এক কলম, এক চেতনা: মানিক মিয়ার সাংবাদিকতার মহাজাগরণ

২০২৫ জুন ০১ ১৫:০১:১৮
এক কলম, এক চেতনা: মানিক মিয়ার সাংবাদিকতার মহাজাগরণ

১৯০৪ সালের বরিশালের পোড়াকান্দুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। একাধারে ছিলেন প্রথিতযশা সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং চিন্তাবিদ, যিনি শুধু তথ্য পরিবেশন করেননি, বরং সাংবাদিকতাকে এক শক্তিশালী রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতীয়তা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

মানিক মিয়ার সাংবাদিকতা ছিল পেশার চেয়েও অনেক বেশি। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাংবাদিকতা হলো একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং একটি নৈতিক চুক্তি, যা জনগণের স্বার্থে ও সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে যখন পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও পশ্চিমা আধিপত্যবাদ সংবাদমাধ্যমকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ করছিল, তখন মানিক মিয়া দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সেটিকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ ভাষায় রূপান্তরিত করেন।

তার কলাম ‘রাজনৈতিক ডায়েরি’ ছিল রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদের এক অনন্য মঞ্চ, যা দেশের গণমানসকে প্রভাবিত করেছিল। একদিকে যেমন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাকে ‘বিপজ্জনক’ ভাবত, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের অগ্রণী নেতৃত্ব হিসেবে তাঁকে সম্মান জানাত।

১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার ভূমিকা ছিল মূল চালিকা শক্তি। একইভাবে ১৯৬২-৬৪ সালের আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন এবং ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের সময়ে ‘ইত্তেফাক’ দেশের বৃহৎ জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময়ে পাকিস্তানি সরকার ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকার অফিস বন্ধ করে দেয়, বারবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং কারাবরণে ফেলে মানিক মিয়াকে। তবু তিনি থামেননি, বরং কারাগারে থেকেও কলম চালিয়ে গণতন্ত্র ও মুক্তির ভাষা বজায় রেখেছেন।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী চেতনা, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বাঙালি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানিক মিয়ার লেখনী জাতির আত্মচেতনার আলো জ্বালিয়েছে। তিনি সংবাদপত্রকে কেবল খবরের খাতায় পরিণত হতে দেননি, বরং গণমানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির এক শক্তিশালী মাধ্যম বানিয়েছেন।

আজকের প্রেক্ষাপটে যখন সাংবাদিকতা পুঁজিকেন্দ্রিক ও রাজনৈতিক প্রভাব দ্বারা সংকুচিত, মানিক মিয়ার জীবন ও আদর্শ আমাদের কাছে এক অনুপ্রেরণা। তার দেখানো পথে ফিরে গেলে গণমাধ্যম আবারও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। সংবাদপত্র হবে সত্যের প্রেরক, কলম হবে অবিচল প্রতিবাদের অস্ত্র।

১৯৬৯ সালের ১ জুন মৃত্যুবরণ করলেও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া রেখে গেছেন এক সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার দর্শন, যা আজকের সাংবাদিক সমাজের জন্য নৈতিকতা, সাহস ও দেশপ্রেমের এক জীবন্ত পাঠশালা। তিনি প্রমাণ করেছেন, সাংবাদিকতা হতে পারে এক কলমের বিপ্লব, যার আগুনে গলে যায় অন্যায়ের কাঠামো।

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কেবল অতীতের গৌরব নয়, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা ও জাতির জন্য এক দিকনির্দেশক নক্ষত্র। তার জীবন ও কর্ম আমাদের শিখিয়েছে সত্য প্রকাশ, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো ও সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে সাংবাদিকতা হতে পারে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এই আদর্শ রক্ষায় ও বাস্তবায়নে আজকের সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের অবিরত প্রচেষ্টা জরুরি।

-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত