ঘুম পাড়িয়ে মৃত্যু: পুলিশ কনস্টেবল খুনের নাটকীয় মোড়

অপরাধ ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৩ ০৭:৫৯:৫০
ঘুম পাড়িয়ে মৃত্যু: পুলিশ কনস্টেবল খুনের নাটকীয় মোড়

সত্য নিউজ: ঢাকা মহানগর পুলিশের গাড়িচালক কনস্টেবল হুমায়ুন কবীরকে (৪৫) হত্যার পেছনে উঠে এসেছে পারিবারিক অশান্তি, নিষিদ্ধ সম্পর্ক এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার চাঞ্চল্যকর চিত্র। স্ত্রী সালমা বেগমের নেতৃত্বে পরিচালিত এই হত্যাকাণ্ডে তাঁর আত্মীয়স্বজনসহ ভাড়াটে খুনিরাও জড়িত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে তদন্তকারী সংস্থা।

হত্যার পেছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি

তদন্ত কর্মকর্তাদের বরাতে জানা যায়, দেড় মাস আগে স্ত্রী সালমা বেগম পরিকল্পনা করেন স্বামী হুমায়ুন কবীরকে হত্যার। পরিকল্পনায় তাঁর সহযোগী হন আত্মীয় রাজীব হোসেন ও মরিয়ম বেগম। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কেনা হয় একটি দা ও একটি রশি। ভাড়াটে খুনি হিসেবে চুক্তিবদ্ধ করা হয় তিনজনকে—ফজলে রাব্বি শুভ (২৩), রাফি খান (১৮) ও পলি বেগম (৩৫)। মোট দুই লাখ টাকার চুক্তিতে এই তিনজনকে ভাড়া করা হয়, যার মধ্যে ২০ হাজার টাকা আগাম দেওয়া হয়।

ঘুমের ওষুধ ও ফলের ছলে বিষক্রিয়া

সালমা বেগম আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, ২৭ এপ্রিল রাতে স্বামী হুমায়ুন অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলে তিনি ঘুমের বড়ি গুঁড়ো করে ভাতে মিশিয়ে দেন। খাওয়ার পর হুমায়ুনকে খাওয়ানো হয় আঙুর ফল। কিছু সময়ের মধ্যেই হুমায়ুন অচেতন হয়ে পড়েন। রাত দেড়টার দিকে খুনিরা বাসায় ঢুকে গামছা দিয়ে হুমায়ুনের হাত-পা বেঁধে ফেলেন। এরপর ফজলে রাব্বি ও রাফি তাঁর গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। এ সময় পাশের কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল তাঁদের দুই শিশু সন্তান।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের জটিলতা

তদন্তে উঠে এসেছে, সালমার সঙ্গে তাঁর স্বামীর সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই টানাপোড়েনে ছিল। জবানবন্দিতে সালমা দাবি করেন, স্বামীর খারাপ আচরণ থেকে মুক্তি পেতেই তিনি স্থানীয় এক ফকিরের শরণাপন্ন হন এবং ১০ হাজার টাকা দেন ঝাড়ফুঁকের জন্য। তবে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হত্যার পথ বেছে নেন তিনি।

সালমার স্বামীর ভাই খোকন হাওলাদার এজাহারে উল্লেখ করেন, তাঁর ভাই হুমায়ুন কবীর জানতে পারেন, স্ত্রী সালমার সঙ্গে রাজীব হোসেন নামের এক যুবকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে পারিবারিক বৈঠকের আয়োজন করা হলে সালমা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং হুমায়ুনকে ধমকান। মাত্র তিনদিন পরই ঘটে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড।

মরদেহ সরানোর চেষ্টা ও গ্রেপ্তার

হত্যার পর খুনিরা মরদেহ বাসার নিচে নিয়ে যেতে চাইলেও আশপাশে লোকজনের উপস্থিতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। খবর পেয়ে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে। পরে সালমা, মরিয়মসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত রাজীব হোসেন এখনো পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

শিশুদের ভবিষ্যৎ ও ভাঙা একটি পরিবার

হুমায়ুনের দুই শিশু সন্তান এখন পটুয়াখালীর গ্রামে তাঁদের চাচা খোকন হাওলাদারের তত্ত্বাবধানে আছে। খোকন বলেন, “আমার ভাইয়ের সংসারটা একেবারে তছনছ হয়ে গেল। আমার ভাইয়ের স্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়দের ষড়যন্ত্রে হুমায়ুন আজ পৃথিবীতে নেই। আমি চাই খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, যেন কেউ আর এমন ভয়ানক পরিকল্পনার পথে না হাঁটে।”

এই হত্যাকাণ্ড যেন সমাজে চলমান পারিবারিক অবনতি ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের এক করুণ প্রতিচ্ছবি। এটি কেবল একটি খুনের ঘটনা নয়, এটি একটি সংসার ধ্বংসের, বিশ্বাসভঙ্গের এবং শিশুদের জীবনে অকাল অন্ধকার নেমে আসার গল্প। তদন্ত এখনো চলমান। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একদিন হয়তো সব দায় ঠিকভাবে প্রমাণ হবে—তবে যা হারিয়ে গেছে, তা আর কখনোই ফিরে আসবে না।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ