মতামত

কবে থামবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতি?

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ জুন ০৭ ০৬:২৮:৩৮
কবে থামবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতি?

ফারুক ওয়াসিফ ভাই একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ ও নির্বাচন নিয়ে। আমি উনার স্ট্যাটাসের মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিয়ে খানিক আলাপ করতে চাই। ফারুক ভাই চিন্তাশীল মানুষ ও ছাত্রজীবনে তাঁর লেখা পড়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত হয়েছি। সেই অর্থে একজন চিন্তকের লেখার ক্রিটিকাল অ্যানালাইসিস হওয়া উচিত। এখানে সেই চেষ্টাই করবো।

ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব পালিয়ে গিয়েছিল, তারপর জাতির সম্মিলিত জোট প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল ভেতর থেকেই।” এখানে কয়েকটি শব্দ গুরুত্বপূর্ণ—“মূল নেতৃত্ব”, “পালিয়ে”, “জাতির সম্মিলিত জোট”। তিনি এর কোনটির সংজ্ঞা দেননি। তাই এখানে খানিকটা ধরে নিচ্ছি তিনি কী বোঝাতে চেয়েছেন। “মূল নেতৃত্ব” বলতে তিনি বুঝিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, যারা ৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভ করে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ম্যান্ডেট পেয়েছিলেন। “জাতির সম্মিলিত জোট”-এর সংজ্ঞা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই, হয়তো তিনি বোঝাতে চেয়েছেন এই মূল নেতৃত্বের বাইরের একটা বর্গকে। আমি এই ক্ষেত্রে ভুল হতে পারি, তবে আলোচনার খাতিরে ও তাঁর লেখার ধরন দেখে তাই মনে হয়। প্রশ্ন আছে তাঁর “পালিয়ে” যাওয়া শব্দের ব্যবহার নিয়ে। আমি ধরে নিচ্ছি তিনি সচেতনভাবেই “পালিয়ে যাওয়া” শব্দ ব্যবহার করেছেন। বাংলায় "পালিয়ে যাওয়া" শব্দগুচ্ছ সাধারণত ভয়, বিপদ, পরাজয় বা অপরাধবোধ থেকে লুকিয়ে বা গোপনে কোন স্থান ত্যাগ করা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে একধরনের নেতিবাচক ও কাপুরুষোচিত সুর থাকে। লেখাটি পড়ে আমার মনে হয়েছে, ফারুক ওয়াসিফ “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব”-এর কাপুরুষ ফ্রেমিং বোঝাতেই এই শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবার আসুন দেখি ইতিহাস কী বলে, ও ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ফারুক ওয়াসিফের এই শব্দচয়ন কতটা বস্তুনিষ্ঠ।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানে প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল (আনুমানিক সংখ্যা, বিবিসি রিপোর্ট থেকে নেয়া)। ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম ছিল 'অপারেশন সার্চলাইট'। এই অভিযানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ই মার্চ। ২৫ মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার প্রমাণ যেমন পাওয়া যায় সেসময় ঢাকায় দায়িত্বরত পাকিস্তানের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের স্মৃতিকথা থেকেও, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলপত্রেও।

অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা সম্পর্কে খাদিম হুসেইন রাজার 'আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি: ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১' বইয়ে বিস্তারিত লেখা আছে। খানিক সারাংশ তুলে দিচ্ছি। খাদিম লেখেন, পরিকল্পনার মূল দিকগুলো ছিল এরকম—যে কোনো ধরণের বিদ্রোহ বা বিরোধিতাকে কঠোরভাবে দমন করা হবে। সফল হওয়ার জন্য আকস্মিক চমক এবং চাতুর্যের গুরুত্ব আছে। সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকেও চাতুর্যের আশ্রয় নিয়ে তাদের সাহায্য করার পরামর্শ দিয়েছিল। বাঙালি সেনা সদস্য ও পুলিশকে নিরস্ত্র করা হবে। বিশেষ করে পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অস্ত্রাগার, রাজারবাগের রিজার্ভ পুলিশ এবং চট্টগ্রামে কুড়ি হাজার রাইফেলের অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ আগেভাগে নিয়ে নিতে হবে। অপারেশন শুরুর সাথে সাথে সব রকমের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে নতুন করে যাচাই-বাছাই করে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করা হবে। অস্ত্রশস্ত্র এবং অপরাধীদের খোঁজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ঘিরে ফেলতে হবে, এবং তল্লাশি চালাতে হবে। শেখ মুজিবকে জীবিত অবস্থায় ধরতে হবে। এর বাইরে ১৫ জন আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে হবে, তাদের কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার করতে হবে।

এই কনটেক্সট দেওয়ার কারণ হলো ফারুক ওয়াসিফের “পালিয়ে যাওয়া” শব্দচয়নের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করা। প্রশ্ন থেকেই যায়, যেখানে সামরিক অভিযান এমন পরিকল্পনা করে করা হয়েছে, যেখানে এক রাতে অর্ধ লক্ষ মানুষ গুলি করে ও আগুন দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, সেখানে ফারুক ওয়াসিফ “মূল নেতৃত্ব”-এর কাছে কী আশা করেন? ২০২৫ সালে সরকারি পদে থেকে এমন বয়ান দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে, যখন কেউ জানে না জাতির ভাগ্যে কী হবে, বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হবে কি না তা নিশ্চিত নয়, তখন “মূল নেতৃত্ব” কী করতে পারতো বলে মনে হয়? সেই সময় তারা সেটাই করেছেন যা মানুষ হিসেবে করা সম্ভব। এক প্রচণ্ড, পরিকল্পনামাফিক আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক জবাব দেওয়ার জন্য একটা রাজনৈতিক সরকার তৈরি করেছেন ও যুদ্ধ করেছেন। তারা পালিয়ে গিয়ে আরাম-আয়েশে বসে থাকেননি, বরং ১৭ই এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠন করে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছেন।

ফারুক ওয়াসিফের কাছে প্রশ্ন—২৫শে মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল কত যুগ? আপনি মূল নেতৃত্বকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য দোষ দিচ্ছেন ও কাপুরুষ হিসেবে দেখাচ্ছেন, তা কতটা যৌক্তিক?এবার দেখি ফারুক ওয়াসিফ আরও কী লিখেছেন। তিনি লেখেন, “ভেতরের এই প্রতিরোধ, যার ডাক দিয়েছিলেন মেজর জিয়া, তা না দাঁড়ালে এটাকে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে দাগানোর সুযোগ ছিল। মুজিবনগর সরকারকেও আওয়ামী সরকার বলা যায় না, বলা গেলে তারা প্রবাসী আওয়ামী সরকার বলতো। সেই অর্থে জিয়াই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেন। তাঁকে প্রাথমিক সহযোগিতা করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একটি অংশ।”

ফারুক ওয়াসিফ আসলে এখানে কে ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি’? সেই বিতর্কের প্রেক্ষিতে আলাপ তুলেছেন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি Divide and Co-opt Strategy ব্যবহার করেছেন। প্রথমে তিনি ভাগ করেছেন মূল নেতৃত্ব ও “জাতির সম্মিলিত জোট” এই ফ্রেমে। পরে তিনি জিয়াউর রহমানকে “জাতির সম্মিলিত জোট”-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বানিয়ে বলছেন “তাঁকে প্রাথমিক সহযোগিতা করে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একটি অংশ”। এইটাই হলো Divide and Co-opt Strategy।বাস্তবতা হলো ১৯৭১ সালে অনেকগুলো ঘটনা একসাথে ঘটেছে, এবং এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সমসাময়িকভাবে ঘটেছে। যেমন, জিয়াউর রহমান যখন কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, তখন তাঁকে নিঃসন্দেহে শেখ মুজিব বলে দেননি যে ঘোষণা দিতে হবে। তিনি নিজ দায়িত্বেই এই ঘোষণা দিয়েছেন ও শেখ মুজিবের নাম উল্লেখ করেছেন ‘গ্রেট লিডার’ হিসেবে। আবার, শেখ মুজিব যে মৃত না জীবিত, তা জিয়াউর রহমানের জানার কথা নয় সেই সময়। অন্যদিকে তাজউদ্দীনসহ অন্যরা যখন ভারতের দিকে যাত্রা করেছেন, তাঁদের জানার কথা নয় জিয়া কী ঘোষণা দিয়েছেন। আবার জিয়ারও জানার কথা নয় তাজউদ্দীন বা অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ তখন বেঁচে আছেন না মারা গেছেন। এই যে একজনের আরেকজনের না জানা, সমন্বয় না থাকা—এইটা কোনো পরিকল্পনার অংশ নয়, বরং ঐ সময়ের বাস্তবতা। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই ২৬শে মার্চ থেকে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ছোট ছোট পাজলগুলো মিলেই বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন একটি রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে ও আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে।এর বিকল্প কী হতে পারতো, ফারুক ওয়াসিফ তা বলেননি।

আরেকটা ব্যাপার, যদি বিএনপি না থাকতো, তবে কি ফারুক ওয়াসিফ ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি’ হিসেবে জিয়াকে নির্বাচিত করতেন? নাকি এখানে বর্তমান রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে? আমরা একই ধরনের কাজ আওয়ামী লীগকে করতেও দেখেছি। তারা ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি’ বিতর্ক করেছে এবং সেখানে শুধু শেখ মুজিবকে প্রতিষ্ঠা করেছে, বাকিদের অস্বীকার করেছে কিংবা অপ্রাসঙ্গিক করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী আওয়ামী লীগের এই ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি’ দাবির প্রজেক্টকে বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন দিয়েছেন। এখন হয়তো ফারুক ওয়াসিফরা বিএনপিকে দেবেন। মাঝখান থেকে আমরা ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত উত্তরসূরি’—অর্থাৎ এই বাংলার কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, নাম না জানা হিন্দু-মুসলমান সবাইকে বঞ্চিত করে মুজিব ও জিয়া বাইনারিতে চলে যাচ্ছি। তারা উভয়ই আমাদের জাতীয় নেতা। কিন্তু কোনো বন্দনাই আর গ্রহণযোগ্য নয়, তা সে যে পন্থী বুদ্ধিজীবী করুন না কেন।

ফারুক ওয়াসিফ আরও লিখেছেন, “২৪-এও প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নেতারা শুরুতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। এমনকি ৫ আগস্টের আগে তাঁরা কেউই নেতৃত্বের দায়ভার নেননি। প্রতিরোধ চালিয়ে গিয়েছিল সম্মিলিত ছাত্র-জনতা। ক্র্যাকডাউন বাড়লে অতীতের মতো তাঁরাও স্বেচ্ছায় পালাতেন বা শেখ মুজিবের মতো স্যুটকেস গুছিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য বসে থাকতেন।”

বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই (সবাই নয়) বিরাজনীতিকরণের বৃহত্তর প্রোজেক্টকে এজেন্ডায় রেখে কথায় কথায় রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অস্বীকার করেন, আন্দোলনে তাদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখান। ২৪-এর আন্দোলন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফারুক ওয়াসিফ তাই করেছেন। তিনি বলছেন, “২৪-এও প্রতিষ্ঠিত জাতীয় নেতারা শুরুতে দ্বিধান্বিত ছিলেন।” আসলেই কি তাই? আমরা দেখেছি হাসিনা কেমন করে যেকোনো রাজনৈতিক আন্দোলনকে দমন করেছে। হাসিনা যাতে এই সুযোগ না পান, সেই কারণেই ২৪-এর আন্দোলনকে অরাজনৈতিক রাখা জরুরি ছিল, আর সেই কৌশলে একমত ছিলেন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, তেমনটাই মনে হয়। তাই বিএনপি কিংবা জামায়াত কেউই এই আন্দোলনের সম্মুখ নেতৃত্ব নিতে আসেনি। তবে এই আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম কারণও ছিল জাতীয় নেতৃবৃন্দের এই কৌশল। কোন একদিন ২৪ আন্দোলন নিয়ে আরও নির্মোহ গবেষণা হবে, তখন হয়তো আমরা দেখতে পাব—এখানে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কেমন ছিল।

ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন, “শেখ মুজিবের মতো স্যুটকেস গুছিয়ে আত্মসমর্পণের জন্য বসে থাকতেন।” এই যে ঐতিহাসিক ঘটনার একপাক্ষিক ব্যাখ্যা তিনি দিলেন, তা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অন্যায়। আবার ফিরে যাচ্ছি খাদিম হুসেইনের লেখায়। তিনি তাঁর ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওন কান্ট্রি: ইস্ট পাকিস্তান’ বইতে স্পষ্টভাবেই লিখেছেন মুজিবকে গ্রেফতার করা নিয়ে তাদের কী পরিকল্পনা ছিল। আরেকটা বিষয়, যেখানে ফারুক ওয়াসিফ বলছেন, “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব পালিয়ে গিয়েছিল,” তাই তাদের কাপুরুষ বললেন; আবার মুজিব ধরা দিলেন, তাই তাকেও কাপুরুষ হিসেবে ফ্রেম করলেন—তাহলে আসলে আপনি কী চান? আপনার কি মনে হয়, সেই সময় তারা ট্যাঙ্কের তলায় পড়ে মরে গেলে সবচেয়ে ভালো কাজ হতো?

আমি ধরে নিলাম, আপনি বলছেন জিয়াই একমাত্র ঠিক কাজ করেছেন—যুদ্ধ করেছেন। আমি যদি আপনার কথা মেনেও নিই, তাহলেও কি মনে হয় না এখানে অন্যায্য তুলনা হচ্ছে? অর্থাৎ, জিয়া আর্মি পারসন ছিলেন, তিনি কমান্ড করতে পারতেন, তাঁর হাতে অস্ত্রও ছিল। তিনি সেটাই করেছেন, যেটাতে তিনি দক্ষ ছিলেন—অর্থাৎ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে। অন্যদিকে “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব”—আপনি যাদের বলছেন, তাঁরা রাজনীতিবিদ ছিলেন, তাঁরা বন্দুক চালাতে জানতেন না। তাই রাজনীতিবিদ হিসেবে তারা সেটাই করেছেন—অর্থাৎ জীবন বাঁচিয়ে পালিয়ে গিয়ে ২১ দিনের মাথায় একটা সরকার গঠন করেছেন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ফারুক ওয়াসিফের লেখার প্রতি আমার আপত্তি হলো তাঁর বাইনারি ফ্রেমিং। তিনি “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব” ও জিয়াকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন, ঠিক যেমনটা ইতঃপূর্বে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা করেছিলেন। পার্থক্য হলো, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা জিয়াকে বিশ্বাসঘাতক ও শেখ মুজিবকে একমাত্র নেতা হিসেবে দেখিয়েছেন। অন্যদিকে ফারুক ওয়াসিফ তাঁর লেখায় “একাত্তরের মূল নেতৃত্ব” ও মুজিবকে পালিয়ে যাওয়ার দায়ে বা আত্মসমর্পণের অভিযোগে অভিযুক্ত করে জিয়াকে মহান দেখানোর চেষ্টা করছেন।

এই আলাপে রাজনৈতিক ফায়দা রয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু এই আলাপ আমাদের জাতীয় ইতিহাস নিয়ে বিভক্তির ধারা অব্যাহত রাখে। ইতিহাসে যার যতটুকু ভূমিকা, তাকে সেই সম্মান দিতে হবে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের মত ঘটনার সময় সবকিছু বামপন্থীদের থিওরি মতো ঘটে না। ঠিক যেমন ২৪-এর আন্দোলন পুরনো থিওরিতে হয়নি, নতুন থিওরির জন্ম দিয়েছে।

এখন যদি আমরা নাহিদ, মাহফুয, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরকে ২৪-এর প্রধান উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আলাপ শুরু করি, তবে ২৪-এর ঘটনাপ্রবাহ নির্মোহভাবে বুঝতে পারব না। তেমনি ৭১-কে একই ফ্রেমে দেখতে গেলেও একই ঘটনা ঘটবে।

আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ক্রিটিকাল আলাপের পক্ষে, গ্লোরিফিকেশনের বিপক্ষে। ফ্যাক্ট নিয়ে আলোচনা করার সমর্থক, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতির বিপক্ষে। গত ৫৪ বছর আমরা এই বিভেদ থেকে কিছুই পাইনি। ভবিষ্যতেও পাব না। আমাদের দয়া করে এই কুতর্কের মধ্যে আর ফেরত নেবেন না। পলিসি-কেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারের আলাপ কোনো সুফল বয়ে আনে না। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকার এই দেশের জনগণ। আমাদের এইবার গণতন্ত্রে ফিরতে দিন, চেতনার আফিম আর খাওয়াবেন না।


জুলাই আন্দোলনে ভাইরাল হওয়া এক শ্রমজীবীর আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন: সুযোগের দরজা নাকি নতুন শঙ্কা?

মো:রাকিবুল ইসলাম
মো:রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ২১ ১৯:৩৮:২৭
জুলাই আন্দোলনে ভাইরাল হওয়া এক শ্রমজীবীর আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন: সুযোগের দরজা নাকি নতুন শঙ্কা?

জুলাই আন্দোলনের সময় ভাইরাল হওয়া এক রিকশাচালককে আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ঘটনাটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শ্রেণি-বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কাঠামো নিয়ে এক নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি গণতান্ত্রিক অন্তর্ভুক্তির এক চমৎকার উদাহরণ বলে মনে হতে পারে, যেখানে একজন প্রান্তিক মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি আরও গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যায়, এই প্রতীকী অন্তর্ভুক্তি কেবল সুযোগ নয়, বরং নতুন ধরনের সামাজিক ও নৈতিক শঙ্কাও তৈরি করে।

বাংলাদেশের রাজনীতি ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে ছিল। শ্রমজীবী মানুষ বা নিম্ন আয়ের শ্রেণি সাধারণত রাজনীতির ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, নেতৃত্বের জায়গায় তারা প্রায় অনুপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে একজন রিকশাচালকের মনোনয়ন নিঃসন্দেহে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে এক নতুন বার্তা বহন করে। এটি দেখায় যে, গণতন্ত্রের ক্ষেত্রটি এখন কেবল অর্থবান ও প্রভাবশালীদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের প্রতিও কিছুটা উন্মুক্ত হচ্ছে।

তবে, বাস্তবতা আরও জটিল। একজন শ্রমজীবী মানুষ, যার দৈনন্দিন জীবন নির্ভর করে অল্প আয়ের ওপর, হঠাৎ করে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে গেলে তার জীবনে যে চাপ তৈরি হয় তা কল্পনা করা কঠিন নয়। রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সামাজিক প্রত্যাশা এবং অর্থনৈতিক টানাপোড়েন মিলিয়ে সে এমন এক অচেনা বাস্তবতায় পড়ে যায়, যেখানে তার পুরনো জীবনের স্থিতি ভেঙে যায়। ফলে, যে মানুষটি সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার কথা ছিল, সে হয়ে যায় রাজনৈতিক প্রতীক বা প্রচারণার উপকরণ।

এই প্রতীকীকরণ প্রক্রিয়াই আসলে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। প্রান্তিক মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়নের পথ তৈরি করে। কিন্তু যখন তাদের কেবল ভোট বা প্রচারের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন এটি হয়ে দাঁড়ায় একধরনের প্রতারণা। এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক মানুষ রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তার হাতে থাকে না। আর্থিক অনিশ্চয়তা, সামাজিক চাপ, এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঝুঁকি তার জীবনে নতুন অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে, গণতন্ত্রের মূল দর্শনই হলো অংশগ্রহণের সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা। তাই একজন দরিদ্র মানুষ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারছে, এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক অগ্রগতি। কিন্তু এই সুযোগ তখনই বাস্তব ক্ষমতায় রূপ নেবে, যখন তাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহায়তা, নিরাপত্তা এবং সাংগঠনিক সহায়তা প্রদান করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই প্রান্তিক শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, তবে তাদের কেবল মনোনয়ন নয়, বরং ক্ষমতায়নের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

এই ঘটনাটি আমাদের সামনে আরও বড় প্রশ্ন তোলে: বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা কি সত্যিই গণতান্ত্রিক হচ্ছে, নাকি কেবল তার প্রতিচ্ছবি তৈরি করা হচ্ছে? একজন শ্রমজীবীর মনোনয়ন গণতন্ত্রের মুখে মানবিক রঙ যোগ করলেও, যদি তার বাস্তব ক্ষমতা, সুরক্ষা ও মর্যাদা নিশ্চিত না হয়, তবে এটি কেবল রাজনৈতিক প্রতারণার আরেক রূপ।

একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দরিদ্র মানুষ শুধু ভোটার নয়, নীতিনির্ধারকও হয়। কিন্তু সেই বাস্তবতা তৈরি করতে হলে দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৌলিক পরিবর্তন, যেখানে আর্থিক সক্ষমতা নয়, যোগ্যতা ও সামাজিক অভিজ্ঞতা হবে নেতৃত্বের মানদণ্ড।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিতে পারে, যদি তা প্রকৃত সহায়তা ও নৈতিক দায়বদ্ধতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। অন্যথায় এই অন্তর্ভুক্তি হয়ে উঠবে সাময়িক উচ্ছ্বাসের প্রতীক, যার অন্তর্গত বাস্তবতা আরও নির্মম।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র চাই, নাকি কেবল তার প্রতীকী উপস্থাপনেই সন্তুষ্ট থাকতে চাই?


কাদিয়ানী ইস্যু ও পাকিস্তানি সংযোগ: বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক অস্থিরতার ইঙ্গিত

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ নভেম্বর ১৪ ২১:০৬:৪৯
কাদিয়ানী ইস্যু ও পাকিস্তানি সংযোগ: বাংলাদেশের ধর্মীয় রাজনীতিতে বিপজ্জনক অস্থিরতার ইঙ্গিত

বাংলাদেশে আহমদিয়া কমিউনিটি সংখ্যায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আনুমানিক এক লাখ সদস্যের এই গোষ্ঠী দেশব্যাপী সামাজিক পরিসরে এতটাই অদৃশ্য যে অধিকাংশ সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত নেটওয়ার্কে তাদের কাউকে পাওয়া যায় না। ফলে যে সমাজে তাদের অস্তিত্বই প্রায় অদৃশ্য, সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। কেন এই ইস্যুটি স্থানীয় বাস্তবতা ছাড়াই এমনভাবে সামনে আনা হলো এবং কারা এর পিছনে সংগঠিতভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৫ নভেম্বর যে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন হতে যাচ্ছে, তা আয়োজন করছে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদ নামে একটি সংগঠন। কওমি ধারার আলেমদের একটি অংশ, হেফাজতপন্থী গোষ্ঠী এবং আন্তর্জাতিকভাবে উগ্রপন্থি মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত কিছু ব্যক্তিরা এই আয়োজনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। তারা অনলাইন এবং অফলাইনে ব্যাপকভাবে প্রচার চালাচ্ছে এবং দাবি তুলছে যে বাংলাদেশে কাদিয়ানি বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতি, সামাজিক সহাবস্থান এবং ঐতিহ্যের আলোকে এই দাবির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। বরং এটি একটি সংগঠিত রাজনৈতিক পরিকল্পনার ইঙ্গিত দেয়।

এরই মধ্যে ১২ নভেম্বর ঢাকার একটি হোটেলে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকের ভিডিও ও ছবি সমাজমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বৈঠকের আয়োজক ও বক্তাদের মধ্যে কয়েকজন পরিচিত আল কায়েদা ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, যাদের কাউকে দেখা গেছে ৫ আগস্টের পর থানায় অবরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি এবং প্রথম আলো অফিস ঘেরাওয়ের মতো ঘটনাগুলোতেও। এছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতা জসীমউদ্দিন রহমানীর সঙ্গেও এই গোষ্ঠীর যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। এই উপস্থাপনাগুলো দেখায় যে দেশের অভ্যন্তরে একটি চরমপন্থি নেটওয়ার্ক পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে এবং তারা কাদিয়ানী ইস্যুকে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরির সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।

এই সম্মেলনে অংশ নিতে পাকিস্তান, ভারত এবং নেপাল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উলামা বাংলাদেশে এসেছেন। সবচেয়ে আলোচিত নাম হলো পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সংগঠনের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মাওলানা ফজলুর রহমান, যিনি পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে এসেছেন মহাসচিব মাওলানা আবদুল গফুর হায়দারি, মাওলানা আসাদ মাহমুদ এবং আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা। এছাড়াও রয়েছেন রাওয়ালপিন্ডি, করাচি ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন মাদ্রাসার উচ্চপদস্থ শিক্ষক ও বক্তারা। এই ব্যক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধেই পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও মার্কিন ডিপ স্টেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ইমরান খানের পতনের সময়ও ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে উঠেছিল। বিশেষ করে পাঞ্জাবের বক্তা মাওলানা ইলিয়াস গুম্মান শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অব্যাহত বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের জন্য কুখ্যাত।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তরণের এমন সংবেদনশীল মুহূর্তে এইসব বিতর্কিত ব্যক্তিরা কেন একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রচারণায় অংশ নিতে এসেছেন। তাদের এই আগমন মোটেই নিরীহ বা সাধারণ কোনো ধর্মীয় সফর নয়। বরং এটি ইঙ্গিত দেয় যে দেশে অস্থিরতা তৈরিতে ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করা হতে পারে এবং এর পেছনে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ সক্রিয় থাকতে পারে।

পাকিস্তানের ইতিহাস এই বিষয়ে এক ভয়াবহ শিক্ষা দেয়। দেশটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আহমদিয়া ইস্যু সেখানে বারবার রাজনৈতিক সংকট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ১৯৫৩ সালের লাহোর দাঙ্গা ছিল আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে প্রথম বড় আকারের সহিংসতা, যা Munir Commission Report-এর মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল না, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর প্ররোচনায় সংঘটিত হয়। এরপর ১৯৭৪ সালে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করা এবং ১৯৮৪ সালে Ordinance XX জারি করা হয়। প্রতিটি ঘটনা ছিল সামরিক বা আধা-সামরিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কৌশল।

মুফতি মাহমুদ, যিনি মাওলানা ফজলুর রহমানের পিতা, ভুট্টো সরকারের বিরুদ্ধে কাদিয়ানী ইস্যুকে ব্যবহার করেছিলেন এবং পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিলেন। আজ তাঁর পুত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময়ে একই ধরনের ইস্যু নিয়ে ঢাকা সফর করছেন। এটি নিছক ধর্মীয় সফর নয়, বরং পাকিস্তানের অতীত অভিজ্ঞতার ভৌতিক পুনরাবৃত্তি।

বাংলাদেশেও এ কৌশল নতুন নয়। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর যখন গণতান্ত্রিক পথচলা শুরু হয় এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়, তখনই ১৯৯১ সালে আহমদিয়া বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত হয়। খুলনা, রাজশাহীসহ নানা স্থানে হামলা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে নবীন সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপের মুখে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এইবারও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থার কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন যে সরকার শুরুতে এই সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তাদের মনোযোগ এখন নির্বাচন নিয়ে বেশি, এবং হয়তো সমাবেশের ভূরাজনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না। কিন্তু এখন যেহেতু বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের দায়িত্ব হলো বিদেশি উগ্র মতাদর্শধারী ব্যক্তিদের যেকোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা। এমন আন্দোলন ও বিদেশি উলামাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য গভীর নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ একটি বহুধর্মীয়, সহনশীল এবং মানবিক সমাজ। এখানে ধর্মীয় সহাবস্থান ঐতিহাসিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। অথচ এখন সেই পরিবেশে বিদেশি প্রভাব ও উগ্র মতাদর্শ প্রবেশ করে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। কাদিয়ানী ইস্যু বাংলাদেশের জন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আলোচ্য বিষয় নয়। এটি মূলত আন্তর্জাতিক ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার একটি কৃত্রিম কৌশল। বাংলাদেশের উচিত এখনই সচেতন হওয়া, কারণ ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পরিণাম কখনোই শুভ হয় না। পাকিস্তানের ইতিহাসই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাংলাদেশ সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারে না এবং করা উচিতও নয়। এখন রাষ্ট্র, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের উচিত সম্মিলিতভাবে এই ধরনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নেওয়া।


ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

মো: রাকিবুল ইসলাম
মো: রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ০৯ ১১:৪৫:৫৭
ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন বহুমাত্রিক এবং জটিল। রাষ্ট্র কেবল শাসনের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক সত্তা, যার মূল উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, মর্যাদা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করা। অথচ আজ আমরা এমন এক সময় পার করছি, যখন রাষ্ট্রের এই নৈতিক দায়বদ্ধতা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ক্রমশ বাজারের যুক্তি ও পুঁজির অগ্রাধিকারের সঙ্গে অদ্ভুত এক সমঝোতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে রাষ্ট্রের পরিমণ্ডল নাটকীয়ভাবে পাল্টে গেছে। এখন রাষ্ট্রের সফলতা মাপা হয় জিডিপি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, অবকাঠামোগত প্রকল্প বা বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ দিয়ে। কিন্তু এই তথাকথিত উন্নয়ন সূচকগুলো প্রায়ই মানবিক উন্নয়ন বা সামাজিক ন্যায়বিচারের বাস্তব প্রতিফলন ঘটায় না। যখন একজন নাগরিক মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপদ জীবনযাপনের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যুক্তিতে রাষ্ট্র এখন প্রায়শই কর্পোরেট স্বার্থে বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়েছে এবং সাধারণ নাগরিকের চাহিদায় তুলনামূলকভাবে উদাসীন। এর ফলেই ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়-বৈষম্য বেড়েছে, সামাজিক শ্রেণি বিভাজন গভীর হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষ তাদের পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য পায় না, কৃষক উৎপাদনের দাম না পেয়ে ঋণের জালে জড়ায়, শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় সেবার বাইরে থেকে যায়।

এই বৈষম্য কেবল অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক বৈষম্যেরও প্রতিফলন। রাষ্ট্র যখন বাজারের যুক্তিকে মানবিক দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বে স্থান দেয়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এক ধরনের নৈতিক সংকটে পড়ে যায়, যেখানে উন্নয়নের অর্থ হয়ে দাঁড়ায় কেবল ধনীদের আরও ধনী হয়ে ওঠা এবং দরিদ্রদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া।

রাষ্ট্রকে কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে দেখা হলে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। রাষ্ট্র হলো এমন এক প্রতিষ্ঠান যার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা উচিত মানুষ, তার জীবন, মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের অধিকার। রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল দর্শনই হলো জনকল্যাণ। একটি মানবিক রাষ্ট্র কেবল আইন প্রয়োগ করে না, বরং এটি নাগরিকদের জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা দেয়। সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রাষ্ট্রকে বলা যায় একটি নৈতিক সম্প্রদায়, যা সমাজের দুর্বলতম ও প্রান্তিক শ্রেণির প্রতি দায়বদ্ধ। কারণ একটি সমাজের সভ্যতা বিচার করা হয় তার সবচেয়ে দুর্বল মানুষটির প্রতি আচরণের মাধ্যমে।

রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ মানে হলো রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিকতার চেতনায় পুনর্গঠন করা। যেখানে উন্নয়নের মানে হবে না কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ন্যায়, সংস্কৃতি, পরিবেশ এবং সমতার বিকাশ। এই দৃষ্টিভঙ্গির অভাবই আজকের রাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে মানবিকতার শূন্যতায় ঠেলে দিচ্ছে।

একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য রাষ্ট্রকে তার দায়িত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। উন্নয়ন ও কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় কিছু মৌলিক দিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা ও বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। দরিদ্র, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, নারী ও শিশুদের জন্য কার্যকর নিরাপত্তা নেট তৈরি করা দরকার। এগুলোকে রাজনৈতিক প্রদর্শন নয়, বরং বাস্তব কল্যাণে রূপ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা ও ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে। মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা হলো মানবিক রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি। শিক্ষা কেবল চাকরির উপকরণ নয়, এটি মূল্যবোধ, যুক্তি, সহানুভূতি ও নৈতিকতার প্রশিক্ষণ। তাই রাষ্ট্রের উচিত গবেষণা, সৃজনশীলতা ও সামাজিক চিন্তার বিকাশে বিনিয়োগ বাড়ানো, যাতে নাগরিকরা শুধু দক্ষ নয়, সচেতনও হয়।

তৃতীয়ত, স্বাস্থ্যসেবাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একটি মানবিক রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা কখনোই বাণিজ্যিক পণ্য হতে পারে না। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে, প্রান্তিক অঞ্চলে চিকিৎসক নিয়োগ ও ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে, এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। চতুর্থত, শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়ন তখনই অর্থবহ, যখন তা শ্রমিকের ঘামে নয়, মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকে।

পঞ্চমত, রাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। স্থানীয় সরকার, নাগরিক ফোরাম, যুবসংগঠন ও সিভিল সোসাইটির সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে নীতি প্রণয়ন, বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নে। এতে জনগণ নিজেদের রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে অনুভব করবে। ষষ্ঠত, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র মানে কেবল মানুষের ন্যায় নয়, প্রকৃতির প্রতিও দায়িত্বশীলতা।

মানবিক রাষ্ট্র কোনো আদর্শিক কল্পনা নয়, এটি টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। একটি রাষ্ট্র তখনই স্থিতিশীল ও উন্নত হয়, যখন তার নাগরিকরা বিশ্বাস করে যে তাদের জীবন রাষ্ট্রের কাছে মূল্যবান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তখনই অর্থবহ, যখন তা সামাজিক সমতা ও মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করে। অন্যথায় রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন হয়ে ওঠে অন্যায় প্রবৃদ্ধি, যা কেবল কিছু মানুষের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করে।

যখন রাষ্ট্র তার নৈতিক দায়বদ্ধতা হারায়, তখন নাগরিকের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়ে যায় লেনদেনমূলক, আস্থাভিত্তিক নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রকে নিজের বলে অনুভব করে না। এই বিচ্ছিন্নতাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অসন্তোষ ও সহিংসতার জন্ম দেয়। তাই রাষ্ট্রের নৈতিক পুনর্জাগরণ প্রয়োজন তিনটি স্তরে। প্রথমত, নীতিগত স্তরে মানবিকতা, স্বচ্ছতা ও ন্যায়কে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় জবাবদিহিতা এবং নৈতিক প্রশিক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তৃতীয়ত, সাংস্কৃতিক স্তরে সমাজে সহানুভূতি, দানশীলতা ও সামাজিক সংহতির চর্চা বাড়াতে হবে এবং গণমাধ্যম ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করতে হবে।

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গঠন কোনো বিলাসিতা নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের অস্তিত্বের অপরিহার্য শর্ত। রাষ্ট্র যদি তার নৈতিক দায়িত্ব ভুলে যায়, তবে তার উন্নয়ন অবশেষে হয়ে উঠবে এক নির্মম শোষণের প্রক্রিয়া। তাই এখন সময় রাষ্ট্রের আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির। রাষ্ট্রকে ফিরতে হবে সেই মৌলিক দর্শনে, যেখানে নাগরিকই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু, আর শাসকগোষ্ঠী কেবল সেই উন্নয়নের তত্ত্বাবধায়ক।

একটি রাষ্ট্র তখনই প্রকৃত অর্থে সফল হয়, যখন তার প্রতিটি নাগরিক বিশ্বাস করতে পারে যে এই রাষ্ট্র আমার, এই সমাজ আমার, এবং এখানে আমার জীবনের মর্যাদা আছে। ন্যায়, সমতা এবং মানবিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রই পারে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে। রাষ্ট্রের এই নৈতিক পুনর্জাগরণই হতে পারে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক বিজয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের জন্য।


গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত

মো. রাকিবুল ইসলাম
মো. রাকিবুল ইসলাম
সমাজবিজ্ঞান শিক্ষার্থী, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৫ নভেম্বর ০৫ ২০:৪০:০০
গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা: বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠদান, দীর্ঘদিন ধরে পাঠ্যপুস্তকনির্ভর শিক্ষা ও পরীক্ষাকেন্দ্রিক মূল্যায়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণধর্মী চিন্তাভাবনা এবং বাস্তব জীবনে জ্ঞানের প্রয়োগের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। অথচ আজকের পৃথিবী জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা হচ্ছে উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। তাই সময় এসেছে আমাদের উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও দর্শনকে পুনর্বিন্যাস করার, যেখানে গবেষণা হবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু।

বিশ্বের ইতিহাসে যেকোনো মৌলিক পরিবর্তন এসেছে গবেষণার মাধ্যমে। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, নতুন প্রযুক্তির বিকাশ, কৃষি ও স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবন, কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্রনীতির সংস্কারসব ক্ষেত্রেই গবেষণা জ্ঞানের উৎস হিসেবে কাজ করেছে। গবেষণা শুধু তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া নয়, এটি এক গভীর চিন্তা, অনুসন্ধান ও সৃষ্টিশীলতার যাত্রা। তাই একটি জাতিকে সত্যিকার অর্থে জ্ঞানসমৃদ্ধ করতে হলে গবেষণাকে শিক্ষার ভিত্তিতে পরিণত করা ছাড়া বিকল্প নেই।

বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি জাতির চিন্তা, মেধা ও নেতৃত্ব গঠনের কারখানা। এখানেই গড়ে ওঠে নতুন ভাবনা, প্রশ্ন ও অনুসন্ধান। উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা পাঠদানের পাশাপাশি গবেষণাকে মূল ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে। হার্ভার্ড, এমআইটি, কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ যেভাবে বিশ্বজুড়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার মূল কারণ হলো তাদের গবেষণানির্ভর শিক্ষা ও উদ্ভাবনী সংস্কৃতি।

সেখানে শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাসরুমের পাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না; তারা গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকে। কেউ গবেষণা সহকারী হিসেবে (Research Assistant) কাজ করে, কেউ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিক্ষাদানে সহায়তা করে (Teaching Assistant)এতে তারা একদিকে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে, অন্যদিকে আত্মবিশ্বাস, বিশ্লেষণক্ষমতা এবং নেতৃত্বের দক্ষতা গড়ে তোলে।

দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো গবেষণানির্ভর সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায় না। শিক্ষাদানের সহকারী হিসেবেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে তারা কেবল ডিগ্রি অর্জন করলেও বাস্তব দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীল চিন্তায় পিছিয়ে থাকে। এই ঘাটতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং পুরো উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাকে প্রকাশ করে।

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য উচ্চশিক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা চালু করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের রিসার্চ ও টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এজন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, আলাদা বাজেট, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা এবং নিয়মিত মূল্যায়ন। শুরুতে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে এটি চালু করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সফল হলে তা ধাপে ধাপে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত করা সম্ভব।

আজকের শিক্ষার্থীকে কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে আবদ্ধ রেখে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাকে হতে হবে অনুসন্ধিৎসু, চিন্তাশীল ও উদ্ভাবনী। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা সেই পথই তৈরি করতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্যের ভান্ডার নয়, বরং নতুন জ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যা শুধু সনদপ্রাপ্ত কর্মী তৈরি করবে না, বরং সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারবে এমন চিন্তাশীল নাগরিক তৈরি করবে। কারণ গবেষণানির্ভর শিক্ষাই একমাত্র পথ, যা বাংলাদেশকে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে।


সংষ্কারের নামে বিরাজনীতিকরণ: বিএনপির বাস্তববাদী অবস্থান ও এন্টি পলিটিক্সের ফাঁদ

ড. বাতেন মোহাম্মদ
ড. বাতেন মোহাম্মদ
শিক্ষক ও রাজনৈতিক গবেষক
২০২৫ নভেম্বর ০৩ ১৫:২৫:৫৬

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংষ্কার প্রসঙ্গটি এখন এক ধরনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির অবস্থান নিয়ে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত থাকলেও, পুরো প্রক্রিয়ায় দলটি অন্তত সৎ থাকার চেষ্টা করেছেএ কথাটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বিএনপি সে মাত্রায়ই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে, যতটা তার মতো একটি বুর্জোয়া ড্রিভেন ও পার্টি ক্যাপিটালিস্ট দলের পক্ষে বাস্তবিকভাবে সম্ভব। বিএনপি কখনোই আদর্শবাদী দল নয়, বরং এটি বাস্তববাদী দল, যে দল রাজনৈতিক তত্ত্বের চেয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।

চাইলেই বিএনপি সব সংষ্কার প্রস্তাবে “হ্যাঁ” বলে ক্ষমতায় গিয়ে নিজের সুবিধামতো যা পারত বাস্তবায়ন করত, আর যা পারত না সেটাকে নানা যুক্তি ও ব্যাখ্যার ভেতর লুকিয়ে রাখত। অর্থাৎ সুযোগ ছিল সহজ পথে হেঁটে লোকদেখানো সংস্কারে অংশ নেওয়ার। কিন্তু দলটি সেই ইজি রাউট নেয়নি। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি মূলত “ইন্সট্রুমেন্টাল র‍্যাশনাল” অর্থাৎ যে যুক্তিবোধ ক্ষমতার ব্যবহার ও রিসোর্স একুমুলেশনকেই কেন্দ্রে রাখে।

বাংলাদেশের মতো ইনফরমাল অর্থনীতিনির্ভর রাষ্ট্রে এমন দলের কাঠামোতে র‌্যাডিকাল বা গভীর সংস্কারে রাজি হওয়া শুধু কঠিনই নয়, অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় অসম্ভব। তবু বিএনপি তার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি এগিয়েছে। একটা বিশাল দল, যার এখনো দলীয় পরিচালনার জন্য সংগঠিত কোনো অর্থনৈতিক কাঠামো নেই, সেই দলের কাছ থেকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি আশা করাটা অবাস্তব। তার ওপর দেশের ভঙ্গুর প্রাতিষ্ঠানিক উত্তরাধিকারের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার অতিরিক্ত বিকেন্দ্রীকরণ নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র বা পকেট তৈরি করতে পারে, এটাও এক বাস্তব ঝুঁকি।

এই ঝুঁকি জেনেও বিএনপি সংষ্কারে যতটুকু রাজি হয়েছে, সেটিকে যদি কেবল পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মনের প্রত্যাশার ভিত্তিতে বিচার না করে, বরং এক গড়পড়তা শিক্ষিত, নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত চাকরিজীবী বা দলীয় কর্মীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, তাহলে বোঝা যাবে বিএনপি আসলে নিজের সামর্থ্যের চেয়েও বেশি অগ্রসর হয়েছে। তবু যারা সংষ্কারভীতি ছড়িয়ে দলটিকে দুর্বল করতে চাইছে, তাদের আচরণ শেষ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ারই ক্ষতি করছে।

বিএনপি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দল, এটা নতুন কিছু নয়। তবে এই সংষ্কার আলোচনায় তার ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা অন্য যেকোনো দলের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। সাধারণত যার পাওয়ার এসেন্ডিং প্রোবাবিলিটি বেশি, সে নিজের শর্তে দরকষাকষি করে, আর যাদের সম্ভাবনা কম তারা দরকষাকষি করে যতটা আদায় করা যায় সেই যুক্তিতে। এই বাস্তবতা মাথায় রেখেও বিএনপি সংষ্কারের আলোচনাকে এগিয়ে নিয়েছে, এটিই তার বড় রাজনৈতিক পরিণতিবোধের পরিচায়ক।

অবশ্যই আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি আরও উদার হবে। কিন্তু যতটুকু উদার হয়েছে, সেটিও স্বীকার করতে হবে। বিএনপি যদি সত্যিই রিজিড হতো, তবে সংষ্কার প্রক্রিয়া এত দূর অগ্রসর হতো না। এই প্রেক্ষিতে দলটির “নোট অব ডিসেন্ট” বা ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি যদি রাজনৈতিক অহংকার হিসেবে দেখা হয় এবং সেই সুযোগটিও না দেওয়া হয়, তবে সেটি হবে একপ্রকার এন্টি পলিটিক্স ট্রিক, যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই অকার্যকর করে ফেলা হয়। কারণ নির্বাচনী রাজনীতিতে ইগো ও রেটরিক অনেক সময় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।

আজকের সংষ্কার প্রক্রিয়া যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটাকে রাজনীতি বলা যাচ্ছে না। এটা এখন হয়ে উঠছে এক ধরনের বিরাজনীতিকরণ বা এন্টি পলিটিক্স। বিএনপির মতো একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল যদি নিজেও এই ধরনের এন্টি পলিটিকাল টুল প্রয়োগ শুরু করে, তাহলে যতটুকু সংষ্কার অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, ঠিক ততটাই পেছনে চলে যাবে। এর লাভ কারো হবে না, বরং দেশের রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতন্ত্রেরই ক্ষতি হবে শেষ পর্যন্ত।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জাগে, আমরা আসলে রাজনীতি করছি, নাকি রাজনীতিকে ধ্বংস করছি? যে সংষ্কার কার্যক্রমকে এতদিন রাজনৈতিক পুনর্গঠন বলে গলা ফাটানো হলো, সেটাই কি শেষ পর্যন্ত এক এন্টি পলিটিক্স মেশিন হয়ে উঠছে না? সমাজবিজ্ঞানী জেমস ফার্গুসনের ভাষায়, যে প্রক্রিয়া রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার কথা ছিল, সেটিই যখন রাজনীতিকেই নির্বিষ ও অচল করে তোলে, তখন সেটি আর সংষ্কার নয়, এক ধরনের নীরব বিরাজনীতিকরণ।

এটাই আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংষ্কারের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। সংষ্কারের নামে রাজনীতির মৃত্যু, আর রাজনীতির নামে সংষ্কারের অনন্তঅপূর্ণতা

লেখক: ড. মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।


বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ অক্টোবর ৩০ ০৮:৫৬:১০
বিএনপি ও সংস্কারের রাজনীতি: ম্যান্ডেট, কূটচাল ও টেকসই বৈধতার পরীক্ষায় বাংলাদেশ

বিএনপির অনেক নেতা–কর্মী মনে করছেন জামাত, সরকার ও এনসিপি মিলে তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তিন ধরনের দল আছে, A, B ও C। A বড় দল, এই গ্রুপে আছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। B মাঝারি দল, এই গ্রুপে আছে জামাত ও জাতীয় পার্টি। C হলো বাকি দল—যেমন এনসিপি, এবি পার্টি, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ও অন্যান্য বামপন্থি দল। সাম্প্রতিক সময়ে যে সার্ভেগুলো হয়েছে তাতে যদিও দেখা যাচ্ছে জামাতের অবস্থান আওয়ামী লীগের থেকে ভালো, তবু আওয়ামী লীগ যদি ভয়হীন পরিবেশে নিজের মতামত দিতে পারে, নিঃসন্দেহে তাদের অবস্থান জামাতের থেকে বেশি হবে। যাই হোক, সেই বিতর্কে না যাই। এই শক্তির মাত্রা মাথায় রেখেই বিএনপি গুড ফেইথে রাজনৈতিক ঐকমতের আলোচনায় অংশ নিয়েছে, অন্তত বিএনপি তাই মনে করে বলে আমার মনে হয়েছে। এবং আমরা দেখেছি, জুলাই সনদ ও ঘোষণা নিয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এক ধরনের ঐকমতে এসেছে, যদিও এনসিপি তার বাইরে থেকেছে।

বাস্তবতা হলো, দেড় বছর ধরে সরকারের এই পরীক্ষামূলক সংস্কারে বিএনপি অংশ নিয়েছে মূলত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরার আশায়। ঠিক এই প্রত্যাশাকেই বিএনপির দুর্বলতা ভেবে জামাত, এনসিপি ও নব্য এলিটরা দরকষাকষি করেছে, বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপে এমন ধারণাই পাওয়া যায়। কিন্তু এই দরকষাকষির সীমানা কোথায়? সীমানা ছিল, নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র না করা, নির্বাচন না পেছানো এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন না করা। বিএনপি বারবার বলেছে, সংবিধান সংস্কার হবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে। যে কোনো সভ্য দেশে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করেন। অনির্বাচিত কোনো সরকার, তা যেভাবেই আসুক, এই অধিকার রাখে না। জোর করে করা যায়, কিন্তু জোর কেটে গেলে সেই সংস্কার টেকে না, তা যতই মহৎ হোক। জনগণের ম্যান্ডেট অপরিহার্য, আর সেই ম্যান্ডেট পাওয়ার পথ হলো নির্বাচন।এখন যে সব সংস্কার প্রস্তাব উঠছে, সেগুলোর প্রতিটিতে হ্যাঁ–না ভোটে জনমত নেওয়া একদিকে কষ্টসাধ্য, অন্যদিকে ত্রুটিপূর্ণ। প্রশ্ন কীভাবে ফ্রেম হবে, তথ্য কে দেবে, প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ থাকবে, সবকিছুই বিতর্কিত হতে পারে। এমন অবস্থায়, যেখানে আওয়ামী লীগ–সমর্থক ভোটাররা এই সংস্কারে তেমন সমর্থন দেবেন না, সেখানে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ ছিল বাকিদের সমর্থন নিশ্চিত করা, খানিকটা ছাড় দিয়ে হলেও যেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যান্ডেট দাঁড়ায়। নিঃসন্দেহে জামাত, বিএনপি, এনসিপি ও বামপন্থি দলগুলো মিলে এমন একটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি হতে পারত, যা এই ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনকে জনগণের ম্যান্ডেটের বৈধতা দিত। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে সংস্কার কমিশন যে পথে হাঁটলেন, তা রাজনৈতিক ভুল বলেই মনে হতে পারে। এর ফলে হয়তো তারা বিএনপির সমর্থন হারানোর পথে।

আরও স্পষ্ট করে বলি, বাংলাদেশের বৈধতার কেন্দ্র A গ্রুপে। B–C গ্রুপ চাপ দিতে পারে, কিন্তু টেকসই বৈধতা বানাতে পারে না। তাই বিএনপি যদি সনদ থেকে সমর্থন ফিরিয়ে নেয়, জামাত–এনসিপি–সরকার মিলে চেষ্টা করলেও গণভোটে “জনগণের রায়” বলে যা দেখাতে চাইবেন, তা বাস্তবে টেকসই বৈধতা তৈরি করবে না। বিএনপি নব্য এলিট ও বিপ্লবীদের কাছে “সংস্কার–বিরোধী” তকমা পেতেই পারে; কিন্তু গণভোটের হার–জিতের ক্ষেত্রে সেই ফ্রেমিং বড় ভূমিকা নাও রাখতে পারে। কারণ, ম্যান্ডেটের রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের রাজনীতি, এটি পাশ কাটানো যায় না।

আবার, রাজনৈতিক দল ও সরকারের ভেতরের যে অংশ নির্বাচন পিছিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে চায়, তাদের পক্ষে দীর্ঘদিন এই প্রক্রিয়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। আজকের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে কোনো শক্তিই তা রাজনৈতিক দল, আর্মি কিংবা অন্য কেউ, নির্বাচন ছাড়া সরকার গঠন করে টেকসই থাকতে পারবে না। এর শেষ পরিণতি ভয়াবহ। এই জটিল পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনের উচিত ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখানো, সম্মতি জোগাড় করা, সীমা ঠেলে দেখা নয়। তারা উল্টোটা করেছেন, কতটা বাউন্ডারি পুশ করা যায়, বিএনপিকে কতটা বাঁধা দেওয়া যায়, এটাই যেন পরীক্ষা, অন্তত বিএনপির নেতা কর্মীরা তাই মনে করছেন।

প্রশ্ন এখন স্পষ্ট, এই রাজনৈতিক খেলায় বিএনপি কি পারবে নিজের অবস্থান শক্তভাবে জানাতে, না কি আরও ক্ষতির শিকার হবে? বিএনপি যদি আরও ছাড় দিতে থাকে, তৃণমূল এটাকে ভালোভাবে নেবে না; বরং একে দুর্বলতা হিসেবে পড়বে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও বিএনপির দুর্বলতা নিয়ে মজা নেবে। রাজনীতিতে ইমেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে বিএনপির দায়িত্ব, রেডলাইন স্পষ্ট করা: নির্বাচন পেছানো যাবে না; সংবিধান–সংস্কার নির্বাচিত সংসদের ম্যান্ডেটে হবে। ইস্যুর ক্রম ঠিক করা: আগে নির্বাচন, তারপর সংসদীয় প্রক্রিয়ায় সংস্কার; প্রয়োজনে সীমিত, নির্দিষ্ট ধারায় গণভোট। এবং জোটের অঙ্ক কংক্রিট করা: বিচারব্যবস্থা, ইসি–রিফর্ম, মৌলিক অধিকার, ৩–৫টি কমন–মিনিমাম বিষয়ে সমঝোতা, বাকিগুলো সংসদে।

শেষ কথা, বিএনপি আজ ভেটো প্লেয়ার। বিএনপি আউট থাকলে গণভোটের রাস্তা বৈধতা আনতে পারবে না; বরং অনিশ্চয়তা বাড়াবে। তাই বিএনপির এখন দরকার পরিষ্কার সিগনাল, এক লাইনের বার্তা: আগে ম্যান্ডেট, পরে সংস্কার, কিন্তু আরও ভালোভাবে। নির্বাচন ছাড়া এই সঙ্কটের টেকসই সমাধান নেই; এবং নির্বাচন–পূর্ব যেকোনো শর্টকাট শেষতক নিজেই নিজের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

(আমি শুরু থেকেই নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মনে করি না, নির্বাচনের মাধ্যমে দেয়া জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কারও সংবিধান সংস্কারের অধিকার আছে। তাই এই লেখায় আমার অবস্থানগত পক্ষপাত থাকতে পারে।)


রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

মো. অহিদুজ্জামান
মো. অহিদুজ্জামান
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও গবেষক
২০২৫ অক্টোবর ৩০ ০৮:৩৭:১৬
রাজনীতি, নির্বাসন ও নৈতিকতা: শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতাকে কোথায় নিচ্ছে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। নির্বাসনে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে তিনি ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের বিষয়ে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন সরাসরি নাকচ করেছেন। তাঁর ভাষায়, “The question of apology does not arise. My government acted to preserve order and stability.” এই বক্তব্য শুধু একটি রাজনৈতিক মন্তব্য নয়, বরং এটি তাঁর সমগ্র নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।

শেখ হাসিনার এই বক্তব্য প্রকাশের সময় এবং প্রেক্ষাপট একে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। কারণ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তাঁর সরকারের সময় ঘটে যাওয়া দমননীতিকে “brutal and systematic repression” বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ দমনে এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে এবং নিহতদের প্রায় ৭৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ভলকার টার্কের ভাষায়, “Top echelons of the previous government were aware and involved in very serious violations, including enforced disappearances, arbitrary detentions and violent suppression of protests.” এই মন্তব্যগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শেখ হাসিনার সরকারের সময় সংঘটিত ঘটনাগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

এই দুই বাস্তবতা এখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। একজন অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত, তিনি এখন ভারতের আশ্রয়ে অবস্থান করছেন এবং সেখান থেকেই রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত কি কেবল মানবিক কারণে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে, নাকি এটি বাংলাদেশের ওপর কৌশলগত চাপ প্রয়োগের একটি নতুন পদ্ধতি?

ভারত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাঁর সময়েই ভারত সীমান্তনিরাপত্তা, ট্রানজিট, নদী ব্যবহার, জ্বালানি বাণিজ্য ও সংযোগনীতিতে বড় ধরনের সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর এই ভারসাম্য ভেঙে যায়। শেখ হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই দিল্লি তাঁকে আশ্রয় দেয় এবং দ্রুত একটি বিশেষ সুরক্ষিত ভবনে তাঁর জন্য রাজনৈতিক সচিবালয় গঠন করে। এই সচিবালয়ের কার্যক্রম এখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও কিছু কূটনৈতিক উপদেষ্টার তত্ত্বাবধানে চলছে। সেখানে নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দিল্লি কি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের ওপর একধরনের নরম রাজনৈতিক চাপ বজায় রাখতে চাইছে? বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে, তখন দিল্লির উদ্বেগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত মনে করছে, হাসিনার পতনের ফলে তারা বাংলাদেশের ওপর আগের মতো প্রভাব বিস্তার করতে পারছে না। তাই শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তারা একদিকে নিজেদের পুরোনো মিত্রকে ধরে রাখছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের নতুন নেতৃত্বের ওপর কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টে দেওয়া শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটি তাই কেবল তাঁর ব্যক্তিগত মত নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো নির্বাচন বৈধ নয় এবং বর্তমান সরকারের মেয়াদে তিনি দেশে ফিরবেন না। এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তিনি এখনো নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপরিহার্য ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করতে চান। তবে এই বক্তব্যের সময়কাল এবং ভারতের সক্রিয় ভূমিকা ইঙ্গিত করছে যে এটি একটি পরিকল্পিত প্রচারণার অংশ। ভারত হয়তো চায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক অবস্থানকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করতে, যাতে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন কূটনৈতিক মডেল গড়ে তুলছে। জাতিসংঘের সহযোগিতায় গঠিত ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন ইতিমধ্যেই জুলাই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শুরু করেছে। সরকার ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং প্রশাসনিক সংস্কারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই উদ্যোগগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ওআইসি বাংলাদেশকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করছে।

এই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকারের বক্তব্য তাঁর নৈতিক অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। এটি তাঁকে একটি অপ্রায়শ্চিত্ত রাজনৈতিক চরিত্রে পরিণত করেছে, যার কাছে মানবিক সংবেদনশীলতা ক্ষমতার চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ভারত এই অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে কিনা, সেটিই এখন মূল প্রশ্ন। যদি সত্যিই দিল্লি মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত এক সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে আশ্রয় দিয়ে কূটনৈতিক প্রভাব বজায় রাখতে চায়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ার নীতিগত রাজনীতির জন্য একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রমাণ করেছে, জনগণের ইচ্ছাশক্তি যেকোনো কূটনৈতিক চাপে বেশি শক্তিশালী। শেখ হাসিনার ক্ষমা অস্বীকৃতি ও ভারতের কৌশলগত দ্বৈততা হয়তো সাময়িক প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে ন্যায়, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ।

দক্ষিণ এশিয়ার সামনে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আছে। কোনো রাষ্ট্র বা নেতা যদি জনগণের আস্থা হারায়, তবে তাকে আশ্রয় বা সমর্থন দিয়ে কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখা কখনো স্থায়ী হয় না। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার ও ভারতের বর্তমান ভূমিকা সেই সত্যটিকেই আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।


অভিভাবকতন্ত্রের প্রলোভন: জেনারেল ভূঁইয়ার বয়ান ও গণতন্ত্রের ঘড়ি থামানোর বিপদ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ অক্টোবর ১৮ ১৬:৪৩:৩১

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সম্প্রতি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখছেন ধারাবাহিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী পোস্ট, যার শিরোনাম “আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি?” এর পঞ্চম অংশে তিনি আলোকপাত করেছেন “বিএনপি ক্ষমতায় এলে সম্ভাব্য চিত্র” বিষয়ে। অভিজ্ঞ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে মনোযোগ দাবি করে। তবে তাঁর লেখার রাজনৈতিক ফ্রেমিং ও বিশ্লেষণের অন্তর্নিহিত ধারা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার প্রয়োজন আছে, বিশেষ করে যখন সেই বয়ানে নির্বাচিত রাজনীতিকদের “সমস্যা” এবং অ-নির্বাচিত এলিট বা উপদেষ্টাদের “সমাধান” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

এই ফ্রেমটি প্রথমেই একটি মৌলিক অস্বস্তি তৈরি করে, কারণ এটি প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কার্যকারিতাকে একমাত্র গুণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। যেন গণতন্ত্রের মূল যুক্তি, অর্থাৎ ভোটের মাধ্যমে ম্যান্ডেট অর্জন, অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে এবং তার জায়গা নেয় “যোগ্য” অ-নির্বাচিত অভিভাবকদের শাসন। এটি একটি বিপজ্জনক স্লিপারি স্লোপ, যেখানে জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পরিবর্তে অভিভাবকতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হয়। ইতিহাস বলছে, একবার যদি এই পথে যাত্রা শুরু হয়, নির্বাচনী রাজনীতির প্রাণশক্তি ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।

জেনারেল ভূঁইয়ার লেখায় একটি স্পষ্ট কৌশল দেখা যায়, সেটি হলো ভয়কে রাজনৈতিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা। তিনি ভারতীয় চাপ, অর্থনৈতিক সংকট, পুলিশের অকার্যকারিতা, রাস্তার সহিংসতা ইত্যাদি উদাহরণ টেনে এনে বলেছেন যে এসব কারণেই হয়তো অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় বাড়াতে হবে বা “বিশেষ ব্যবস্থা” নিতে হতে পারে। এই ভয়নির্ভর বয়ান জনমনে এমন ধারণা তৈরি করে যে নির্বাচন অনিশ্চিত, ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিলম্বই নিরাপদ পথ। ফলত একটি “ইলেকশন-অপশনাল” মানসিকতা জন্ম নেয়, যেখানে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে ঐচ্ছিক হয়ে ওঠে। এটি গণতন্ত্রের শিকড় ক্ষয়ে দেওয়ার এক নীরব উপায়।

যখন তিনি লেখেন “রিফর্ম আগে, নির্বাচন পরে”, সেটি আসলে এক বিপরীত রাজনৈতিক সিকোয়েন্সের প্রচলন। টেকসই গণতন্ত্রে সংস্কারের বৈধতা আসে নির্বাচনের ম্যান্ডেট থেকে, কিন্তু তিনি উল্টো বলছেন নির্বাচনের আগেই সংস্কার হোক। বাস্তবে এর অর্থ দাঁড়ায় জনগণের ম্যান্ডেটহীন শক্তির হাতে রাজনৈতিক সংস্কারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া। “রিফর্ম-ফার্স্ট” চিন্তাধারা অচিরেই “ইলেকশন-লেটার” হয়ে যায়, আর পিছিয়ে দেওয়া ভোট খুব কম ক্ষেত্রেই ফিরে আসে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই তার প্রমাণ।

আরও উদ্বেগজনক হলো, জেনারেল ভূঁইয়া তাঁর লেখায় নিরাপত্তা কাঠামোকে এক ধরনের “নিরপেক্ষ ম্যানেজার” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পুলিশকে “অলস ঘোড়া” আখ্যা দিয়ে সেনাকে মাঠে রাখার বিষয়টি তিনি নিছক ম্যানেজমেন্ট ইস্যু হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি বেসামরিক জবাবদিহির প্রশ্নকে আড়াল করে এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে ডি-ফ্যাক্টো রাজনৈতিক রেফারিতে রূপান্তরিত করে। গণতন্ত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা কখনোই রাজনীতির ভারসাম্যরক্ষাকারী হতে পারে না, কারণ তাতে নির্বাচিত নেতৃত্বের জবাবদিহি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সরে যায় অদৃশ্য ব্যবস্থাপক মহলের হাতে।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জেনারেল ভূঁইয়া সম্ভাব্য বিএনপি সরকারের প্রতি আগেভাগেই অবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন। তাঁর পূর্বাভাসে দেখা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুর্নীতি বাড়বে, ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে, রাস্তায় সহিংসতা হবে। এই ধরনের পূর্বাভাস আসলে রাজনৈতিক আগাম অবমূল্যায়ন, যা একটি বিপজ্জনক বার্তা দেয় যে “ভুল দল” জিতলে সেটিকে “ম্যানেজ” করা ন্যায্য। এতে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৌলিক শর্ত, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদল, শর্তাধীন হয়ে পড়ে।

তাঁর বয়ানে নাগরিকরা নায়ক নয়, বরং “ঝুঁকি”। সমাধান খোঁজা হয় এলিট মহলের ভেতরে, “যোগ্য উপদেষ্টা” বা “সমঝোতার সরকার”-এর মধ্যে। এটি একধরনের ক্লাসিক এলিট সাবস্টিটিউশন, যেখানে জনসম্মতি সরিয়ে পেছনের দরজার চুক্তি সামনে আনা হয়। এতে রাজনৈতিক দল, ভোটার ও নীতির স্বাভাবিক সংযোগ দুর্বল হয়ে পড়ে; আস্থা কমে, অংশগ্রহণও হ্রাস পায়। ফলত গণতন্ত্র কেবল আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় সীমিত থেকে যায়।

আরেকটি বিষয় হলো, তাঁর লেখায় বারবার “বহির্দেশের ভেটো”, বিশেষ করে ভারতের প্রভাব, একটি অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়। এতে ইঙ্গিত মেলে যে নীতি-প্রসঙ্গগুলোতে বাইরের “রেড লাইন” অতিক্রম করা যায় না। এটি আসলে সার্বভৌম ভোটের অস্বীকৃতি, যেখানে জনমতকে আগে থেকেই সঙ্কুচিত বৃত্তে বন্দি করে ক্ষমতাবান এলিটরা সিদ্ধান্ত নেন কী সম্ভব আর কী নয়।

সব মিলিয়ে, জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়ার লেখার অন্তর্নিহিত বার্তা হলো ভয়নির্ভরতা, “রিফর্ম-ফার্স্ট” সিকোয়েন্স, এলিট ও টেকনোক্র্যাটিক সমাধান, এবং নিরাপত্তা কাঠামোর রাজনৈতিক ভূমিকার স্বাভাবিকীকরণ। এগুলো মিলে এক নতুন প্রকারের অভিভাবকতন্ত্রের ধারণা তৈরি করে, যেখানে জনগণ নয়, “দক্ষ ব্যবস্থাপক”-ই রাজনীতির নিয়ামক।

কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প নয়, এটি জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রতিফলন। প্রজাতন্ত্র স্থিতি পায় ব্যালটের ঘড়িতে, যে ঘড়ির কাঁটা কারও ইচ্ছেমতো থামানো যায় না। নির্বাচনের সময়, গতি বা ফলাফল নিয়ে ভয় দেখানোর পরিবর্তে আমাদের দায়িত্ব হলো সেই ঘড়িটিকে সচল রাখা, যাতে জনগণই হয় ক্ষমতার একমাত্র উৎস।

জেনারেল ভূঁইয়ার প্রস্তাবিত “প্রাগম্যাটিক” পথটি যতই বাস্তবসম্মত মনে হোক, তার ভেতরে নিহিত আছে গণতন্ত্রের স্থবিরতার বীজ। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই স্থবিরতা থেকে মুক্ত থাকা, ব্যালটের ঘড়িকে চালু রাখা, এবং সব রাজনৈতিক শক্তিকে সেই সময়ের অধীন আনতে সক্ষম হওয়া। কারণ শেষ পর্যন্ত জনগণের ভোটই এই প্রজাতন্ত্রের প্রাণ, আর সেটিকে স্থগিত রাখা মানেই জাতির হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়া।


নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

আসিফ বিন আলী
আসিফ বিন আলী
শিক্ষক ও স্বাধীন সাংবাদিক
২০২৫ সেপ্টেম্বর ১৪ ২৩:০৪:১৩
নেপালের গণঅভ্যুত্থান থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈধতার সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আগামীর চ্যালেঞ্জ

সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একের পর এক গণঅভ্যুত্থান আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে রাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামো দুর্বল হলে জনগণই চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিতে পারে। প্রথমে শ্রীলঙ্কা, পরে বাংলাদেশ এবং সবশেষে নেপাল—তিন দেশেই জনবিস্ফোরণ ঘটল। তিন ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেল ক্ষমতার কেন্দ্র, রাজনৈতিক নেতাদের সম্পত্তি ও বাসভবন জনগণের আক্রমণের মুখে পড়েছে। মূল অভিযোগ ঘুরপাক খাচ্ছে দুর্নীতি, দমন–পীড়ন এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকে ঘিরে। শ্রীলঙ্কায় তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছিল, বাংলাদেশ ও নেপালে ছাত্র–যুবকরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এ অভিজ্ঞতাগুলো প্রমাণ করে যে যুবসমাজ যখন সামনে আসে, তখন আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি অস্তিত্ববাদী প্রশ্নে রূপ নেয়—রাষ্ট্র কার জন্য?

নেপালের অভ্যুত্থান একটি বিশেষ শিক্ষা দেয়। সেখানে সংসদ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছিল এবং সরকার গণভোট ও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। তবু জনরোষে ভেসে যায়। আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল দুর্নীতি, এবং ক্ষোভের শিকার হয়েছে সরকার ও বিরোধী—উভয় শিবির। অর্থাৎ এটি শুধু regime change নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক শ্রেণির প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে একে বলা হয় anti-establishment mobilization। এখানে আমরা Lipset-এর legitimacy theory প্রয়োগ করতে পারি। জনগণ যখন দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, তখন সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তার বৈধতা নষ্ট হয়। বৈধতা হারানো সরকার কাগজে কলমে টিকে থাকে, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতায় মৃতপ্রায় হয়ে যায়।

বাংলাদেশে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। বিএনপি আশা করছে তারা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ আপাতত রাজনীতির বাইরে থাকলেও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ইতিহাস বলে, সংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি থেকে বাদ রাখা যায় না। Samuel Huntington-এর Political Order in Changing Societies এ প্রসঙ্গেই সতর্ক করেন—ফিরে আসার পথ রুদ্ধ করলে ভবিষ্যতে আবার সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। অতএব, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। যদি গণতান্ত্রিক পথে তা সম্ভব না হয়, তবে সহিংসতার মাধ্যমে ফেরার চেষ্টা করবে—এমন সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যাবে না।

বাংলাদেশের আরেক বাস্তবতা হলো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক ব্লকের উত্থান। এখানে মওদুদপন্থী দল থেকে শুরু করে কট্টরপন্থী খিলাফতবাদী গোষ্ঠী পর্যন্ত সক্রিয়। তবে সবচেয়ে সংগঠিত শক্তি হলো জামায়াতে ইসলামি। সংগঠন, অর্থ, রাজনৈতিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতায় তারা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এখনই হয়তো তাদের জাতীয় ক্ষমতা দখলের সামর্থ্য নেই, কিন্তু আগামী কয়েক বছরে শক্তি বহুগুণে বাড়তে পারে। তখন প্রশ্ন থাকবে—তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সম্মান করবে, নাকি Charles Tilly-এর contentious politics তত্ত্বের মতো বিপ্লবী পথে হাঁটবে? নেপাল–স্টাইলে বিপ্লবী পথে হেঁটেও তারা বিস্ময় তৈরি করবে না।

বর্তমানে বিএনপি–বিরোধীরা সফলভাবে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠা করেছে যে বিএনপি একটি দুর্নীতিবাজ দল। এখানে কার্যকর হয়েছে labeling theory। যখন কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির লেবেল একবার বসে যায়, তখন তা সত্য বা মিথ্যা যাই হোক না কেন, সামাজিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তার করে। সরকারে গেলে এই ধারণা আরও তীব্র হতে পারে, কারণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বল। এই প্রেক্ষাপটে আগামী সরকারকে দুটি অস্তিত্বমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমত, প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে ফিরতে চাইবে। এখানে power transition theory প্রযোজ্য—প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি দীর্ঘমেয়াদে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টা করে এবং সেটি স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। দ্বিতীয়ত, ক্রমবর্ধমান ইসলামপন্থী চাপ ইসলামি রাষ্ট্র প্রকল্পকে আরও শক্তিশালী করবে। এ প্রেক্ষাপটে social movement theory-এর radical flank effect ব্যাখ্যা করে কীভাবে মাঝারি ইসলামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থীদের দিকে ঝুঁকতে পারে।

এই দুই চাপে দুর্বল সরকারের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। নেপাল আমাদের শিক্ষা দেয় যে দুর্নীতি, বৈধতা সংকট এবং জনগণের আস্থা হারানো একটি গণতান্ত্রিক সরকারকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশও এখন এক অস্বাভাবিক সময়ে দাঁড়িয়ে। বিএনপি যদি ভাবে সরকার গঠন করলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তবে তা হবে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি। প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি এই দ্বৈত চাপে (আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন ও ইসলামপন্থী উত্থান) টিকে থাকার মতো রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি নিচ্ছে? নাকি আমরা আবারও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক চক্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে অস্থিরতা শেষে সামরিক শাসনই হয়ে ওঠে শেষ অবলম্বন? বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে। আর এখানেই মূল প্রশ্ন—আমরা কি নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেব?

পাঠকের মতামত:

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ গড়তে হলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই তার সামাজিক ও নৈতিক দায়বদ্ধতা পুনরুদ্ধার করতে হবে

রাষ্ট্রের ধারণাটি একসময় কেবল প্রশাসনিক ক্ষমতা, আইনের শাসন এবং নিরাপত্তা প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রের ভূমিকা এখন... বিস্তারিত