মরুর দাবদাহে হজ: কঠোরতার মাঝে ঈমানের প্রশান্তি

মরু অঞ্চলের রুক্ষ ও উত্তপ্ত পরিবেশকে উপেক্ষা করে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখো মুসলিম এবারও হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের পবিত্র নগরী মক্কায় সমবেত হচ্ছেন। হজ ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম, যা সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে একবার পালন করা ফরজ। সৌদি সরকারের তথ্যানুসারে, চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১৩ লাখের বেশি নিবন্ধিত হজযাত্রী সৌদি আরবে পৌঁছেছেন এবং এই সংখ্যা হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এবারের হজের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে তীব্র তাপদাহ। গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে হজ চলাকালে তাপমাত্রা ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল, যা ইতিহাসে অন্যতম সর্বোচ্চ। এর ফলে মাত্র কয়েক দিনে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১,৩০১ জন হজযাত্রী। তাদের অনেকেই বৈধ অনুমতি ছাড়া হজে অংশ নিয়েছিলেন এবং তারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবু বা পরিবহন সুবিধা পাননি, যার ফলে তাপমাত্রা ও পানিশূন্যতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ এবার হজ ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েছে।
চলতি বছর হজ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী মক্কা, মিনা ও আরাফাতের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, অন্তত ৪৪ জন হজযাত্রী হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে হজযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সৌদি সরকার এবার ৪০টির বেশি সরকারি সংস্থাকে হজ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত করেছে। এতে কাজ করছেন প্রায় ২ কোটি ৫ লাখ কর্মী। প্রতিটি জায়গায় বাড়তি ছায়া দেওয়ার ব্যবস্থা হিসেবে ৫০ হাজার বর্গমিটার এলাকা ছায়াবৃত করা হয়েছে, মোতায়েন করা হয়েছে ৪০০টিরও বেশি শীতলীকরণ ইউনিট এবং প্রস্তুত রাখা হয়েছে হাজার হাজার চিকিৎসাকর্মী ও অ্যাম্বুলেন্স।
হজ ব্যবস্থাপনায় এবার অন্যতম বৈপ্লবিক সংযোজন হলো আধুনিক প্রযুক্তি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ড্রোন নজরদারি, রিয়েল টাইম ভিডিও অ্যানালিটিক্সসহ বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনসমাগম ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। জনবহুল স্থানগুলোতে জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং দ্রুত জরুরি সাড়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসব প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরাফাত, মিনা ও মুজদালিফার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ড্রোন দিয়ে পর্যবেক্ষণ চালানো হচ্ছে যাতে বড় আকারের কোনো ভিড় এড়ানো যায়।
অবৈধ হজযাত্রী নিয়ন্ত্রণেও সৌদি সরকার এবার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। প্রতিটি দেশ থেকে হজের জন্য নির্দিষ্ট কোটা বরাদ্দ করা হয় এবং সাধারণত সেই কোটার আওতায় লটারির মাধ্যমে নিবন্ধিতদের হজ পালনের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু অতীতে অনেকেই অনুমতি ছাড়া হজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এবার সৌদি সরকার মক্কায় প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চেকপোস্ট জোরদার করেছে। মোবাইল ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো, বিশেষ স্ক্যানিং ব্যবস্থা, রোবটিক টহল এবং ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে অবৈধ প্রবেশ ঠেকানো হচ্ছে। অনুমতি ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করলে বিপুল অঙ্কের জরিমানা, গ্রেপ্তার এবং ভবিষ্যতে ১০ বছরের জন্য সৌদি আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার নিয়ম চালু করা হয়েছে।
২০১৫ সালের স্মরণীয় দুর্ঘটনার কথাও এখানকার নিরাপত্তা প্রস্তুতিতে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই বছর মিনায় ‘শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ’ অনুষ্ঠানের সময় পদদলিত হয়ে প্রায় ২ হাজার ৩০০ জন হজযাত্রী মারা যান, যা ছিল হজ ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি। পরবর্তী বছরগুলোতে সৌদি সরকার ধাপে ধাপে হজ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনেছে এবং এবার তা আরও সুসংগঠিত ও প্রযুক্তিনির্ভর।
হজযাত্রীদের অনেকেই মরু গরমের মধ্যে থেকেও আবেগাপ্লুত হয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন। ফিলিপাইনের শরিয়া পরামর্শক আব্দুল মাজিদ আতী বলেন, “এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদ। এখানে আমরা অনেক শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করছি।” নাইজেরিয়ার ২৭ বছর বয়সী আবদুলহামিদ বলেন, “আমি কখনোই রোদচশমা ছাড়া বের হই না। এখানে আবহাওয়া খুবই, খুবই গরম। কিন্তু হজ করতে এসে আমি আনন্দে পরিপূর্ণ।” অন্যদিকে সেনেগালের ৫২ বছর বয়সী মারিয়ামা বলেন, “আমি সারাজীবন এই স্বপ্ন দেখেছি। সবসময় ভাবতাম, কবে মক্কায় গিয়ে হজ করতে পারব।”
হজ শুধুই ধর্মীয় অনুশীলন নয়, এটি সৌদি আরবের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত। প্রতিবছর হজ ও উমরাহ থেকে দেশটি ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করে থাকে। পাশাপাশি ধর্মীয় মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। সৌদি বাদশাহ নিজেকে ‘দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন, যা মধ্যপ্রাচ্যে তাঁর অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
পরিবেশবিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশ্লেষকরা অবশ্য হজের ভবিষ্যৎ নিয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন। জার্মানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট অ্যানালিটিকস-এর গবেষক ফাহাদ সাঈদ বলেন, “বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হজের সময় মরু অঞ্চলের তাপমাত্রা ভয়ানকভাবে বাড়ছে। অনেকের দেহের অভিযোজন ক্ষমতা কাজ করে না, ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।”
সব মিলিয়ে এবারের হজের প্রস্তুতি যেমন উন্নত, তেমনি চ্যালেঞ্জও বড়। প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা ও চিকিৎসা সহায়তা হজযাত্রীদের স্বস্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যথেষ্ট বলেই সৌদি কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস। তবে ভবিষ্যতের হজ ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু সহনশীলতা এবং আরও উদ্ভাবনী পরিকল্পনা জরুরি হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে চার্জ দাখিল, বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার
- বাহরাইনেরমানামায় বিএনপির সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নেতৃত্বে আক্তার হোসেন
- বাহরাইনে জাতীয়তাবাদী শক্তির পুনর্জাগরণ: গ্যালালী শাখায় নতুন নেতৃত্ব
- চীন না ভারত? উন্নয়ন না আনুগত্য? বুলেট ট্রেন বলছে স্পষ্ট জবাব
- অবশেষে বিসিবি সভাপতি ফারুককে নিয়ে মুখ খুললেন আসিফ
- বিশ্বশক্তির নজর এখন বাংলাদেশে: খনিজ ভাণ্ডারের নতুন মানচিত্র
- তারেক-ইউনুস উত্তপ্ত ফোনালাপ: যা জানা গেল
- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান: রাষ্ট্র নির্মাণের এক উজ্জ্বল প্রতিমূর্তি
- নতুন বিসিবি সভাপতিবুলবুলের কাছে আশরাফুলের চাওয়া
- হালদা নদীতে ডিম ছাড়ল রুই জাতীয় মা মাছ, সংগ্রহ প্রায় ১৪ হাজার কেজি নিষিক্ত ডিম
- ঈদের দিন বৃষ্টি হবে কি?
- চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন ভোর: দক্ষিণ এশিয়ার তেলের ‘রাজসিংহাসন’ দখলের পথে বাংলাদেশ?
- ভারতের গর্ব এস-৪০০ ধ্বংস: বাস্তবতা নাকি প্রচারযুদ্ধ?
- ধ্বংস থেকে নেতৃত্ব: ৫ আগস্ট থেকে যেভাবে শুরু হলো অর্থনীতির পুনর্জাগরণ
- জবি’র সাবেক অধ্যাপক আনোয়ার বেগম হত্যাচেষ্টা মামলায় সুত্রাপুরে আটক