আল জাজিরা প্রতিবেদন

রেড সি উত্তপ্ত: ইসরায়েলের হামলা, হুথিদের পাল্টা মিসাইল

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৭ ১৯:৪২:২৪
রেড সি উত্তপ্ত: ইসরায়েলের হামলা, হুথিদের পাল্টা মিসাইল

রবিবার (৭ জুলাই) গভীর রাতে ইসরায়েল ইয়েমেনের হুথি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একাধিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্যবস্তু ছিল হোদেরা, রাস-ইসা ও আস-সালিফ বন্দরের অবকাঠামো এবং রাস-কাথিব পাওয়ার প্ল্যান্ট। একইসঙ্গে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হামলা চালায় গ্যালাক্সি লিডার নামক একটি জাহাজে থাকা রাডার সিস্টেমেও, যেটি আগেই হুথি যোদ্ধাদের দ্বারা দখলকৃত এবং হোদেরা বন্দরে অবস্থান করছে।

এই হামলাগুলো ছিল প্রায় এক মাস পর ইয়েমেনে ইসরায়েলের প্রথম সামরিক অভিযান। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি, তবে এর জবাবে হুথি গোষ্ঠী সোমবার সকালে ইসরায়েলের উদ্দেশে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে।

হুথিদের পাল্টা হামলা ও লক্ষ্যবস্তু

হুথি সামরিক মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি এক ভিডিও বিবৃতিতে জানান, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের জবাবে তারা বেন গুরিয়ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আশদোদ ও ইলাত বন্দর এবং আশকেলনের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, এই পাল্টা হামলা সম্পূর্ণরূপে আত্মরক্ষামূলক এবং গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদ হিসেবে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি অনুযায়ী, তারা হুথিদের ছোড়া দুটি ক্ষেপণাস্ত্রকে আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ কার্যক্রমের ফলাফল পর্যালোচনার অধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

হুথিদের দাবি: সফল প্রতিরোধ ও সামরিক সক্ষমতা

হুথি মুখপাত্র আমিন হাইয়ান ইয়েমেনি সামাজিক মাধ্যমে জানান, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানদের বড় একটি অংশ হুথি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয়। তিনি দাবি করেন, স্থানীয়ভাবে তৈরি ভূমি-থেকে-আকাশ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে ইসরায়েলি বৈমানিকদের মধ্যে ‘মহা বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি হয় এবং তাদের অভিযান পরিচালনাকারী কক্ষে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

সানা থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক নাবিল আল-ইউসেফি জানান, হুথি বাহিনী ইসরায়েলি হামলার প্রভাবকে হালকাভাবে নিচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, এই আক্রমণে কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এবং হুথি সেনারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় আছে যেকোনো ভবিষ্যত ইসরায়েলি আগ্রাসন মোকাবেলার জন্য।

বৃহৎ প্রেক্ষাপট: মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি

এই ঘটনার সময়টিও ছিল খুব সংবেদনশীল। গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ঝুলে আছে এবং ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনার পুনরায় শুরুর প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে। মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের কয়েকটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

ইসরায়েল কেবল ইয়েমেন নয়, একইসঙ্গে লেবানন, সিরিয়া, পশ্চিম তীর এবং সম্প্রতি ইরানেও একাধিকবার সামরিক হামলা চালিয়েছে। রবিবার রাতের ঘটনায়ও লেবাননের দক্ষিণ এবং বেকা উপত্যকায় হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে ইসরায়েলি বিমান হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের দাবি, সেসব স্থানে রকেট উৎপাদন ও সংরক্ষণের অবকাঠামো ছিল, যদিও তারা তার কোনো নিরপেক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করেনি।

রেড সি অঞ্চল ও বাণিজ্যিক নিরাপত্তা সংকট

ইসরায়েল-হুথি উত্তেজনার মাঝেই রেড সি তে একটি বাণিজ্যিক কার্গো জাহাজে গ্রেনেড ও ড্রোন হামলা চালানো হয়, যা জাহাজটিকে আগুনে ভস্মীভূত করে এবং নাবিকরা জাহাজ ত্যাগে বাধ্য হন। যদিও কেউ এই হামলার দায় স্বীকার করেনি, যুক্তরাজ্যের সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংস্থা বলেছে, এটি ‘হুথি গোষ্ঠীর পূর্ববর্তী আক্রমণের ধরনে মিলে যায়’।

২০২৩ সালে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে হুথিরা একাধিকবার ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে এবং রেড সি–তে শতাধিক বাণিজ্যিক জাহাজে আক্রমণ করেছে। জানুয়ারি মাসে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর তারা আক্রমণ বন্ধ করেছিল। তবে মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্র ইয়েমেনে হামলা চালালে তারা আবার হামলা শুরু করে। সেসব হামলায় প্রায় ৩০০ জন নিহত হয়।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ

বিশ্লেষকদের মতে, এই হুথি-ইসরায়েল উত্তেজনা এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন গাজায় যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা এবং ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ একইসঙ্গে বিদ্যমান। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে এবং ৭ অক্টোবরের হামলার ব্যর্থতার দায় তার ওপরেই আরোপ করছে অনেক ইসরায়েলি নাগরিক।

হুথিরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকবে, ততক্ষণ তারা চুপ থাকবে না। তারা আরও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, প্রয়োজনে আবার বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় যাওয়ার প্রস্তুতিও তাদের আছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ও কূটনৈতিক অচলাবস্থার আবর্তে ইয়েমেন এখন আরও জোরালোভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। হুথিদের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা এবং ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণ পুরো অঞ্চলকেই এক অস্থির ও অনিশ্চিত পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। গাজা যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া এই সংঘাত এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে, যার নিষ্পত্তি কোনো একক ফ্রন্টে সম্ভব নয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ