অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

শেয়ার বাজারে স্বরণকালের বড় ধ্বসঃ নেপথ্যে কি?

অর্থনীতি ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৫ ১৮:৫৮:০৭
শেয়ার বাজারে স্বরণকালের বড় ধ্বসঃ নেপথ্যে কি?

সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে (১৫ মে) দেশের পুঁজিবাজারে যে বড় ধরনের ধস দেখা গেল, তা শুধু দিনের পতন নয়—এ যেন চলমান আস্থাহীনতা, অস্পষ্ট দিকনির্দেশনা এবং বাজার ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। আজকের সূচক পতনের মাধ্যমে ডিএসই পৌঁছে গেছে গত সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে, যা বিনিয়োগকারীদের মনে আশঙ্কা ও হতাশার নতুন মাত্রা তৈরি করেছে।

সপ্তাহের শেষ দিনে বড় ধস: পাঁচ বছরের রেকর্ড ভাঙল ডিএসইএক্স

বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৪.৫৮ পয়েন্ট হারিয়ে থেমেছে ৪৭৮১ পয়েন্টে, যা ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বরের পর সর্বনিম্ন। সেদিন সূচক ছিল ৪৭৭৯ পয়েন্টে। বাজার খোলার পর কিছুটা ইতিবাচক গতি দেখা গেলেও, দিন গড়াতেই বড় বিনিয়োগকারীদের টানা সেল প্রেসারে বাজারের গতি থেমে যায়। সূচক নিম্নমুখী হতে থাকে একটানা।

শুধু প্রধান সূচক নয়, ডিএসইএস সূচক ১৪.৫৫ পয়েন্ট ও ডিএসই-৩০ সূচক ২০.৯১ পয়েন্ট কমেছে, যথাক্রমে অবস্থান করছে ১০৩৮ ও ১৭৭০ পয়েন্টে।

প্রতিষ্ঠানভিত্তিক দরপতন: ৩১৭ কোম্পানির শেয়ারদর কমেছে

আজ মোট ৩৯৫টি কোম্পানি লেনদেনে অংশ নেয়। এর মধ্যে মাত্র ৪২টির দর বেড়েছে, আর ৩১৭টির দর কমেছে, বাকি ৩৬টির দর অপরিবর্তিত থাকে। এই চিত্র থেকেই বোঝা যায়—বাজারে ছিল একতরফা দরপতনের ধারা। এর ফলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ছড়ায় ভয় ও বিভ্রান্তি, অনেকেই লোকসান মাথায় নিয়ে শেয়ার বিক্রি করে ফেলতে বাধ্য হন।

লেনদেনেও পতন: চাহিদা কমেছে, আস্থা হারিয়েছে বাজার

টাকার অঙ্কে আজ ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ২৯৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, যা গত ৯ কর্মদিবসের মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও গতকালের তুলনায় আজ কিছুটা বেড়েছে (প্রায় ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা), কিন্তু বড় ছবি বলছে—বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ধরে রাখতে বা নতুন করে বিনিয়োগে যেতে অনাগ্রহী।

প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের আগস্টে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ২৯৫৩ কোটি টাকার বেশি, সূচক ছিল তখন ৬৪৮০ পয়েন্ট। একই বছর অক্টোবরে ৭৩৬৭ পয়েন্টে পৌঁছেছিল ডিএসইএক্স, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। সেখান থেকে আজকের জায়গা—প্রায় ২৬০০ পয়েন্টের ধস—একটি বিশাল সংকেত।

বাজারের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ছে: কেন এই পতন?

বিশ্লেষকদের মতে, বাজারে এখন তিনটি বড় সমস্যা জেঁকে বসেছে—

আস্থার সংকট: রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নীতিনির্ধারকদের দ্বিধান্বিত ভূমিকা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর ব্যবস্থা না থাকা।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অনুপস্থিতি: বড় বিনিয়োগকারীরা এখন বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, যার ফলে চাপ পড়ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীর ওপর।

নগদ অর্থের ঘাটতি ও ব্যাংক খাতে চাপ: দেশজুড়ে আর্থিক খাতের অনিশ্চয়তা এবং উচ্চ সুদের হার বিনিয়োগকারীদের বিকল্প খাতে টাকা সরিয়ে নিতে বাধ্য করছে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও একই চিত্র

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)-তেও আজ একই ধরনের একপাক্ষিক দরপতন লক্ষ্য করা গেছে। আজ ২০৫টি কোম্পানির মধ্যে ১৫১টির দর কমেছে, ৩৭টি বেড়েছে এবং ১৭টি অপরিবর্তিত। সিএসইর সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৩৭.৪৬ পয়েন্ট কমে অবস্থান করছে ১৩,৪৭৭ পয়েন্টে। আগেরদিনও সূচক কমেছিল। লেনদেনও কমে এসেছে এখানে—মাত্র ১০ কোটি ১১ লাখ টাকার, আগের দিন ছিল ১১ কোটি ২০ লাখ।

এখন করণীয় কী?

বাজার বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন আর সময় নেই ধীরে চলো নীতির। বাজারে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্ভরযোগ্য নীতিগত সহায়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করা ছাড়া এ পতনের ধারা থামবে না। শুধু ভরসার কথা বললে চলবে না, বিনিয়োগকারীরা এখন দেখতে চান বাস্তব পদক্ষেপ। শেয়ারবাজার যে শুধু সূচক বা টাকার হিসাব নয়—এটি একটি দেশের অর্থনীতির আয়না। এই আয়নায় যখন প্রতিদিন ফাটল ধরছে, তখন তা গোটা অর্থনীতিরই সংকেত দেয়। তাই বাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন কেবল বিনিয়োগকারীদের দাবি নয়—এটি সময়েরই চাহিদা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ