ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’: মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার যুগে প্রবেশ

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২১ ১১:০৯:৩৯
ট্রাম্পের ‘গোল্ডেন ডোম’: মহাকাশে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার যুগে প্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ আজ “গোল্ডেন ডোম” নামক নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা কর্মসূচির রূপরেখা প্রকাশ করেছেন, যা প্রথমবারের মতো মহাকাশে অস্ত্র স্থাপন করবে। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক ভাষণে ট্রাম্প জানান, “হাইপারসোনিক, ব্যালিস্টিক ও উন্নত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র” প্রতিহত করতে সক্ষম একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

মহাকাশভিত্তিক প্রতিরক্ষা: ভবিষ্যতের যুদ্ধ কৌশল

ট্রাম্প বলেন, “আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমেরিকান জনগণকে একটি সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা বর্ম দেবো যা বিদেশি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করবে।” এই সিস্টেমে থাকবে “মহাকাশ-ভিত্তিক সেন্সর ও ইন্টারসেপ্টর”, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত বা মহাকাশ থেকেই উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে পারবে।

“একবার নির্মাণ সম্পন্ন হলে গোল্ডেন ডোম হবে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা,” বলেও তিনি দাবি করেন।

এই ঘোষণার মাত্র চার মাস আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে এই কর্মসূচির সূচনা করেছিলেন। স্পেস ফোর্স-এর ভাইস চিফ অব স্পেস অপারেশনস জেনারেল মাইকেল গ্যুটলাইনকে এই প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে।

‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে অভিহিত, তবে ব্যয়ের ধোঁয়াশা

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ একে “আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য যুগান্তকারী বিনিয়োগ” হিসেবে আখ্যা দেন। যদিও হোয়াইট হাউস থেকে সিস্টেমটির বিস্তারিত এখনও প্রকাশ করা হয়নি, তবে পেন্টাগন বিভিন্ন সম্ভাব্য কার্যকারিতা ও উপাদান নির্ধারণে কাজ করছে।

কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস (CBO) এক হিসাব অনুযায়ী জানিয়েছে, গোল্ডেন ডোম-এর শুধুমাত্র মহাকাশভিত্তিক অংশের ব্যয় আগামী ২০ বছরে পৌঁছাতে পারে ৫৪২ বিলিয়ন ডলারে। কারণ, কার্যকর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে বিপুল সংখ্যক সেন্সর ও ইন্টারসেপ্টর প্রয়োজন হবে।

কিন্তু ট্রাম্প একটি তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরেন—প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি জানান, “আমার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এটি সম্পূর্ণরূপে চালু হবে, অর্থাৎ তিন বছরের মধ্যেই। আমরা বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই এটি তৈরি করবো।”

তবে এই বিশাল প্রকল্পের জন্য এখনো কোনো অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি। ট্রাম্প ঘোষণা দেন, কংগ্রেসে চলমান ট্যাক্স কাট বিলের মাধ্যমে তিনি এই প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ২৫ বিলিয়ন ডলার চাচ্ছেন, তবে আইন প্রণেতাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে এই পরিমাণ কমে যেতে পারে।

তিনটি সংস্করণ, ট্রাম্প বেছে নিলেন ‘উচ্চ’ সংস্করণ

অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ট্রাম্পকে এই প্রকল্পের তিনটি সংস্করণ পেশ করা হয়েছিল—“মাঝারি”, “উচ্চ” এবং “অত্যন্ত উচ্চ”। প্রতিটি সংস্করণে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক স্যাটেলাইট, সেন্সর ও ইন্টারসেপ্টরের পরিকল্পনা ছিল। ট্রাম্প বেছে নেন “উচ্চ” সংস্করণটি, যার প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে।

ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ ও রিগানের স্বপ্নের ছায়া

ট্রাম্প বলেন, “এই উদ্যোগের পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের ১৯৮৩ সালের স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ।” তিনি আরও বলেন, “এই প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা রিগানের স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছি—আমেরিকার উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কাকে চিরতরে শেষ করা।”

স্বার্থসংঘাত নিয়ে উদ্বেগ: মাস্কের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ

তবে এই প্রকল্পকে ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু বিতর্ক। বিশেষ করে প্রযুক্তি উদ্যোক্তা এলন মাস্ক ও তাঁর প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ৪২ জন ডেমোক্র্যাটিক আইনপ্রণেতা এক চিঠিতে মাস্কের বিরুদ্ধে স্বার্থসংঘাত ও অনৈতিক প্রভাব খাটানোর অভিযোগ এনে তদন্তের দাবি তুলেছেন। তারা বলেন, “যদি মাস্ক প্রকল্পে অনৈতিক প্রভাব খাটান, তবে এটি হবে স্বার্থসংঘাতের আরও একটি উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত।”

এই বিষয়ে ট্রাম্প নির্দিষ্টভাবে কোনো কোম্পানির নাম না বললেও জানান, এই প্রকল্প আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য—যেমন আলাস্কা, ইন্ডিয়ানা, ফ্লোরিডা ও জর্জিয়াতে শিল্প প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। তিনি আরও জানান, কানাডাও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রকল্পে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষণ: প্রযুক্তির উত্তরণ না কি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা?

‘গোল্ডেন ডোম’ নিঃসন্দেহে প্রযুক্তিগতভাবে একটি চমকপ্রদ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। এটি মহাকাশে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করতে যাচ্ছে, যা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তাকেই নয়, বরং বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারে।

তবে এতে রয়েছে একাধিক জটিলতা। প্রথমত, এত উচ্চমূল্যের প্রকল্প কতটা প্রযুক্তিগতভাবে কার্যকর হবে, তা এখনো পরীক্ষাধীন। দ্বিতীয়ত, এটি একটি নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে পারে। রাশিয়া, চীন বা উত্তর কোরিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের রক্ষা ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হবে, যা সামরিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে।

তৃতীয়ত, বেসরকারি খাতের অতি-সম্পৃক্ততা, বিশেষ করে এলন মাস্কের মতো রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের ভূমিকা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্ন তোলে।

অতএব, যদিও ‘গোল্ডেন ডোম’ ভবিষ্যতের যুদ্ধ কৌশলের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে, তবে এর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে সতর্ক থাকাই শ্রেয়।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ