"রাজনীতিতে পলিটিক্‌স্‌ ঢুকে গেছে"

২০২৫ জুন ১২ ০৯:৩৮:৩৪
"রাজনীতিতে পলিটিক্‌স্‌ ঢুকে গেছে"

রাজনীতিতে “পলিটিক্‌স্‌ ঢুকে গেছে”—এই বাক্যটি কে প্রথম বলেছিলেন তা অনেকেই জানে না, কিন্তু এটি যেন আজকের বাংলাদেশি রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এটি খুব গম্ভীর মুখে বলেন, যেন এটি নতুন কোনো আবিষ্কার। তবে যিনি এটি প্রথম বলেছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে প্রখর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তা না হলে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাক্যটি এমন নিখুঁতভাবে প্রযোজ্য হতো না।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের ভোটাধিকার জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া এবং একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক কর্মপন্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, সেই লক্ষ্যে নয় বরং একটি ‘পছন্দের গণতন্ত্র’ গঠনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে সরকার।

গণতন্ত্রের মৌলিক সংজ্ঞা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের মত প্রতিষ্ঠা। অথচ প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে যে নির্বাচন সময়সূচি দিয়েছেন, তা গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তিনি বিদেশ সফরে গিয়ে বলেন, "ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় কেবল একটি দল", যদিও দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল বহুদিন ধরেই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছিল।

তার এই বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিলেও, তাতে তিনি বিচলিত নন। বরং নিজস্ব মূল্যায়নেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তিনি যাদের “সংখ্যাগরিষ্ঠ” বলে মনে করেছেন, তাদের মতামতকেই গ্রহণ করেছেন। ফলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার এপ্রিল মাসে নির্বাচনের ঘোষণা থেকে স্পষ্টভাবে অনুমান করা যায়, সামনে কেমন ধরনের গণতন্ত্র দেশের অপেক্ষায় রয়েছে।

প্রেস সচিব শফিকুল আলম এপ্রিল মাসকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য 'ফ্যান্টাস্টিক টাইম' হিসেবে অভিহিত করেছেন। গণমাধ্যমকে তিনি জানান, এই সময় নির্ধারণের পেছনে তিনটি মূল রাজনৈতিক যুক্তি কাজ করেছে—সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন।

তিনি জানান, ইতোমধ্যে ১২ থেকে ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে যাদের রিপোর্টে ভিত্তি করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। সেই সঙ্গে ট্রায়ালের কথা বলা হয়—বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার। শফিকুল আলম বলেন, “চার-ছয় বছর বয়সী শিশুরাও সে সময় নিহত হয়েছে। সেসব বিচারের জন্য সময় দরকার।” এ ছাড়া নির্বাচন যেন ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ হয়, তার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আবহাওয়া বিষয়েও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন যে এপ্রিলের প্রথম দশদিন তুলনামূলকভাবে সহনীয় তাপমাত্রার মধ্যে থাকে এবং সে সময় দেশে কালবৈশাখিও তেমন তীব্র নয়। এটি একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও নজিরবিহীন ঘটনা—বাংলাদেশে পূর্বে কোনো সরকার আবহাওয়ার ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন সময় নির্ধারণ করেছে, এমন রেকর্ড নেই।

এই ঘোষণাগুলোর পরপরই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের কর্মকৌশল মূলত বিএনপিকে ঠেকানোর দিকেই পরিচালিত হচ্ছে। বিএনপির সমস্ত দাবির বিপরীত পথে হেঁটে সরকার যেসব পরিকল্পনা ঘোষণা করছে, তাতে দলটির রাজনৈতিক পরিসর ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। প্রশ্ন উঠছে—বিএনপির ‘অপরাধ’ কী?

এ দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ও স্বাধীনতার ঘোষক। তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তারেক রহমান বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং বারবার জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন। এই ইতিহাসই কি বিএনপির অপরাধ?

সরকার ইতোমধ্যে ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করেছে। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। বিএনপি যেসব বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে, তা বাদ দিয়ে বলা হতে পারে—বাকি সব রাজনৈতিক দল একমত। তখন বলা হবে, বিএনপিই একমাত্র ভিন্নমত পোষণকারী দল। এরপর হয়তো দেখা যাবে, জাতীয় নির্বাচন আগে না করে সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন কিংবা গণপরিষদ নির্বাচন ঘোষণা করবে, যা হবে এক নতুন কৌশল।

এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যেখানে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ করার জন্য সরকার একাধিক দিক থেকে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিচ্ছে। পুরনো মিত্ররাও এখন নতুন সুরে কথা বলছে। কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ করে ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে।

ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও শুরু হয়েছে একপ্রকার ‘সাইবার যুদ্ধ’। লেখক সতর্ক করেছেন যে, দেশে-বিদেশে কিছু সংগঠিত চক্র বিএনপির বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। এই প্রপাগান্ডার মোকাবিলায় বিএনপিকে গড়ে তুলতে হবে একটি দক্ষ ও সচেতন ডিজিটাল টিম—যারা তথ্যভিত্তিক, প্রমাণ-সমর্থিত বক্তব্য দিয়ে জনগণকে সত্য জানাতে পারবে। তিনি বলেন, “ডিজিটাল প্রপাগান্ডা মোকাবিলা করতে না পারলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

ভবিষ্যতের দিনগুলো শুধু বিএনপির জন্য নয়, বরং পুরো দেশ ও জাতীয়তাবাদী শক্তির জন্য এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। কারণ, যেসব গোষ্ঠী বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি, যারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে সহ্য করতে পারে না, তারা কখনোই এ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক হতে দেবে না।

এই বাস্তবতায় বিএনপিকে নতুনভাবে সংগঠিত হতে হবে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে হবে এবং জনগণের সঙ্গে আরও দৃঢ়ভাবে যুক্ত হতে হবে। দেশের জনগণকে বোঝাতে হবে—গণতন্ত্র এখন কতটা সংকটে আছে, এবং এই সংকটময় সময়টিতে সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলাই একমাত্র পথ।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত