মতামত

ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক:  সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ

রাইয়ান হোসেন
রাইয়ান হোসেন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ জুন ১৪ ২৩:৪১:০৪
ইউনূস-তারেক ঐতিহাসিক ও সফল বৈঠক:  সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিন স্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ

লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর মধ্যে আজকের একান্ত বৈঠকটি শুধু প্রতীকী নয়, এটি হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পুনর্গঠনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। গণতন্ত্রের পথে ফেরার এই উদ্যোগ এমন এক সময়ে এল, যখন দেশ একটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের ছায়া থেকে সদ্য মুক্ত হয়েছে — একটি ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতা-শ্রমিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।

বৈঠকটি লন্ডনের নিরপেক্ষ প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়ায় দুই নেতাই তাঁদের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে পেরেছেন। সূত্র জানায়, উভয়ের আলোচনাই ছিল আন্তরিক, বাস্তববাদী এবং জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী একটি গণতান্ত্রিক রূপরেখা তৈরিতে আগ্রহী।

বিশ্বজুড়ে নন্দিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ইউনূস এখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের কেন্দ্রে। তাঁর নৈতিক অবস্থান এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা অন্তর্বর্তী সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। অপরদিকে, দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তারেক রহমান এই প্রথম প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এই ঐতিহাসিক বৈঠকটি তাই স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে— গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সঠিক পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা-শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত বিপ্লব ছিল কেবল একটি সরকার পতনের আন্দোলন নয়; এটি ছিল রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার পুনর্গঠনের ডাক। সেই আন্দোলনের শহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা তখনই জানানো হবে, যখন অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ঘোষিত তিনটি মূল প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আপসহীন থাকবে:

রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার: বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করে জনগণের জন্য কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।

অতীতের নিপীড়নের বিচার: গুম, খুন, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিচার একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন: সকল গণতান্ত্রিক দল, মিডিয়া ও জনগণের সম্পৃক্ততায় একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।

এই তিনটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাই এখন সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। এর ব্যত্যয় মানেই হবে জনগণের বিশ্বাসভঙ্গ এবং শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অপমান।

এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো— একে অপরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে না দেখে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের পক্ষে একত্রে কাজ করা। যারা ফ্যাসিবাদী সরকারে অংশ নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বর্জিত রাখা উচিত। কিন্তু যারা এই রূপান্তরের পক্ষে ছিল, তাদের উচিত দলমত ভুলে একসাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া। প্রত্যেক রাজনৈতিক শক্তিকে এখন জনগণের কাছে ফিরতে হবে, আস্থা ফেরাতে হবে, এবং একটি নতুন উন্নয়ন ও ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ নির্মাণে অংশ নিতে হবে।

বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক মোড়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে আমরা পুনরায় একবার গণতন্ত্রকে বেছে নিতে পারি— কিংবা আবারও ভুল পথে ফিরে যেতে পারি। এই সুযোগ হারানো মানে শুধু একটি রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়— বরং তা হবে আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া।

আর যদি আমরা সফল হই, তবে এই অন্তর্বর্তী সময়টিই হবে উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য একটি গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মডেল।

এই মুহূর্তে আমাদের স্লোগান হতে হবে— “আগে দেশ”। দল নয়, গোষ্ঠী নয়, ব্যক্তি নয়— বাংলাদেশের জনগণের অধিকার ও ভবিষ্যৎই হোক আমাদের একমাত্র অগ্রাধিকার। সংস্কার, একতা ও ন্যায়বিচার— এই তিনস্তম্ভে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ।

জনগণ তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। এখন নেতাদের পালা— দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সত্যিকারের দায়িত্ব পালনের।

-রাইয়ান হোসেন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি,বাংলাদেশ (আইইউবি) এর গ্লোবাল স্টাডিজ ও গভার্নেন্স বিভাগে লেকচারার হিসেবে নিযুক্ত। তবে তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটিতে "রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক" এর উপরে পিএইচডি করছেন। ইমেইল: [email protected]

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত