ইরান-ইসরায়েল সংঘাত

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ডিজিটাল যুদ্ধ: সত্যের বিপরীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও বিভ্রান্তির উত্থান

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২১ ১০:৩৭:২৭
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ডিজিটাল যুদ্ধ: সত্যের বিপরীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও বিভ্রান্তির উত্থান

ইসরায়েল গত ১৩ জুন ইরানে সামরিক হামলা চালানোর পর, সামাজিক মাধ্যমে শুরু হয় এক নজিরবিহীন বিভ্রান্তির স্রোত। বিবিসি -এর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, সংঘাত শুরুর পর থেকেই শতাধিক ভুয়া ভিডিও এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে, যার বড় অংশই ইরানের পাল্টা জবাবকে অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরছে।

এই ভুয়া ভিডিওগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তিনটির সম্মিলিত ভিউ সংখ্যা পেরিয়েছে ১০ কোটি। অনেকেই বিশ্বাস করছেন এসব ভিডিও বাস্তব, বিশেষ করে যখন সেগুলো রাত্রিকালীন হামলা বা যুদ্ধবিমানের ধ্বংসের দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। টিকটক ও -এক্স এ এমন ভিডিওর ভিউ সংখ্যা কখনো কখনো একাই ২০–৩০ মিলিয়নের গণ্ডি ছাড়িয়েছে।

বিবিসি এমনি একটি জনপ্রিয় ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখতে পায়—যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটি পর্বতের গহ্বর থেকে অসংখ্য ট্রাক ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছে। দৃশ্যটি ছিল সম্পূর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-নির্মিত, যেখানে পাথর নিজের ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করছে এবং স্যান্ড ইম্প্যাক্টের কোনো চিহ্নই নেই। অথচ X-এর নিজস্ব AI চ্যাটবট Grok এই ভিডিওকে বাস্তব বলে দাবি করে, এমনকি Newsweek ও Reuters-এর রেফারেন্স দিয়ে।

ভুয়া ভিডিওর অনেকগুলিই কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে ইসরায়েলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ধ্বংসের গল্প, যেখানে দেখা যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-নির্মিত গ্রাফিকসে বিমান ধ্বংসের দৃশ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত এমন কোনো ভিডিও বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা এফ-৩৫ ধ্বংসের সত্যতা নিশ্চিত করে। এমনকি একটি ভিডিও তো সরাসরি ভিডিও গেমের ফ্লাইট সিমুলেটর থেকে নেওয়া, যা টিকটক পরবর্তীতে সরিয়ে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রথমবার এত বড় পরিসরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI ব্যবহৃত হচ্ছে একটি চলমান সামরিক সংঘাতে। বিশ্লেষক ইমানুয়েল সালিবা বলেন, “গণমানুষের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত করতে এই ডিজিটাল বিভ্রান্তি ভয়াবহভাবে কার্যকর হচ্ছে, বিশেষ করে যখন মানুষ দ্রুততর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।”

এদিকে, রাশিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাব চক্র, বিশেষ করে Alethea বিশ্লেষণ সংস্থার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তারাও এই বিভ্রান্তি তৈরিতে অংশ নিচ্ছে। লক্ষ্য একটাই—যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা অস্ত্র ও সামরিক সক্ষমতার উপর সন্দেহ তৈরি করা।

দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে, প্রো-ইসরায়েলি অ্যাকাউন্টগুলোও পিছিয়ে নেই। তারা পুরোনো বিক্ষোভ বা ইরানের অভ্যন্তরীণ ভাঙনের দৃশ্য নতুন করে পোস্ট করছে, দাবি করছে ইরানিরা ইসরায়েলের পক্ষ নিচ্ছে। একটি ভিডিওতে এমনও দাবি করা হয়, “আমরা ইসরায়েলকে ভালোবাসি”—এমন স্লোগান দিতে দেখা গেছে তেহরানের রাস্তায় মানুষকে, যা সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম ও বিভ্রান্তিকর।

এই বিভ্রান্তির একটি বড় অংশ ছড়াচ্ছে যেসব অ্যাকাউন্ট এক সময় ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ নিয়েও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে এসব অ্যাকাউন্ট 'ব্লু টিক'ধারী, বারবার ভুল তথ্য দিচ্ছে, অথচ তাদের আসল পরিচয় অজানা।

বিশেষজ্ঞ ম্যাথিউ ফাচিয়ানি বলেন, “সামাজিক মাধ্যমের আবেগনির্ভর কাঠামোই এই বিভ্রান্তিকে ত্বরান্বিত করছে। মানুষ এমন কিছু শেয়ার করে যা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে জোরালো করে, বিশেষ করে যখন বিষয়টি যুদ্ধ বা সংকট সংক্রান্ত হয়।”

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর জন্য অনেকে আর্থিক পুরস্কারও পাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো যেহেতু ভিউয়ের ভিত্তিতে মনেটাইজেশন চালু করেছে, তাই ‘এঙ্গেজমেন্ট ফার্মার’রা সংঘাতকে পুঁজি করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে।

এমন এক সময়ে, যখন সত্য তথ্য মানুষের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন প্রযুক্তি এবং নীতিহীন প্রচারের সম্মিলিত আগ্রাসনে অনলাইনে বাস্তবতা আর মিথ্যার পার্থক্য চেনা কঠিন হয়ে পড়ছে।

-সুত্র - বিবিসি

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত