টাইপ ৫ ডায়াবিটিস: অপুষ্টিজনিত এক নীরব মহামারি, লক্ষ শিশু ঝুঁকিতে! করণীয় কি?

জীবনযাপন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৭ ১১:৪১:৫২
টাইপ ৫ ডায়াবিটিস: অপুষ্টিজনিত এক নীরব মহামারি, লক্ষ শিশু ঝুঁকিতে! করণীয় কি?

ডায়াবেটিস এক সময় শুধু বয়সজনিত কিংবা জীবনযাপন সংক্রান্ত রোগ হিসেবে বিবেচিত হতো। টাইপ ১ ও টাইপ ২ নামেই রোগটি বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল, পরে এসেছে টাইপ ৩ ও ৪-এর ধারণা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে “টাইপ ৫ ডায়াবিটিস”-একটি ভিন্ন প্রকৃতির, উপেক্ষিত এবং বিপজ্জনক স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে বিশ্বের দরিদ্র শিশুদের ওপর।

রোগটির বৈশিষ্ট্য ও উৎপত্তি

আন্তর্জাতিক ডায়াবিটিস ফেডারেশন (IDF) জানিয়েছে, নতুন শনাক্ত হওয়া এই টাইপ ৫ ডায়াবিটিসে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বিশ্বব্যাপী ৩ কোটির বেশি। মূলত আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার নিম্নআয়ের দেশগুলোতে, বিশেষ করে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মধ্যেই এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। এই রোগটি দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টিজনিত কারণে হয় এবং একে “ম্যালনিউট্রিশন-রিলেটেড ডায়াবিটিস” হিসেবেও উল্লেখ করা হচ্ছে।

টাইপ ১ ডায়াবিটিস হয় যখন শরীরের অটোইমিউন সিস্টেম ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষকে ধ্বংস করে দেয়। টাইপ ২ হয় ওজন ও জীবনযাত্রাজনিত কারণে, যেখানে শরীর ইনসুলিন প্রতিক্রিয়ায় বাধা দেয়। টাইপ ৩ মস্তিষ্কের ক্ষয় ও অ্যালঝাইমার্সের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু টাইপ ৫ একেবারেই আলাদা। এতে অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে।

ইতিহাস ও অবহেলা

রোগটি প্রথম ধরা পড়ে ১৯৫৫ সালে জামাইকায়। তখন একে শুধুই অপুষ্টিজনিত রোগ হিসেবে দেখা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এটিকে বিরল রোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, কিন্তু পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যের অভাবে ১৯৯০ সালে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর এ রোগ নিয়ে দীর্ঘদিন কোনো আন্তর্জাতিক আলোচনাই হয়নি।

২০২২ সালে ভারতের ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ড. নিহাল টমাস তার গবেষণায় দেখান, অপুষ্টিজনিত কারণেই ডায়াবিটিস হতে পারে এবং এটি টাইপ ৫ ডায়াবিটিস হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। একই সঙ্গে নিউ ইয়র্কের অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের চিকিৎসক ড. মেরেডিথ হকিংস রোগটির উপর ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন।

উপসর্গ ও জটিলতা

টাইপ ৫ ডায়াবিটিসের উপসর্গ অনেকটা সাধারণ ডায়াবিটিসের মতোই। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত পিপাসা পাওয়া, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া, ওজন হ্রাস কিংবা হঠাৎ ওজন বৃদ্ধি, রক্তে শর্করার মাত্রার অনিয়মিত ওঠানামা, দৃষ্টিশক্তির অবনতি, স্নায়বিক সমস্যা এবং হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। তবে সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো, এটি দীর্ঘমেয়াদি এবং কখনো কখনো অচিহ্নিত থেকে যায় যা একসময় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

টাইপ ৫ ডায়াবিটিস ধীরে ধীরে শরীরকে ভেতর থেকে ক্ষয় করতে থাকে। সাধারণ ইনসুলিন থেরাপি বা টাইপ ১/২ ডায়াবিটিসের ওষুধে এটি সাড়া দেয় না। কারণ মূল সমস্যা হলো অগ্ন্যাশয় নিজেই প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি করতে অক্ষম হয়ে পড়ে অপুষ্টিজনিত কারণে।

চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

এই রোগের এখনো পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। দীর্ঘদিন অপুষ্টির কারণে যেসব শারীরিক ক্ষতি হয়ে যায়, তা অনেক সময় পূরণযোগ্য নয়। ফলে গবেষকরা মনে করছেন, প্রতিরোধই এই রোগ মোকাবেলার প্রধান উপায়। পুষ্টিকর খাদ্য, নিরাপদ পানীয় জল, এবং শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করার মাধ্যমে টাইপ ৫ ডায়াবিটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।

চিকিৎসকরা জোর দিচ্ছেন রোগটি যথাসময়ে সনাক্ত করার ওপর। সঠিকভাবে শনাক্ত না হলে রোগটি সাধারণ ডায়াবিটিস হিসেবে ভুল নির্ণয় হতে পারে, ফলে চিকিৎসায় ফল মিলবে না।

বৈশ্বিক উদ্বেগ ও করণীয়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আইডিএফ এখন নতুন করে টাইপ ৫ ডায়াবিটিসকে স্বাস্থ্যনীতির আলোচনায় আনার চেষ্টা করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে অপুষ্টি এবং দারিদ্র্য প্রকট, সেখানে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও শিশুপুষ্টি কর্মসূচির আওতায় এই রোগ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। এ রোগ শুধু একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, এটি সামাজিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবিও। বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি এবং শিক্ষার ঘাটতি থেকে জন্ম নিচ্ছে এই নীরব মহামারি।

টাইপ ৫ ডায়াবিটিস নতুন কোনো রোগ নয়, কিন্তু এটি আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে দশকের পর দশক। আজ যখন শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ সংখ্যায়, তখন এটি আর অবহেলার বিষয় নয়। এটি ভবিষ্যতের প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের ওপর এক ভয়াবহ ছায়া ফেলতে পারে।

সমাধান আছে, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন দ্রুত গবেষণা, সচেতনতা, এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ। এখনই সময় এই নীরব সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার কারণ এটাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত