মুক্তা থেকে রিয়েল এস্টেট: যেভাবে ৫০ বছরে মরুভূমিকে সম্পদে পরিণত করলো দুবাই

দেশ-মহাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ অক্টোবর ০৫ ১৯:০৯:৩৬
মুক্তা থেকে রিয়েল এস্টেট: যেভাবে ৫০ বছরে মরুভূমিকে সম্পদে পরিণত করলো দুবাই
ছবি: সংগৃহীত

দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত – আজ যেখানে মরুভূমির বুকে শপিং মলের ভেতরে আইস স্কেটিং চলে এবং উবারের মতো অ্যাপে হেলিকপ্টার ভাড়া করা যায়, সেই দুবাইয়ের উত্থানের গল্প যেকোনো কল্পনাকেও হার মানায়। মাত্র অর্ধশতাব্দীর ব্যবধানে মুক্তা আহরণকারী জেলেদের একটি সাধারণ বসতি থেকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার পেছনে রয়েছে এক অবিশ্বাস্য রূপান্তরের ইতিহাস। এটি কোনো দেশের রাজধানী নয়, এমনকি একটি স্বতন্ত্র দেশও নয়; কেবল একটি আমিরাত বা রাজ্য হয়েও দুবাই নিজেকে এক গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা ও তেলের বাস্তবতা

একসময় পুরো আরব উপদ্বীপ ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন তারা এই বিশাল অঞ্চল শাসনের ব্যয়ভার বহন করতে অপারগ হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এই অঞ্চল স্বাধীনতা লাভ করে এবং সাতটি আমিরাত মিলে গঠিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)।

অনেকেরই একটি সাধারণ ধারণা হলো, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের মতো দুবাইও তেলের টাকায় ধনী হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ঠিক তার উল্টো। প্রতিবেশী কাতার, সৌদি আরব বা এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি তেল হলেও, ১৯৭১ সালে দুবাইয়ের জিডিপিতে তেলের অবদান ছিল শূন্য শতাংশ। বর্তমানেও তা মাত্র ১ শতাংশের কাছাকাছি। তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকায় স্বাধীনতার পর অনেকেই দুবাইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ ছিলেন এবং উন্নত জীবনের আশায় বহু মানুষ আবুধাবি বা অন্যান্য রাজ্যে পাড়ি জমান।

শেখ রশিদের দূরদর্শী পরিকল্পনা ও চার স্তম্ভের কৌশল

এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই দৃশ্যপটে আসেন দুবাইয়ের আধুনিক রূপকার শেখ রশিদ বিন সাঈদ আল মাকতুম। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে টিকে থাকতে হলে দুবাইকে ভিন্ন পথে হাঁটতে হবে। তিনি মুক্তা বা মাছের অর্থনীতির ওপর নির্ভর না করে চারটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে এক দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১. বিশ্বমানের অবকাঠামো: শেখ রশিদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ছিল অবকাঠামো নির্মাণ। ১৯৬০ সালে তিনি ঋণ করে দুবাই বিমানবন্দর নির্মাণ করেন। তখন অনেকেই উপহাস করে বলেছিল, এই মরুভূমিতে কে আসবে? কিন্তু তার দূরদৃষ্টি ছিল স্পষ্ট। তিনি জানতেন, বিশ্বকে সংযুক্ত করতে না পারলে অগ্রগতি অসম্ভব। বিমানবন্দরের পাশাপাশি মরুভূমির বুকে গড়ে তোলা হয় আধুনিক রাস্তা, সেতু এবং ফ্লাইওভার।

২. ব্যবসা ও বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য: শুধু উন্নত রাস্তাঘাট বা বিমানবন্দর ব্যবসা আনার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জেবেল আলি ফ্রি জোন (Jafza)। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করতে এখানে কর ছাড়, শুল্কমুক্ত বাণিজ্য এবং শতভাগ মালিকানার মতো যুগান্তকারী সব সুবিধা দেওয়া হয়। এই মডেলটি এতটাই সফল হয় যে পরবর্তীতে দুবাইতে ৩০টিরও বেশি ফ্রি জোন গড়ে ওঠে। কেবল জাফজা থেকেই বর্তমানে বার্ষিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব আসে এবং সেখানে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ কাজ করে।

৩. নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা: শেখ রশিদ জানতেন, ব্যবসার প্রসারের জন্য নিরাপত্তা অপরিহার্য। দুবাইকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ শহরগুলোর একটি হিসেবে গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়। এর ফলও মিলেছে হাতেনাতে। গত সাত বছরে, সাধারণ অপরাধের হার ক্রমাগত কমেছে। বর্তমানে শহরটির সেফটি ইনডেক্স ৮৩.৭৩, যা বিশ্বের সর্বোচ্চগুলোর মধ্যে একটি। আইন প্রয়োগে কঠোরতা এবং উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা বিনিয়োগকারী ও বাসিন্দা উভয়ের মধ্যেই আস্থা তৈরি করেছে।

৪. রিয়েল এস্টেট ও পর্যটন: ২০০২ সালে দুবাই তার রিয়েল এস্টেট খাত বিদেশীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়, যা ছিল আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বিনিয়োগকারীরা দুবাইতে সম্পত্তি কেনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ফলে এক বিশাল নির্মাণযজ্ঞ শুরু হয়; এক পর্যায়ে বিশ্বের মোট নির্মাণ ক্রেনের ২৫ শতাংশই দুবাইতে কর্মরত ছিল। এই সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এই নির্মাণ কাজে যোগ দেন, যদিও তাদের কর্মপরিবেশ এবং অধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনাও হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণের পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পকে একটি পর্যটন আকর্ষণে পরিণত করার কৌশল নেওয়া হয়। কেবল উঁচু ভবন নয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন (বুর্জ খলিফা); কেবল বড় শপিং মল নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শপিং মল (দুবাই মল) তৈরি করা হয়। দুবাইয়ের লক্ষ্য ছিল সাধারণ পর্যটক নয়, বরং উচ্চ-ব্যয়কারী পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, যারা বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং কেনাকাটার জন্য আসবেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা: মেধা ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র

আজ দুবাই মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বিশ্বের তৃতীয় ধনী শহর। তবে তারা এখানেই থেমে নেই। তাদের বর্তমান লক্ষ্য হলো বিশ্বের সেরা মেধাবী, উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবকদের জন্য একটি আদর্শ কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। ০% ব্যক্তিগত ও কর্পোরেট ট্যাক্স, এক ঘণ্টার মধ্যে কোম্পানি গঠন এবং উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ভিসার মতো উদ্যোগগুলো সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।

দুবাইয়ের এই ৫০ বছরের যাত্রা প্রমাণ করে যে, সঠিক নেতৃত্ব, দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো প্রতিকূলতাকেই সম্ভাবনায় পরিণত করা সম্ভব।

/আশিক


সভ্যতার সঙ্গমস্থল আফগানিস্তান: ইতিহাস, সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের এক দীর্ঘ যাত্রা

২০২৫ অক্টোবর ০৫ ১৭:২৯:২৬
সভ্যতার সঙ্গমস্থল আফগানিস্তান: ইতিহাস, সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের এক দীর্ঘ যাত্রা
ছবি: আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরীফের কেন্দ্রস্থলে অবস্থি নীল মসজিদ

আফগানিস্তান—এক নাম, যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির সংঘর্ষ এক জটিল সিম্ফনিতে গেঁথে আছে। একদিকে এটি এশিয়ার হৃদয়ে অবস্থিত সভ্যতার সংযোগস্থল, অন্যদিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি যুদ্ধ, বিদেশি আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। ভৌগোলিক অবস্থান এটিকে যেমন বাণিজ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্র বানিয়েছে, তেমনি করেছে এক অস্থির রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের প্রতীক।

ভৌগলিক অবস্থান:

আফগানিস্তান (আনুষ্ঠানিক নাম: Islamic Emirate of Afghanistan) দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মিলনবিন্দুতে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এর পূর্ব ও দক্ষিণে পাকিস্তান, পশ্চিমে ইরান, উত্তরে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান এবং উত্তর–পূর্ব কোণে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে। আয়তন প্রায় ৬,৫২,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার অধিকাংশ অংশজুড়ে বিস্তৃত হিন্দুকুশ পর্বতমালা।

ছবি:মানচিত্রে আফগানিস্তান

দেশটির ভূপ্রকৃতি কঠিন ও শুষ্ক, পাহাড়, উপত্যকা ও মরুভূমি মিলিয়ে এক বৈচিত্র্যময় ভূদৃশ্য তৈরি করেছে। খাইবার পাস ও সালাং পাস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সংযোগপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আফগানিস্তানের জলবায়ু প্রধানত শুষ্ক; গ্রীষ্মে গরম ও শীতকালে হিমশীতল। আমু দরিয়া, হেলমান্দ ও কাবুল নদী কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলসম্পদ।

ইতিহাস

আফগানিস্তানের ইতিহাস মানবসভ্যতার প্রাচীন অধ্যায় পর্যন্ত প্রসারিত। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়, আর খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে এটি ছিল আকেমেনীয় পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ। পরে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর অভিযান, কুশান সাম্রাজ্য, গজনবী ও গুরিদ রাজবংশ, এবং ইসলামী যুগে বহু রাজবংশের উত্থান-পতন এই ভূখণ্ডকে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিয়েছে (Dupree, 1973)।

১৯শ শতকে এটি ছিল তথাকথিত “গ্রেট গেম”–এর কেন্দ্র—ব্রিটিশ ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে এক ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। দীর্ঘ প্রতিরোধের পর ১৯১৯ সালের তৃতীয় অ্যাংলো–আফগান যুদ্ধ স্বাধীনতা এনে দেয় রাজা আমানুল্লাহ খান–এর নেতৃত্বে। রাজতন্ত্র টিকে ছিল ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত, এরপর শুরু হয় এক অস্থির রাজনৈতিক অধ্যায়—সোভিয়েত আগ্রাসন (১৯৭৯–৮৯), গৃহযুদ্ধ, তালেবান শাসন (১৯৯৬–২০০১), এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন দখল (২০০১–২০২১)। অবশেষে আগস্ট ২০২১–এ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় Islamic Emirate of Afghanistan।

শাসনব্যবস্থা

আফগানিস্তানের শাসন কাঠামো ইতিহাস জুড়ে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে—রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সমাজতান্ত্রিক শাসন থেকে শুরু করে ইসলামী আমিরাত পর্যন্ত। বর্তমানে দেশটি তালেবানদের অধীনে একটি ধর্মভিত্তিক আমিরাত, যেখানে শাসনের মূল ভিত্তি হলো শরিয়াহ আইন। সর্বোচ্চ ক্ষমতা আমির আল মুমিনিন (Hibatullah Akhundzada)–এর হাতে কেন্দ্রীভূত।

সংবিধান, সংসদ বা নির্বাচনী কাঠামো অনুপস্থিত; সিদ্ধান্ত আসে ধর্মীয় নেতৃত্বের পরামর্শ ও ফতোয়ার ভিত্তিতে। প্রশাসনিকভাবে দেশটি প্রদেশ ও জেলায় বিভক্ত, যেখানে গভর্নর ও আলেম কাউন্সিল দায়িত্ব পালন করে। তবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অভাব ও অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যের কারণে শাসনব্যবস্থা কার্যকারিতা অর্জন করতে পারছে না।

সংস্কৃতি

আফগান সংস্কৃতি মধ্য এশিয়া, পারস্য, ভারত ও আরব সভ্যতার সংমিশ্রণ। দেশটির প্রধান জাতিগোষ্ঠী হলো পশতুন, তাজিক, হাজারাস ও উজবেক। প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, পোশাক, সংগীত ও আচার-অনুষ্ঠান আফগান পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কবিতা ও মৌখিক কাহিনিচর্চা আফগান সংস্কৃতির প্রাণ। জালালউদ্দিন রুমি ও আবদুল কাদির বেদিলের মতো কবিরা এখানকার সাহিত্যঐতিহ্যের গর্ব। সংগীতে রুবাব, তবলা ও দোলক ব্যবহৃত হয়, আর আফগান কার্পেট ও সূচিশিল্প আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। আতিথেয়তা (melmastia) ও সম্মানবোধ (nang) পশতুন সমাজে সামাজিক মূল্যবোধের কেন্দ্র।

ধর্ম

জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশ মুসলিম; এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ সুন্নি (হানাফি) ও ১০ শতাংশ শিয়া (প্রধানত হাজারা সম্প্রদায়)। ইসলাম আফগান সমাজের আইনি, শিক্ষাগত ও পারিবারিক কাঠামোর ভিত্তি।

ইসলাম আগমনের আগে এই ভূখণ্ডে বৌদ্ধ, জরাথুস্ত্রী ও হিন্দুধর্মের চিহ্ন পাওয়া যায়। বামিয়ান বুদ্ধ মূর্তি, যদিও ২০০১ সালে ধ্বংস করা হয়, এই প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য। আজকের আফগানিস্তানে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা প্রবল, বিশেষত নারীর শিক্ষা ও সামাজিক অংশগ্রহণ সীমিত।

রাজনীতি

আধুনিক আফগানিস্তানের রাজনীতি মূলত অনিশ্চয়তা ও সংঘর্ষের ইতিহাস। ২০০৪–২০২১ সাল পর্যন্ত Islamic Republic of Afghanistan ছিল একটি নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা, কিন্তু দুর্নীতি ও বৈদেশিক নির্ভরতা এর স্থায়িত্ব নষ্ট করে। ২০২১ সালে তালেবানের পুনরাগমনের পর দেশটি আবারও একক দলীয় ইসলামী শাসনে ফিরে যায়।

ছবি- তালেবান শাসনের তৃতীয় বর্ষ উদযাপন

রাজনৈতিক বহুত্ববাদ বা বিরোধী দলের কার্যকারিতা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির অভাবে কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা গভীর হয়েছে, যা অর্থনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতিকে আরও সংকটে ফেলেছে।

অর্থনীতি

আফগানিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা এক জটিল বৈপরীত্যের মধ্যে অবস্থান করছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, বৈদেশিক সহায়তা বন্ধ হওয়া এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার স্থবিরতায় অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি আঞ্চলিক বাণিজ্য, সীমিত কর আদায় এবং খনিজ সম্পদ উত্তোলন থেকে কিছুটা স্থিতিশীলতা খুঁজছে। কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসা এখনো জনজীবনের প্রধান অবলম্বন। তবে বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্যনিরাপত্তা সংকট এবং নারীর কর্মসংস্থান নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আফগানিস্তানের লিথিয়াম ও খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়।

প্রাকৃতিক সম্পদ

আফগানিস্তান বিশ্বের অন্যতম খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। এতে রয়েছে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম, তামা, লোহা, সোনা, কোবাল্ট ও রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস—যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার (USGS, 2010)। এই সম্পদ বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

কৃষিই দেশের মূল পেশা; জনগণের প্রায় ৬০% কৃষিকাজে নিয়োজিত। প্রধান ফসল গম, বাদাম, আঙুর, ডালিম ও আফিম। দীর্ঘ যুদ্ধ, খরা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা কৃষি উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আফগানিস্তান অপূর্ব। হিন্দুকুশ ও পামির পর্বতমালার তুষারাচ্ছন্ন চূড়া, বামিয়ানের বন্দে আমির হ্রদসমূহ, এবং দূরবর্তী ওয়াখান করিডর—সবই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপটে ভরপুর।

ছবি:বন্দে আমির হ্রদ

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিক থেকেও দেশটি অনন্য। হেরাত, বালখ ও কান্দাহার ইতিহাসে জ্ঞানের ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। জামের মিনার (UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্য) মধ্যযুগীয় ইসলামি স্থাপত্যের এক অমূল্য নিদর্শন। বামিয়ানের মূর্তিগুলির ধ্বংসাবশেষ আজও স্মরণ করিয়ে দেয়, কেমনভাবে ইতিহাস ও বিশ্বাসের সংঘাত এক জাতির স্মৃতিকে রূপান্তরিত করেছে।

ছবি:জামের মিনার

আন্তর্জাতিক সদস্যপদ

২০২১ সালের আগে আফগানিস্তান জাতিসংঘ (UN), ইসলামিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (OIC), দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (SAARC) ও ইকোনমিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (ECO)-এর সদস্য ছিল।

বর্তমানে তালেবান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়, ফলে কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দ্বৈততা তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংস্থায় পূর্বতন সরকারের প্রতিনিধিরাই আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানের আসন ধরে রেখেছে। তবুও চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো কৌশলগত কারণে তালেবান সরকারের সঙ্গে সীমিত যোগাযোগ বজায় রেখেছে।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

আফগানিস্তানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো—দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের পরিণতি, অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্যসংকট, ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। বিশেষত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ, কর্মসংস্থান সীমিত, এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণাধীন—যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথে বড় বাধা।

তবু সম্ভাবনাও অমলিন। ভৌগোলিক অবস্থান আফগানিস্তানকে এশিয়ার বাণিজ্য ও শক্তি সংযোগের কেন্দ্র করতে পারে। TAPI গ্যাস পাইপলাইন ও CASA–1000 বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশটিকে আঞ্চলিক সহযোগিতার সেতুতে পরিণত করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ও নারীর শিক্ষা ও অধিকারের নিশ্চয়তা।

আফগানিস্তান ইতিহাসের এক বিস্ময়কর প্যারাডক্স—অসীম সম্পদ ও গৌরবময় ঐতিহ্যের দেশ, অথচ অনন্ত সংঘর্ষ ও অনিশ্চয়তার আবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভূমি যেমন সাম্রাজ্যের কবরস্থান, তেমনি সভ্যতার জন্মভূমি। আফগান জনগণের সহনশীলতা, কবিত্ব ও সাহস এই দেশকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে।

যদি আফগানিস্তান একদিন ধর্ম ও স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজে পায়, তবে এটি আবারও হয়ে উঠতে পারে সেই ঐতিহাসিক ভূমি—যেখানে সভ্যতাগুলো মিলিত হয়, ধ্বংস নয়।

তথ্যসূত্র:

Dupree, L. (1973). Afghanistan. Princeton University Press.

U.S. Geological Survey (USGS). (2010). Afghanistan Nonfuel Mineral Resources Map.

Barfield, T. (2010). Afghanistan: A Cultural and Political History. Princeton University Press.

Rashid, A. (2021). Taliban: Militant Islam, Oil and Fundamentalism in Central Asia (3rd ed.). Yale University Press.

Rubin, B. R. (2013). Afghanistan from the Cold War through the War on Terror. Oxford University Press.

United Nations Development Programme (UNDP). (2023). Afghanistan: Socioeconomic Outlook 2023.

World Bank. (2024). Afghanistan Development Update: Challenges and Prospects.


আফ্রিকার হৃদয়ে পাথরের রাজ্য: জিম্বাবুয়ের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও আত্মার গল্প

দেশ-মহাদেশ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ অক্টোবর ০৪ ১৭:০৫:১৫
আফ্রিকার হৃদয়ে পাথরের রাজ্য: জিম্বাবুয়ের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও আত্মার গল্প
ছবি- ভিক্টোরিয়া ফল, জিম্বাবুয়ে।

আফ্রিকার মানচিত্রে এমন একটি দেশ রয়েছে, যার নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার আত্মপরিচয়—জিম্বাবুয়ে, অর্থাৎ “পাথরের ঘর।” এক সময় আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্র, আজ নানা সংকট, সংগ্রাম ও আশার প্রতীকে পরিণত এই দেশ। প্রাচীন ইতিহাস, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, অনন্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মিশেলে জিম্বাবুয়ে এক আশ্চর্য জটিল অথচ প্রাণবন্ত রাষ্ট্রচিত্র উপস্থাপন করে।

ভৌগলিক অবস্থান

জিম্বাবুয়ে (আনুষ্ঠানিক নাম: রিপাবলিক অব জিম্বাবুয়ে) আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। এর উত্তর-পশ্চিমে জাম্বিয়া, পূর্বে মোজাম্বিক, দক্ষিণে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং পশ্চিমে বোতসোয়ানা সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র। প্রায় ৩,৯০,৭৫৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়—উচ্চভূমি, পাহাড়, সমতল ও নদী উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত। দেশের কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি বা “হাইভেল্ড” অঞ্চল কৃষি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র, যার গড় উচ্চতা প্রায় ১,২০০ মিটার। প্রধান দুটি নদী হলো জাম্বেজি (উত্তর সীমান্তে) ও লিম্পোপো (দক্ষিণ সীমান্তে)।

ছবি: জিম্বাবুয়ের ভৌগলিক অবস্থান

জিম্বাবুয়ের জলবায়ু মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় হলেও উচ্চতার কারণে তুলনামূলকভাবে শীতল ও সহনীয়। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বর্ষাকাল এবং এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম থাকে। দেশের সবচেয়ে পরিচিত প্রাকৃতিক বিস্ময় হলো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত (মোসি-ওয়া-তুনইয়া অর্থাৎ “ধোঁয়া যে গর্জে ওঠে”)—যা বিশ্বের বৃহত্তম ও মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাতগুলোর একটি, জাম্বেজি নদীর উপর অবস্থিত।

ইতিহাস

জিম্বাবুয়ের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রস্তর যুগ থেকেই এই অঞ্চলে মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে এই ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল একাধিক শক্তিশালী রাজ্য—যেমন মাপুংগুবুয়ে রাজ্য (১১–১৩ শতক) এবং গ্রেট জিম্বাবুয়ে রাজ্য (১৩–১৫ শতক)। পরবর্তী রাজ্যের নাম থেকেই বর্তমান রাষ্ট্রের নামকরণ। গ্রেট জিম্বাবুয়ের ধ্বংসাবশেষ আজও ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে আফ্রিকার প্রাচীন সভ্যতা, স্থাপত্য ও বাণিজ্য নেটওয়ার্কের প্রতীক হয়ে আছে।

ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী সেসিল রোডস-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সাউথ আফ্রিকা কোম্পানি এই অঞ্চল দখল করে এবং এর নাম দেয় সাউদার্ন রোডেশিয়া। ১৯২৩ সালে এটি স্বশাসিত ব্রিটিশ উপনিবেশে রূপ নেয়। দীর্ঘ শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসন ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পর মুক্তিযুদ্ধ (সেকেন্ড চিমুরেঙ্গা) শেষে ১৮ এপ্রিল ১৯৮০ সালে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মুগাবে স্বাধীন জিম্বাবুয়ের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং দেশের নাম রাখা হয় জিম্বাবুয়ে, যার অর্থ “পাথরের ঘর”।

শাসনব্যবস্থা

জিম্বাবুয়ে একটি একক রাষ্ট্রীয় প্রেসিডেন্সিয়াল প্রজাতন্ত্র। রাষ্ট্রপতি একইসঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন পাঁচ বছরের জন্য। ২০১৩ সালের সংবিধান অনুযায়ী দেশটি একটি বহুদলীয় গণতন্ত্র, যেখানে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার বিভাগের পৃথক কাঠামো রয়েছে। তবে বাস্তবে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতার অভাব ও নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক জিম্বাবুয়ের গণতন্ত্রকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রদেশ ও জেলা পর্যায়ে গঠিত, যেখানে স্থানীয় পরিষদগুলো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংবিধানে বিকেন্দ্রীকরণের নিশ্চয়তা থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা কার্যকর স্থানীয় শাসনকে দুর্বল করে রেখেছে।

সংস্কৃতি

জিম্বাবুয়ের সংস্কৃতি বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। এখানে ১৬টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো শোনা ও নদেবেলে। শোনা জনগোষ্ঠী দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ জনসংখ্যা গঠন করে এবং পাথরের ভাস্কর্য, সংগীত ও মৌখিক কাহিনিচর্চায় সমৃদ্ধ। নদেবেলে জনগোষ্ঠী তাদের রঙিন নকশা, দেয়ালচিত্র ও অলঙ্কার শিল্পের জন্য বিখ্যাত।

সঙ্গীত ও নৃত্য জিম্বাবুয়ের সমাজজীবনের অপরিহার্য অংশ। মবিরা (thumb piano) শোনা ঐতিহ্যের অন্যতম বাদ্যযন্ত্র, যা আত্মিক যোগাযোগের প্রতীক। জনপ্রিয় সংগীতধারার মধ্যে রয়েছে সুংগুরা, চিমুরেঙ্গা ও আরবান গ্রুভস। সাহিত্যে ও চিত্রকলায় প্রতিরোধ, পরিচয় ও আশার প্রতিফলন দেখা যায়। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান লেখকদের মধ্যে দামবুজো মারে‌চেরা ও ৎসিৎসি দাঙ্গারেম্বগা উল্লেখযোগ্য।

ধর্ম

জিম্বাবুয়ের জনগণের প্রায় ৮৫ শতাংশই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। রোমান ক্যাথলিক, অ্যাংলিকান, মেথডিস্ট, পেন্টেকোস্টালসহ নানা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি রয়েছে। পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান বিশ্বাস, বিশেষত পূর্বপুরুষ পূজা ও আত্মিক যোগাযোগের সংস্কার আজও জীবিত। ইসলাম, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে। ধর্ম সামাজিক সংহতি, নৈতিক শিক্ষা ও সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

রাজনীতি

স্বাধীনতার পর থেকেই জিম্বাবুয়ের রাজনীতিতে প্রভাবশালী দল জানু-পিএফ (ZANU–PF), যার নেতৃত্বে ছিলেন রবার্ট মুগাবে। স্বাধীনতার পর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য অর্জনের জন্য তিনি প্রশংসিত হলেও পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি, একনায়কতন্ত্র ও অর্থনৈতিক পতনের কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। ২০১৭ সালে সামরিক হস্তক্ষেপের পর তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। তাঁর উত্তরসূরি এমারসন মনাঙ্গাগওয়া “দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র”-এর ঘোষণার মাধ্যমে সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও রাজনৈতিক মেরুকরণ ও নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে মুভমেন্ট ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জ (MDC) বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়, যা গণতান্ত্রিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের পক্ষে আন্দোলন করে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দলীয় বিভাজন গণতন্ত্রের বিকাশকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।

প্রাকৃতিক সম্পদ

জিম্বাবুয়ে আফ্রিকার অন্যতম সম্পদশালী দেশ। দেশে রয়েছে প্লাটিনাম, স্বর্ণ, হীরা, কয়লা, নিকেল, লিথিয়াম ও ক্রোমসহ বহু খনিজ সম্পদ। দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্রেট ডাইক ভূ-গঠনটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্লাটিনাম ও ক্রোমের ভাণ্ডার। কৃষি এখনো অর্থনীতির মূল ভিত্তি; ভুট্টা, তামাক ও তুলা প্রধান বাণিজ্যিক ফসল। তবে ২০০০ সালের পর ভূমি সংস্কার নীতি কৃষি উৎপাদন ও বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধরনের ধাক্কা দেয়।

জলসম্পদের মধ্যে জাম্বেজি ও লিম্পোপো নদী গুরুত্বপূর্ণ, যা জলবিদ্যুৎ, সেচ ও মৎস্যসম্পদের উৎস। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা সম্পদ আহরণকে অনিরাপদ ও অসম করে তুলেছে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য

জিম্বাবুয়ে প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্যে ভরপুর দেশ। ভিক্টোরিয়া ফলস, হোয়াঙ্গে ন্যাশনাল পার্ক, মানা পুলস, ও মাতোবো হিলস—সবই বিশ্বমানের প্রাকৃতিক ও জীববৈচিত্র্যমণ্ডিত স্থান। দেশের ইস্টার্ন হাইল্যান্ডস অঞ্চলে পাহাড়, ঝরনা ও চা বাগানের শান্তিপূর্ণ সৌন্দর্য মুগ্ধ করে।

ছবি: সাফারি পার্ক, জিম্বাবুয়ে

গ্রেট জিম্বাবুয়ে ধ্বংসাবশেষ, খামি রুইন্স, ও মাতোবো পাহাড়ের প্রাগৈতিহাসিক শিলাচিত্র এই জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। এসব স্থান শুধু পর্যটনের আকর্ষণই নয়, বরং জাতির আত্মপরিচয় ও গৌরবের প্রতীক।

ছবি: গ্রেট জিম্বাবুয়ে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ, "পাথরের দেশ"

আন্তর্জাতিক সদস্যপদ

জিম্বাবুয়ে জাতিসংঘ (UN), আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU), দক্ষিণ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি (SADC), কমেসা (COMESA) ও আফ্রিকান কনটিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া (AfCFTA)-এর সদস্য। একসময় দেশটি কমনওয়েলথ অব নেশনস-এরও সদস্য ছিল, তবে ২০০৩ সালে মানবাধিকার ও শাসনব্যবস্থা ইস্যুতে দ্বন্দ্বের কারণে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পুনরায় যোগদানের প্রচেষ্টা চলছে, যা আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দেয়।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

জিম্বাবুয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও দুর্নীতি। ভূমি সংস্কারের বিতর্কিত ফলাফল, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশটির টেকসই উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। মেধাপাচার বা brain drain এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতাও বড় বাধা।

তবে সম্ভাবনাও বিশাল। দেশের তরুণ ও শিক্ষিত জনশক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কৌশলগত অবস্থান ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে। খনিজ, কৃষি ও পর্যটন খাতে নতুন বিনিয়োগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামো (SADC ও AfCFTA)-এর সুযোগ কাজে লাগানো গেলে অর্থনৈতিক পুনরুত্থান সম্ভব। সুশাসন, প্রযুক্তি বিনিয়োগ ও শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে জিম্বাবুয়ে আবারও আফ্রিকার অন্যতম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে।

ছবি: জিম্বাবুয়ের রাজধানী 'হারারে'

জিম্বাবুয়ের ইতিহাস এক অনন্য সহনশীলতা, সংগ্রাম ও পুনর্জাগরণের কাহিনি। প্রাচীন গ্রেট জিম্বাবুয়ে সভ্যতা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বর্তমান পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা—এই দেশ আফ্রিকার সংগ্রামী আত্মার প্রতীক। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য ও মানুষের দৃঢ় মনোবল জিম্বাবুয়েকে আশার আলোয় আলোকিত করে রেখেছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলা যায়—জিম্বাবুয়ে আবারও উত্থান ঘটাতে পারে, এক স্বাধীন, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ আফ্রিকান জাতি হিসেবে।

তথ্যসূত্র:

Beach, D. N. (1994). The Shona and Zimbabwe 900–1850: An Outline of Shona History. Heinemann.

Meredith, M. (2002). Our Votes, Our Guns: Robert Mugabe and the Tragedy of Zimbabwe. Public Affairs.

Raftopoulos, B. (2013). The hard road to reform: The politics of Zimbabwe’s global political agreement. Weaver Press.

Ndlovu-Gatsheni, S. J. (2009). Do 'Zimbabweans' exist? Trajectories of nationalism, national identity formation and crisis in a postcolonial state. Peter Lang.

Richardson, C. (2005). The Loss of Property Rights and the Collapse of Zimbabwe. Cato Journal, 25(3), 541–565.

Commonwealth Secretariat. (2022). Zimbabwe’s re-admission dialogue. Retrieved from https://thecommonwealth.org/

World Bank. (2023). Zimbabwe Economic Update: Harnessing Technology for Growth.

পাঠকের মতামত: