে গড়ে ওঠা প্রেম, এবং সংগঠনের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কারণে তিনি শান্তিবাহিনীর অনুগত কয়েকজন নেতার সহায়তায় গোপনে ত্রিপুরা চলে যান। এই সূত্রে আরও জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন রাতেই তাঁকে পার করে দেওয়া হয় সীমান্তের ওপারে। এরপর থেকেই শুরু হয় "অপহরণ নাটক"।

কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন থেকে যায়...১. কল্পনার মায়ের সাক্ষাৎকারে কেন একাধিকবার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া গেছে?২. যদি সেনাবাহিনীই অপহরণ করে থাকে, তাহলে তিন দশকেও কেন কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি?৩. প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমাও কেন আজ পর্যন্ত আত্মগোপনে আছেন?৪. এই পুরো ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা কারা তুলল

প্রতি বছর ১২ জুন কিছু পাহাড়ি সংগঠন কল্পনা চাকমা দিবস পালন করে। সামাজিক মাধ্যমে চালানো হয় প্রচার—“রাষ্ট্র নারীকে গুম করেছে”। কিন্তু যদি এটি সাজানো কাহিনি হয়, তাহলে তার জবাবদিহি কার?

জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং অনেক সাধারণ উপজাতি-বাঙালি নাগরিক মনে করেন, এটি শান্তিবাহিনীর দীর্ঘমেয়াদি একটি কৌশল, যার উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং আন্তর্জাতিক মহলে রাষ্ট্রকে দায়ী করা।

কল্পনা চাকমা বাংলাদেশে ফেরার চেষ্টায় বহুবার ভারত থেকে চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু শান্তিবাহিনীর পক্ষ থেকেই তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ‘যদি তুমি ফিরে আসো, হত্যা করা হবে’—এমন হুমকি পাওয়ায় তিনি আর ফেরেননি। ফলে একপ্রকার ‘দ্বৈত অপহরণ’—একদিকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচার, অন্যদিকে কল্পনার আসল অবস্থান চাপা দিয়ে রাখার অপপ্রয়াস।

১৯৯৬ সালের ১১ জুন রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত পাহাড়ি গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে এক বিভ্রান্তিকর খবর—“কল্পনা চাকমাকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়েছে!” পরদিন সকালেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে লংগুদুতে। অথচ সেদিন রাতেই তাকে সীমান্ত পার করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অনেক সূত্র জানায়।

তৎকালীন হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা আজ ইতিহাসের দুই বিপরীত বয়ানের প্রতীক। একপক্ষ তাঁকে ‘গুম হওয়া নারী অধিকারকর্মী’ হিসেবে তুলে ধরে, অন্যপক্ষ মনে করে—তিনি ছিলেন রাষ্ট্রবিরোধী এজেন্ডার অংশ।

তার ‘নিখোঁজ’ হওয়া কি রাষ্ট্রীয় অপহরণ ছিল, নাকি রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ? তা আজও অজানা। কিন্তু এটি স্পষ্ট—একজন নারীকে কেন্দ্র করে একটি জটিল রাজনৈতিক নাটক রচিত হয়েছিল, যার নির্দেশনা লিখেছিল সশস্ত্র সংঘাতমুখী শক্তি।

আমরা সত্য জানতে চাই, পক্ষ নয়প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেলেও ‘কল্পনা চাকমা অপহরণ’ ইস্যু আজও সত্য-মিথ্যার দোলনায় দুলছে। আমাদের প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত, নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং প্রমাণভিত্তিক ইতিহাস। প্রয়োজন সত্য প্রকাশ—যা কোনো পক্ষের মুখপাত্র নয়, বরং ভবিষ্যতের শিক্ষা হয়ে থাকবে।

লেখকের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলে ইমেইল করুন:[email protected]

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত