ইলন বনাম ট্রাম্প: মাস্কের নতুন দলের নাম ঘোষণা

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ০৬ ০৯:৪০:০৩
ইলন বনাম ট্রাম্প: মাস্কের নতুন দলের নাম ঘোষণা

যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাটিক দ্বিদলীয় কাঠামোয় এক নাটকীয় মোড় আনলেন টেসলা ও স্পেসএক্স প্রধান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মালিক ইলন মাস্ক। স্থানীয় সময় শনিবার এক্সে দেওয়া এক ঘোষণায় তিনি ‘আমেরিকা পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটান। মাস্ক বলেন, “এই দল এসেছে আপনাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে।” তার এই ঘোষণাকে রাজনৈতিক মহলে দেখা হচ্ছে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হিসেবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

মাস্কের ঘোষণার পেছনে ছিল একটি গণভোটধর্মী জনমত যাচাই। শুক্রবার এক্সে তিনি অনুসারীদের জিজ্ঞাসা করেন, “যুক্তরাষ্ট্রে কি নতুন একটি রাজনৈতিক দল প্রয়োজন?” ২৪ ঘণ্টার মাথায় মাস্ক ঘোষণা দেন, “২:১ ব্যবধানে আপনারা নতুন দল চেয়েছেন, আপনাদের তা দেওয়া হলো।” এই ঘোষণাটি কেবলমাত্র প্রতীকী নয়; এটি এমন এক সময় এসেছে, যখন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালার বিরোধিতায় সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন যার সঙ্গে একসময় তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

ট্রাম্পের সদ্য অনুমোদিত ‘বিগ অ্যান্ড বিউটিফুল’ খ্যাত করছাড় ও ব্যয়বৃদ্ধির বিলটিই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। মাস্ক এই বিলের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “বাইডেন আমলে যেখানে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ ট্রিলিয়ন ডলার, ট্রাম্প সেটিকে বাড়িয়ে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার করে তুলেছেন। এটি আমেরিকাকে দেউলিয়া করে দেবে।” এই বিলের বিরুদ্ধেই মূলত মাস্কের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তিনি বলেন, “এই বিশাল বাজেট ঘাটতির কারণেই আমি ট্রাম্পের সমর্থক থেকে সমালোচকে পরিণত হয়েছি।”

অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও মাস্ক ছিলেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচন প্রচারণায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে গঠিত ‘Government Efficiency Taskforce’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার কোম্পানিগুলোকে দেওয়া ভর্তুকির সুযোগ-সুবিধাও উপভোগ করেছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অর্থনৈতিক নীতিতে পরিবর্তনের কারণে মাস্ক তার অবস্থান থেকে সরে আসেন।

এই দ্বন্দ্ব এখন ব্যক্তিগত রেষারেষিতে পরিণত হয়েছে। ট্রাম্প প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছেন, মাস্কের কোম্পানিগুলো বিশেষত টেসলা ও স্পেসএক্স যেসব সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি পায়, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। মাস্ক পাল্টা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, তিনি অর্থ ব্যয় করবেন সেই সব কংগ্রেস সদস্যদের বিরুদ্ধে, যারা ট্রাম্পের বিলকে সমর্থন করেছেন। এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এটি শুধু রাজনৈতিক আদর্শ বা নীতির দ্বন্দ্ব নয় বরং একটি ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের লড়াই।

মাস্ক তার রাজনৈতিক কৌশলের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক্সে গ্রিক সেনানায়ক এপামিনোনডাসের কৌশলের উদাহরণ টেনে লেখেন, “আমরা যেভাবে ইউনিপার্টি (রিপাবলিকান-ডেমোক্রেটদের প্রতিষ্ঠিত যৌথ কর্তৃত্ব) ব্যবস্থাকে ভাঙব, তা হবে একটি তীব্র, কেন্দ্রীভূত আঘাতের মাধ্যমে।” এই বক্তব্যে পরিষ্কার, মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে একটি বিকল্প আদর্শ দাঁড় করাতে চাইছেন, যা মূলধারার উভয় দলকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।

তবে এই রাজনৈতিক ঘোষণার প্রভাব সীমাবদ্ধ নেই কেবল রাজনীতিতে। বাজারেও এর প্রভাব স্পষ্ট। ট্রাম্পের বিজয়ের পর টেসলার শেয়ার মূল্য কিছুটা বেড়ে ৪৮৮ ডলারে পৌঁছালেও পরবর্তী কয়েক মাসে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ট্রাম্প-মাস্ক দ্বন্দ্বের কারণে তা অর্ধেকে নেমে আসে। সর্বশেষ হিসাবে শেয়ারের মূল্য ৩১৫.৩৫ ডলারে এসে ঠেকেছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, কারণ মাস্কের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ তার ব্যবসায়িক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাস্কের মতো ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির একটি নতুন দল গঠন নিঃসন্দেহে বড় ঘটনা। তবে তারা একইসঙ্গে সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, মার্কিন রাজনীতির ১৬০ বছরের রিপাবলিকান-ডেমোক্রেটিক কাঠামোকে ভেঙে দেওয়া সহজ নয়। মাস্কের রয়েছে বিপুল সম্পদ, প্রযুক্তিগত প্রভাব ও জনপ্রিয়তা কিন্তু একটি কার্যকর রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হলে তাকে মাঠপর্যায়ে সংগঠন, স্থানীয় নেতৃত্ব, নির্বাচনী কাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

২০২৬ সালের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনকে সামনে রেখে রিপাবলিকান দল ইতিমধ্যেই মাস্কের অবস্থান নিয়ে চিন্তিত। তারা আশঙ্কা করছে, মাস্কের নতুন দল মূলত রিপাবলিকানদের ভোট ভাগ করে নিতে পারে যা ডেমোক্রেটদের জন্য অপ্রত্যাশিত সুবিধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত হোয়াইট হাউস কিংবা ট্রাম্পের পক্ষ থেকে মাস্কের এই ঘোষণার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই দ্বন্দ্ব কেবল দুই ব্যক্তির মধ্যকার লড়াই নয়, বরং এটি মার্কিন রাজনীতিতে এক নতুন সময়ের সূচনা হতে পারে—যেখানে প্রযুক্তি, অর্থ এবং রাজনৈতিক কৌশল একত্র হয়ে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব ও নীতিকে পুনর্গঠিত করতে পারে। ইলন মাস্ক এখন কেবল একজন ব্যবসায়ী নন, তিনি হয়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুর একটি বিকল্প প্রতিমূর্তি।

সূত্র: রয়টার্স

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ