বিশেষ প্রতিবেদন

ধ্বংস থেকে নেতৃত্ব: ৫ আগস্ট থেকে যেভাবে শুরু হলো অর্থনীতির পুনর্জাগরণ

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ৩১ ১২:৫৬:২৩
ধ্বংস থেকে নেতৃত্ব: ৫ আগস্ট থেকে যেভাবে শুরু হলো অর্থনীতির পুনর্জাগরণ

৫ আগস্ট ২০২৪—তারিখটি ছিল নিঃশব্দ অথচ ঐতিহাসিক। ঢাকার আকাশে সেদিন ছিল না কোনো বিজয়ের উল্লাস, ছিল না কোনো পতাকা মিছিল কিংবা রাজনৈতিক জয়জয়কার। তবে দেশবাসীকে না জানিয়েই, ক্ষমতায় একযুগেরও বেশি সময় কাটানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। পালিয়ে যান ভারত অভিমুখে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া বাংলাদেশ ছিল রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত এবং চরম অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত একটি রাষ্ট্র। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ভয়াবহভাবে অবমূল্যায়িত, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম কার্যত অচল এবং প্রবাসী আয় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে না পেরে হতাশায় ভুগছিলেন, সাধারণ মানুষ হাহাকার করছিলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে। এই আর্থিক বিপর্যয়ের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার এবং কেন্দ্রীভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুঃশাসন।

বিশেষ করে আলোচনায় উঠে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম, যিনি ছিলেন তথাকথিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বহুবার। তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান দাবী করেন, তিনি জয়কে আগেই এ বিষয়ে অবহিত করেছিলেন, কিন্তু জয় তা চেপে গিয়ে এক ভারতীয় পরামর্শকের মাধ্যমে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সেই থেকেই শুরু হয় রিজার্ভ সংকট, যার ফলশ্রুতি হয় বৈদেশিক লেনদেনের ধস, ঋণের পাহাড় এবং বিনিয়োগের অবসান।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও দেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ভারতের প্রতি অতিনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই দিল্লির ছায়ানীতির অনুসারী হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্তে বিএসএফ-এর গুলিতে প্রাণহানি, কূটনৈতিক নিঃসাড়াবস্থা এবং আঞ্চলিক দখলদারিতার বিরুদ্ধে নিরব ভূমিকা জনগণের আস্থাকে তীব্রভাবে আঘাত করে। এই রাজনৈতিক দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি অনিবার্য বিপর্যয়ের পরিবেশ, যার পরিণতিতে শেখ হাসিনার গোপন দেশত্যাগ একটি নৈতিক পতনের প্রতীক হয়ে ওঠে।

এই শূন্যতার মুহূর্তে জাতীয় দায়িত্ব নেয় একটি অরাজনৈতিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আসেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস। রাজনৈতিক দলনির্ভরতার বাইরে গঠিত এক ব্যতিক্রমধর্মী নাগরিক-প্রশাসনিক জোটের সমর্থনে তিনি শুধু নীতিনির্ধারক নন, বরং দেশের কার্যকরী প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। তার অর্থনৈতিক দর্শন ছিল একেবারে ভিন্নধর্মী: রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজি নয়, মানবিক অর্থনীতি—যেখানে জনগণের ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক ন্যায্যতাই হবে সমৃদ্ধির ভিত্তি। তার নেতৃত্বে সরকার তিনটি মূল খাতে সংস্কার শুরু করে: প্রথমত, প্রবাসী আয় ও রেমিটেন্স পুনরুজ্জীবন; দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক ঋণ হ্রাস এবং সময়মতো পরিশোধ; তৃতীয়ত, আমদানি ও জ্বালানি খাতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি।

এই নীতির সফল বাস্তবায়নের ফলে রেমিটেন্স খাতে ঘটে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। সরকার ব্যাংক চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর উপর বিশেষ প্রণোদনা চালু করে, যার ফলে ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই দেশে আসে ৩.২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স—বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এপ্রিলের প্রথম ১২ দিনেই আসে আরও ১.০৫ বিলিয়ন ডলার। এই প্রণোদনা কেবল বৈধ লেনদেনকে উৎসাহ দেয়নি, বরং হুন্ডির মত অসাধু পথ একেবারেই ভেঙে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মোট রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৬.৭৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আইএমএফ অনুমোদিত ব্যয়যোগ্য নেট রিজার্ভ ছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার—যা আগের সরকার কখনো প্রকাশই করেনি।

ইউনুস সরকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে গ্রহণ করে কঠোর এককনীতি। মাত্র আট মাসে ২৯ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ শোধ করা হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল কাতারের কাছে কয়েকশো মিলিয়ন ডলারের ঋণ সম্পূর্ণভাবে পরিশোধ করা, যার ফলে কূটনৈতিক সম্পর্কেও আসে এক নতুন ভারসাম্য। গ্যাস ও এলএনজি খাতে ৬,৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি দিয়ে গ্যাসের ইউনিটপ্রতি দাম ৭০ টাকা থেকে ৩০ টাকায় নামানো হয়। এর ফলে শিল্প উৎপাদনের খরচ কমে আসে, বিদ্যুৎ খাতে সাশ্রয় হয় এবং জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় হ্রাস পায়। একই সঙ্গে গ্যাস বিলের বকেয়া ৭৫ কোটি টাকা থেকে কমে আসে মাত্র ২৪ কোটিতে।

প্রফেসর ইউনুসের নেতৃত্ব শুধু দেশের ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল না; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ ব্যাপক প্রশংসা পায়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, "একটি দেশের প্রকৃত শক্তি তার মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় নিহিত।" তার এই বক্তব্যে বিশ্বমঞ্চে প্রশংসার ঝড় ওঠে। ব্লুমবার্গ তাদের বিশ্লেষণে লেখে, "বাংলাদেশ এখন বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে নিজের শর্তে।" দ্য ইকোনমিস্ট মন্তব্য করে, "ইউনুসের ব্যাংক-টু-বেসিকস নীতি দক্ষিণের দেশগুলোর জন্য নতুন প্রোটোটাইপ।" এছাড়াও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশকে 'সাউথ এশিয়ার নিউ ফাইন্যান্সিয়াল মডেল' হিসেবে আখ্যা দেয়।

এই সবকিছু মিলিয়ে বোঝা যায়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে অধ্যাপক ইউনুস একটি বাঁকবদলের নাম। তিনি শুধু একজন নীতিনির্ধারক ছিলেন না, ছিলেন এক দূরদর্শী পথপ্রদর্শক, যিনি প্রমাণ করেছেন যে শৃঙ্খলা, সুশাসন ও মানবিক দর্শন থাকলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার অসম্ভব কিছু নয়। তিনি দেখিয়েছেন, ইতিহাস কেবল রাজনীতির হাতে লেখা হয় না, অর্থনৈতিক সাহসিকতার প্রতিচ্ছবিও হয়ে উঠতে পারে একটি জাতির নবজাগরণের সূচনা।

আজ, ২০২৫ সালের মাঝামাঝিতে দাঁড়িয়ে যখন আমরা পেছনে তাকাই, তখন স্পষ্ট দেখতে পাই যে ৫ আগস্ট ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নবজন্মের দিন। শেখ হাসিনার ছায়া যখন ঢাকার আকাশ থেকে বিদায় নেয়, তখন অন্ধকারের বুক চিরে উঠে আসে এক নতুন সূর্য—যার নাম প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে—এইবার শুধুই প্রতিশ্রুতির নয়, বাস্তবায়নের আত্মবিশ্বাস নিয়ে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত