বিশ্লেষণ

জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব: ছায়া নাকি বাস্তবতা?

২০২৫ মে ২৮ ২০:২৬:১৪
জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব: ছায়া নাকি বাস্তবতা?

ঢাকা, জাতীয় প্রেস ক্লাব, দুপুর ২টা। হলরুমে যেন ঘনীভূত এক অজানা উত্তেজনা। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ফিসফাসে মেতে উঠেছেন সাংবাদিকরা। কেউ জানেন না ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎ মঞ্চে উঠে আসেন এক সাবেক সচিব। ভিড়ের মধ্যে হাত তুলে থামিয়ে দেন গুঞ্জন। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি জানান, “জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত।”

ঘোষণা আসে—প্রস্তাবিত জাতীয় সরকারে তারেক রহমান হবেন প্রধানমন্ত্রী, ড. শফিকুর রহমান উপ-প্রধানমন্ত্রী, আর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে থাকবেন নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। মুহূর্তেই যেন থমকে যায় পুরো হলরুম। বাইরের ঝলমলে দুপুর তখন হলরুমে ডেকে আনে রাজনীতির ঘন ছায়া।

ছায়া থেকে উঠে আসা সরকার?

ঘোষণা অনুযায়ী, এই প্রস্তাবিত সরকারের কাঠামো ইতোমধ্যেই তৈরি। সূত্র জানাচ্ছে, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত বণ্টন হলো—বিএনপি ২৫%, জামায়াত ২০%, এনসিপি ১৫%, ইসলামী আন্দোলন ৫%, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ১০%, ও অন্যান্য দল ২৫%। তবে এই সরকারে কেউ পূর্ণমন্ত্রী হবেন না, সবাই হবেন প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী। এক কথায়, একটি কালেক্টিভ অথরিটি, যেখানে নীতিনির্ধারণ হবে একটি “ছায়া কেন্দ্র” থেকে। ওই কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত-নির্ধারক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনুস। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তাঁর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হবে বাস্তব ও কার্যকর, আর প্রধানমন্ত্রীর পদটি থাকবে প্রতীকী।

ড. ইউনুস: রাজনীতির নীরব অভিভাবক?

ড. ইউনুস রাজনীতিবিদ নন, তবে তাঁর উপস্থিতি প্রতিবারই নাড়িয়ে দেয় রাজনৈতিক বৃত্তকে। তাঁর গ্রামীণ অর্থনীতি দর্শনকে ঘিরে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রচিন্তার একটি নতুন কাঠামো। ঢাকার কূটনৈতিক অঞ্চলে ইতোমধ্যে গোপনে সক্রিয় হয়েছে একটি নতুন মোর্চা—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘের উপদেষ্টারা এবং আন্তর্জাতিক লবিস্টদের একাধিক বিশ্লেষণী রিপোর্ট ঘুরছে—একটি নিরাপত্তা কাঠামো ও একটি শহরভিত্তিক কর্মসংস্থান নীতিমালা নিয়ে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি এক নীরব অভিভাবকতন্ত্র—নির্বাচিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত গভর্নেন্স। এই “Bangladesh 2.0” মডেলে সংসদ ও মন্ত্রিসভা থাকবে ঠিকই, কিন্তু বাস্তব সিদ্ধান্ত আসবে ছায়া থেকে।

আওয়ামী লীগ নেই, দিল্লি দ্বিধায়

এই প্রস্তাবিত কাঠামোতে আওয়ামী লীগের কোনো স্থান নেই। শেখ হাসিনা সম্পর্কে বলা হচ্ছে, তিনি এখন দিল্লিতে ‘নির্বাসিত’। ভারত সরকারও এই পরিস্থিতিতে বিভক্ত। তারা কী শেখ হাসিনাকে ফেরত আনবে, নাকি নতুন চাল খেলবে? যদি তারেক রহমান ও ড. ইউনুসের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়, তবে তা নরেন্দ্র মোদি সরকারের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ—ঢাকায় একটি স্পষ্ট মোদি-বিরোধী অবস্থান। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ইউনুস ভারতের কাছে একটি কূটনৈতিক মাথাব্যথা।

বিএনপি কি মেনে নেবে?

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—বিএনপি কি এই প্রস্তাবনায় রাজি হবে? দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপি সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় বিরোধী দল। নির্বাচন হলে তাদের সরকার গঠনের সম্ভাবনাই শতভাগ বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। তাহলে কেন তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের যৌথ কাঠামোতে যেতে চাইবে? তারেক রহমান কি আদৌ এভাবে প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ করতে চাইবেন, যেখানে তিনি বাস্তব ক্ষমতার পরিবর্তে অংশীদারিত্বের নামমাত্র ভূমিকা পালন করবেন? অনেকেই মনে করছেন, এটি বিএনপির জন্য রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল হতে পারে।

শেষ কথা বলে কিছু নেই

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এমন প্রস্তাব অনেকভাবেই আসতে পারে, আবার নীরবেই ভেসে যেতে পারে বাতাসে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ, আন্তর্জাতিক কূটনীতির আগ্রহ, এবং আঞ্চলিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে এই আলোচনাগুলোকে নিছক জল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্লেষকেরা দ্বিধায়। এক পক্ষ এটিকে বলছে রাজনৈতিক বিবর্তনের মডেল—গণতন্ত্র নয়, কিন্তু দায়িত্বশীল গভর্নেন্স। অন্যপক্ষ বলছে, এটি কেবল একটি 'ডিল সরকার'—যেখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই, ভোট নেই, সংসদ নেই। সবকিছু চলছে কিছু কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক শক্তির ছায়াতলে।

বাংলাদেশ এখন এক সম্ভাব্য পালাবদলের মুখোমুখি। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এক বৃদ্ধ মানুষ—ড. ইউনুস। রাত তিনটায়ও ফোনে সচল, আলো নিভে যাওয়া প্রেস ক্লাবের বাইরেও তিনি থাকেন সক্রিয়। তাঁকে ঘিরেই চলছে ওয়াশিংটন, বেইজিং এবং দিল্লির নীরব আলোচনার ঝড়।

এখন শুধু অপেক্ষা—এই ছায়া সরকার প্রস্তাব বাস্তব হবে কিনা, নাকি থেমে যাবে গুঞ্জনের অতলে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত