আমদানি প্রায় ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার, রপ্তানি মাত্র ১৫৭ কোটি ডলার, নেপথ্যে কি? 

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৮ ১৯:৩২:১৭
আমদানি প্রায় ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার, রপ্তানি মাত্র ১৫৭ কোটি ডলার, নেপথ্যে কি? 

সত্য নিউজ: দুই প্রতিবেশী দেশ, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তবে এই সম্পর্ক কখনোই ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না। বরাবরই আমদানিতে ভারত এগিয়ে থাকলেও রপ্তানিতে বাংলাদেশ মার খেয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে প্রায় ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য, যেখানে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি সীমিত ছিল মাত্র ১৫৭ কোটি ডলারে।

অথচ ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে প্রায় সব পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছিল। প্রথমদিকে এর সুফল না পাওয়া গেলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এরপর রপ্তানির পরিমাণ ধীরে ধীরে বাড়লেও তা কখনো আমদানির কাছাকাছি পৌঁছায়নি। আর চলমান বছর শুরু হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত ধাক্কা দিয়ে ভারতের একতরফা নিষেধাজ্ঞা।

স্থলপথে পোশাক ও অন্যান্য পণ্যে নিষেধাজ্ঞা

২০২৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, এখন থেকে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক ভারতে রপ্তানি করা যাবে না স্থলবন্দর ব্যবহার করে। আমদানিকারকদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে নব সেবা বা কলকাতা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে হবে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামে ফলমূল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কোমল পানীয়, প্লাস্টিক পণ্য, সুতা, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত শুল্ক স্টেশন চ্যাংড়াবান্ধা ও ফুলবাড়ীতেও প্রযোজ্য।

মাঠপর্যায়ে তাৎক্ষণিক প্রভাব

প্রজ্ঞাপন জারির রাতেই ঢাকার মৌসুমী গার্মেন্টস ও স্কয়ার ফ্যাশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর পোশাকবাহী ট্রাক বেনাপোল বন্দরে আটকে যায়। রোববার সকাল পর্যন্ত ৩৬টি ট্রাক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব পণ্য আগে প্রতিদিনই বেনাপোল হয়ে কলকাতা পৌঁছাত মাত্র ৩ দিনে, খরচ হতো আনুমানিক ৬ লাখ টাকা। এখন যদি চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে হয়, খরচ দাঁড়াবে ১২ লাখ টাকা আর সময় লাগবে ২০-২৫ দিন। এতে বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক সংকটে পড়বেন বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতে ৫৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ছাড়া ১৫ কোটি ডলারের বেশি কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারের প্লাস্টিক পণ্য, ৩ কোটি ডলারের তুলার সুতার উপজাত এবং ৬৫ লাখ ডলারের আসবাবপত্র রপ্তানি হয়েছে-যেগুলোর অধিকাংশই গেছে স্থলবন্দর দিয়ে। এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলে এসব খাতেই সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে তারা সরকারিভাবে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে। তবে এর আগেও চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয় যার ফলে বাংলাদেশ ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য পাঠানোর সুবিধা হারায়। এটি কার্যকর হওয়ার আগেই মে মাসে স্থলপথে আমদানিতে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়, যা পরপর দুই ধাপে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

বিশ্লেষকদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ করণীয়

বাণিজ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পরিস্থিতি শুধু তাৎক্ষণিক ক্ষতির কারণ নয়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে ভারতনির্ভরতা হ্রাসের প্রয়োজনীয়তাও দেখিয়ে দিচ্ছে। বিকল্প বাজার খোঁজা, আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির পরিধি বাড়ানো এবং পণ্য বৈচিত্র্যকরণ এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে রপ্তানি বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে কাঠামোগত উদ্যোগ ও কূটনৈতিক সক্রিয়তা দরকার।

এছাড়া বাংলাদেশের পণ্যের মান, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং রপ্তানি উপযোগী অবকাঠামো উন্নয়নের দিকেও নজর দেওয়া জরুরি। ভারতীয় আমদানিকারকদের চাপ কিংবা অভ্যন্তরীণ নীতিমালার পরিবর্তন বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা থামিয়ে দিতে পারে যা এই সিদ্ধান্ত আবারও প্রমাণ করল।

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের বর্তমান কাঠামোতে অসমতা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ভারতের একতরফা নীতিগত পরিবর্তন এখন সেটিকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে কেবল প্রতিক্রিয়াশীল নয়, প্রো-অ্যাকটিভ বাণিজ্য কূটনীতির পথ বেছে নিতে হবে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত