গাজা যুদ্ধ

গাজায় ইসরায়েলের নতুন হামলা বন্ধ না হলে নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২০ ১৮:১৫:৫৯
গাজায় ইসরায়েলের নতুন হামলা বন্ধ না হলে নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার

গাজায় মানবিক সংকট দিন দিন আরও চরম আকার ধারণ করছে এবং ইসরায়েলি সামরিক অভিযান নতুন করে জোরালোভাবে শুরু হওয়ায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগও বেড়ে চলেছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডা একযোগে হুঁশিয়ারি দিয়েছে—ইসরায়েল যদি অবিলম্বে হামলা বন্ধ না করে এবং মানবিক সহায়তার প্রবাহ নিশ্চিত না করে, তবে তারা নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ কঠোর কূটনৈতিক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।

একযোগে কড়া বার্তা পশ্চিমা দেশগুলোর

সোমবার (২০ মে) প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করে জানান, গাজায় চলমান সামরিক অভিযান এবং মানবিক সহায়তা অবরুদ্ধ রাখা চলতে থাকলে তারা ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ওপর টার্গেটেড স্যাংশন (লক্ষ্যভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা) আরোপ করবেন।

সিএনএন-এর বরাতে জানা গেছে, এই তিন দেশের নেতারা আরও বলেন—গাজায় নারী, শিশু এবং নিরীহ মানুষের ওপর চালানো অমানবিক হামলা এবং খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশে বাধা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, যা তারা আর মেনে নেবেন না।

ইসরায়েলের নতুন সামরিক অভিযান:Gideon’s Chariots

চলতি মে মাসের ৫ তারিখে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা অনুমোদন দেয়Gideon’s Chariots বা 'গিদিওনের রথ' নামক এক নতুন স্থল অভিযানের। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, এই অভিযানের উদ্দেশ্য হলো হামাসের সম্পূর্ণ পরাজয় এবং জিম্মিদের মুক্ত করা।

গত সপ্তাহান্ত থেকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজার উত্তর ও দক্ষিণে ব্যাপক বিমান হামলা এবং স্থল অভিযান শুরু করেছে। তাদের দাবি, তারা এক সপ্তাহে ৬৭০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে—যার মধ্যে অস্ত্রের গুদাম, হামাসের সুড়ঙ্গ এবং কৌশলগত ঘাঁটি রয়েছে।

তবে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে, যার মধ্যে বহু নারী ও শিশুও রয়েছে। খান ইউনুসের নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন Medical Aid for Palestinians (MAP)-এর ত্রাণ সরবরাহ ছিল।

সর্বশেষ মঙ্গলবার গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু এক রাতেই ৪৯ জন নিহত হয়েছে, আর সোমবার মারা গেছে ১৩৬ জন, যার অনেকেই শিশু ও নারী।

Gaza

মানবিক বিপর্যয়: খাদ্য ও চিকিৎসার চরম সংকট

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধের ফলে এখন পর্যন্ত ৫৩,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে হাজার হাজার। সাম্প্রতিক হামলায় শুধু গত এক সপ্তাহেই আহত হয়েছে ১,০০০ জনের বেশি এবং অন্তত ১৭ লক্ষাধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। গাজার প্রায় সব হাসপাতাল এখন অকার্যকর বা সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত।

অবশেষে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল সরকার ঘোষণা করে, “দুর্ভিক্ষ এড়াতে একটি মৌলিক মাত্রার খাদ্য সহায়তা” গাজায় প্রবেশ করতে দেবে। কিন্তু বাস্তবে শুধুমাত্র পাঁচটি ত্রাণবাহী ট্রাক কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে, যা জাতিসংঘের মতে “একটি মহাসমুদ্রের ফোঁটা” মাত্র।জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার বলেন, “এই পরিমাণ সহায়তা ২১ লক্ষ মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০টি ট্রাক প্রবেশ করতে না পারলে গাজায় দুর্ভিক্ষ অনিবার্য হয়ে উঠবে।”

Human

বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত চাপ

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও কানাডার পাশাপাশি আরও ২৩টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজায় অবাধ ত্রাণ প্রবেশের দাবি জানিয়েছেন। এই তালিকায় রয়েছে জার্মানি, ইতালি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাঁ-নোয়েল বারো বলেন, “ইসরায়েলের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো সম্পূর্ণ অপ্রতুল। অবিলম্বে ও ব্যাপকভাবে মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।”

নেতানিয়াহুর অবস্থান: আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা?

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পাল্টা বক্তব্য দিয়ে বলেন, “সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকদের তোষণ করা হচ্ছে, যা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে খর্ব করছে।” তিনি জানান, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটররাও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, “আপনাদের আমরা অস্ত্র ও কূটনৈতিক সহায়তা দিচ্ছি, কিন্তু অনাহারে কাতর শিশুদের ছবি দেখে আমরা আর চুপ থাকতে পারছি না।” তবে নেতানিয়াহু তার সরকারের কঠোর ডানপন্থী জোট অংশীদারদের চাপে বড় ধরনের মানবিক সহায়তা চালু করতে আপত্তি জানাচ্ছেন, কারণ তারা আশঙ্কা করেন—এসব সহায়তা হামাসের পক্ষে ব্যবহার হতে পারে।

‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ বিতর্ক

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নতুন সংস্থা Gaza Humanitarian Foundation (GHF) গাজায় ত্রাণ প্রবেশ তদারকি করবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই একে নিরপেক্ষ পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘ এর কড়া সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা UNICEF-এর মুখপাত্র জেমস এল্ডার বলেন, “এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা ‘সামরিকীকরণ’ করা হচ্ছে এবং এটি বাস্তবে গাজাবাসীদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে।” GHF-এর নির্বাহী পরিচালক জেক উড জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে গাজার দক্ষিণ ও কেন্দ্রভাগে সহায়তা কেন্দ্র খোলা হবে, পরে উত্তরে সম্প্রসারিত করা হবে।

জাতিসংঘের সতর্কবার্তা: ‘গণহত্যা প্রতিরোধ করুন’

জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার সরাসরি নিরাপত্তা পরিষদের সামনে বলেন, “এখনই পদক্ষেপ না নিলে একটি সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এটি একটি গণহত্যা প্রতিরোধের মুহূর্ত।” তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই না নতুন সংস্থা এসে বিদ্যমান সহায়তা কাঠামোকে ভেঙে দিক। বরং বিদ্যমান জাতিসংঘ কাঠামোকে পূর্ণ প্রবেশাধিকার দিন।”

শান্তি প্রক্রিয়া কোথায় দাঁড়িয়ে?

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে নতুন করে পরোক্ষ আলোচনা শুরু হয়েছে দোহা, কাতারে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গালান্ত দাবি করেছেন, নতুন অভিযান হামাসকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করছে।তবে বিশ্লেষকদের মতে, সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং কাতার ও সৌদি আরবের সঙ্গে গোপন কূটনৈতিক আলোচনা এই আলোচনার পেছনে মূল কারণ। ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেন, “গাজাকে একটি ‘ফ্রিডম জোন’ হিসেবে আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে আনার প্রস্তাব দিচ্ছি”—যা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। হামাসের পক্ষ থেকে কেউ কেউ ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও ৩০০ বন্দিমুক্তির প্রস্তাব দিলেও, সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা তা নাকচ করে বলেন, “সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ছাড়া কোনও আলোচনাই সম্ভব নয়।”

গাজা এখন এমন এক সংকটময় মুহূর্তে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতি মুহূর্তেই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, আর আন্তর্জাতিক সমাজের ধৈর্যের বাঁধও ভাঙছে। বিশ্বের নীতি নির্ধারকরা এবার সত্যিই কার্যকর পদক্ষেপ নেবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে একথা স্পষ্ট—গাজার মানুষের হাতে সময় খুবই কম।

সূত্রঃ সিএনএন।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত