আল জাজিরা বিশ্লেষণ

একটি শত্রু রাষ্ট্র কীভাবে ইরানের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠল?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২০ ১৫:৪৫:১৭
একটি শত্রু রাষ্ট্র কীভাবে ইরানের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠল?

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ইরানবিরোধী হামলা এক যুগান্তকারী পর্বের সূচনা করেছে। এটি নিছক কোনো লক্ষ্যভিত্তিক সামরিক অপারেশন নয়; বরং এক জটিল রাজনৈতিক পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ, যা কয়েক দশক ধরে গঠিত হয়েছে। মিসাইল সাইলো বা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলার পাশাপাশি এ অভিযানে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে ইরানের সামরিক নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে। বিশেষ করে আইআরজিসি’র (Islamic Revolutionary Guard Corps) শীর্ষ কমান্ডার হোসেইন সালামি, মহাকাশ বাহিনীর প্রধান আমির আলি হাজিজাদেহ এবং সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি’র হত্যাকাণ্ড এই সংঘাতের তাৎপর্য বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এই প্রথমবার ইরানের সামরিক নেতৃত্ব এত বড় ধাক্কা খেল।

ইসরায়েল সরকার একে ‘প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও বিশ্লেষকদের মতে এর অন্তর্নিহিত কৌশল আরও সুদূরপ্রসারী। মূল লক্ষ্য সম্ভবত ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ধ্বংস এবং ইরানের ভেতরে এক অভ্যন্তরীণ গণঅসন্তোষের সৃষ্টি করা। ইসরায়েল এবং তার কিছু মার্কিন মিত্র দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বাস করে আসছে, ইরানের পরমাণু উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে সরকার পরিবর্তন—regime change। এই সামরিক অভিযান তাই কেবল আক্রমণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক চাপ, রাজনৈতিক উসকানি এবং সাইবার হামলার মতো আধুনিক যুদ্ধকৌশল। তেহরানে রাষ্ট্রীয় মন্ত্রণালয় ও সরকারি ভবনের ওপর চালানো সাইবার হামলা, এমনকি জাতীয় সম্প্রচার ব্যবস্থার অস্থায়ী অচলাবস্থাও তার প্রমাণ।

ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকরা বেসরকারিভাবে স্বীকার করেছেন, ইরানের গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে ৫০০ মিটার নিচে থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা তাদের পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয়। এ কাজের জন্য প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের B-2 বা B-52 স্ট্র্যাটেজিক বোমারু বিমানে ব্যবহৃত GBU-57 বোমা, যা ইসরায়েলের হাতে নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে তাদের মূল্যায়ন—সরকার পতন ছাড়া ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামানো সম্ভব নয়।

এই প্রেক্ষাপটে ইসরায়েল সরাসরি ইরানি জনগণের দিকে মনস্তাত্ত্বিক বার্তা ছুঁড়ে দিয়েছে। তারা আইআরজিসি’কে জাতির রক্ষক নয়, বরং ‘জনগণের শত্রু’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইছে। "This is not Iran’s war, it’s the regime’s war"—এই স্লোগান দিয়ে তারা প্রজাতন্ত্র ও জাতির মাঝে কৃত্রিম বিভাজন তৈরি করতে চাইছে। এই প্রচার প্রচেষ্টায় যোগ দিয়েছেন বিদেশে অবস্থানরত বিরোধী নেতারা—যেমন সাবেক শাহ রেজা পাহলভির পুত্র এবং প্রাক্তন ফুটবলার আলি করিমি।

কিন্তু এই কৌশল প্রত্যাশিত ফল দেয়নি। বরং এই হামলা ইরানি সমাজে এক জাতীয় প্রতিরোধের আবেগ তৈরি করেছে। এমনকি সরকারবিরোধী বহু নাগরিকও এই মুহূর্তে বিদেশি হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করছেন। ইতিহাসের স্মৃতি, বিশেষ করে ১৯৫৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যুত্থান এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধ, মানুষের মনে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। অনেকের জন্য এখন আলোচনা ‘রেজিম পরিবর্তন’ থেকে সরে এসে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা’-তে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।

২০২২ সালে মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ আন্দোলনের যে তরঙ্গ তৈরি হয়েছিল, সেই আন্দোলনের অনেক অংশগ্রহণকারীকেও এই হামলার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিতে দেখা গেছে। ধ্বংসস্তূপ, নিহত সৈনিক এবং আহত নাগরিকদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা কিছু সময়ের জন্য সহানুভূতিতে রূপ নেয়। একটি সাময়িক সংহতি গড়ে ওঠে, যেটি সরকারকে নয়, বরং পুরো জাতিকে ঘিরে।

এই পরিস্থিতিতে ইরানের বহু প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর স্পষ্টভাবে ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। কিংবদন্তি ফুটবলার আলি দায়ি ঘোষণা দেন, “আমি মরতে পারি, কিন্তু কখনো দেশদ্রোহী হতে পারি না।” সাবেক বিচারক ও রাজনৈতিক বন্দি মোহসেন বোরহানি লেখেন, “আমি মাতৃভূমির সব রক্ষকের হাতে চুমু দিই”—একটি আবেগঘন বিবৃতি যা সামরিক বাহিনীর প্রতি নাগরিক শ্রদ্ধার ইঙ্গিত দেয়।

সব মিলিয়ে, ইসরায়েলের এই কৌশলমূলক হামলা হয়তো সাময়িক সামরিক সাফল্য এনে দিয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে এটি আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধ কখনো কেবল মিসাইল বা বোমায় জয়ী হয় না; জনমতের যুদ্ধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেখানেই ইরান এখনো দৃঢ় অবস্থানে।

সূত্র:আল জাজিরা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত