"আর হস্তক্ষেপ নয়": ট্রাম্পের ঘোষণা আলোচনার কেন্দ্রে 

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১৭ ০৮:০৯:০১
"আর হস্তক্ষেপ নয়": ট্রাম্পের ঘোষণা আলোচনার কেন্দ্রে 

সৌদি আরবের এক বর্ণাঢ্য বলরুমে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক তাৎপর্যপূর্ণ ও কৌশলগতভাবে সাহসী ঘোষণা দেন: “যুক্তরাষ্ট্র আর কোনো দেশের রাষ্ট্রগঠনে হস্তক্ষেপ করবে না।” মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহুল আলোচিত এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটনের বহুবর্ষীয় নীতির মোড় ঘুরে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

রিয়াদে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প স্পষ্ট করে বলেন, “বিশ্বকে কীভাবে জীবনযাপন করতে হবে, তা শেখানো যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়।” মধ্যপ্রাচ্যের অভিজাত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে দেওয়া এ বার্তায় করতালিতে ফেটে পড়ে সৌদি বলরুম।

রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি ও আমেরিকান নৈতিকতা:

ট্রাম্পের এ বক্তব্য ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির এক দীর্ঘকালীন ও বিতর্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে অবস্থান। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া ও সিরিয়ার অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে দিয়েছে যে আদর্শিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত ‘রাষ্ট্রগঠন’ প্রক্রিয়া প্রায়শই বিপর্যয় ডেকে আনে।

ট্রাম্প বলেন, “যারা রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছেন, তারা অনেক ক্ষেত্রেই দেশ গড়ার চেয়ে বেশি দেশ ধ্বংস করেছেন। তারা এমন সমাজে হস্তক্ষেপ করেছেন, যেগুলো তারা বুঝতেই পারেননি।” এই বক্তব্য ছিল এক অর্থে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের ব্যর্থতার উপর প্রতিচিন্তন, যেখানে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে সামরিক হস্তক্ষেপ শেষপর্যন্ত সমাজকে করেছে আরো জর্জরিত।

প্রতিচ্ছবি ও প্রতিক্রিয়া: নতুন কূটনীতির সূচনা, না শুধুই শব্দের খেলা?

ট্রাম্পের এ বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে এমন এক আত্মজিজ্ঞাসামূলক স্বর, যা পশ্চিমা হস্তক্ষেপবাদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সৌদি শিক্ষাবিদ সুলতান আলআমের মন্তব্য করেন, “ট্রাম্পের বক্তব্য যেন ঔপনিবেশিক-বিরোধী দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর লেখার প্রতিধ্বনি।”

তিনি আরও বলেন, “নতুন জনতাবাদী রক্ষণশীল আন্দোলনগুলো এখন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চিন্তাকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক লিগ্যাসি গড়তে।”

বিনিয়োগ, ভূরাজনীতি ও কূটনৈতিক বার্তা: বহুমাত্রিক সফরের পাঠ

চার দিনের উপসাগরীয় সফরের সূচনায় দেওয়া এই বক্তব্য কেবল নীতিগত ঘোষণা ছিল না বরং এক বৃহৎ কূটনৈতিক দাবার চাল। ট্রাম্প সফরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন।

তবে বিনিয়োগের পাশাপাশি কূটনৈতিক বার্তাও ছিল অনেকটাই স্পষ্ট বিশেষ করে ইসরায়েল ও ইরান ইস্যুতে।

তিনি সৌদি আরবকে আহ্বান জানান, যেন তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু সৌদি কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ বিবেচনার বাইরে।

ট্রাম্প আরও বলেন, তিনি “চিরশত্রু” শব্দে বিশ্বাস করেন না এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে ইচ্ছুক।

আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য

ট্রাম্পের বক্তব্যে সবচেয়ে বেশি সাড়া আসে মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিক সমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহল থেকে। অনেকে এটিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস হিসেবে দেখলেও, অনেকেই সন্দেহ ও সমালোচনার তীর ছুড়েছেন।

ইয়েমেন:

সানার এক রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ট্রাম্পকে কটাক্ষ করে বলেন,“তিনি কাকে ক্ষমা করবেন বা কোন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবেন—এসব ঠিক করার তিনি কে?”এরপর যোগ করেন, “তবে দুনিয়াটা এমনই।”

সৌদি আরব:

সৌদি শিক্ষাবিদ সুলতান আলআমের মন্তব্য করেন, “ট্রাম্পের বক্তব্য যেন ঔপনিবেশিক-বিরোধী দার্শনিক ফ্রাঞ্জ ফাঁনোর ভাবনার প্রতিধ্বনি।” তিনি আরও বলেন, “রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলো এখন বামপন্থী আদর্শকে নিজের মতো ব্যবহার করছে।”

মানবাধিকারকর্মীদের প্রতিক্রিয়া:

সৌদি আরবে বন্দি এক আলেমের সন্তান আবদুল্লাহ আলাওধ বলেন, “যখন ট্রাম্প বলছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্য গড়েছে এখানকার মানুষ’, তখন তার চারপাশে ছিল বিদেশি ধনকুবের আর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন স্বৈরাচারী তাতে তার বক্তব্যকে নিছক বিদ্রুপ মনে হয়েছে।”

মিসরীয় মানবাধিকার আইনজীবী নেগাদ আল-বোরাই:

“ট্রাম্প যা বলেছেন, সেটি নতুন কিছু নয়। বরং, মার্কিন প্রশাসন বহুদিন ধরে যা করে আসছে, এবার কেবল তা সরাসরি ও খোলাখুলি ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে।”

প্রতিকূলতা ও প্যারাডক্স: বক্তৃতার সৌন্দর্য বনাম বাস্তবতা

যদিও ট্রাম্পের বক্তব্যকে কেউ কেউ আত্মসমালোচনার এক সাহসী প্রকাশ হিসেবে দেখেছেন, অনেকেই একে দ্বিমুখী নীতি বলে অভিহিত করেছেন।

সৌদি আরবে বন্দি এক আলেমের ছেলে আবদুল্লাহ আলাওধ বলেন,“যখন ট্রাম্প বলছিলেন ‘মধ্যপ্রাচ্য গড়েছে এখানকার মানুষ’, তখন তার চারপাশে ছিল বিদেশি ধনকুবের আর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক স্বৈরশাসক—তাতে তার বক্তব্যকে নিছক বিদ্রুপ মনে হয়েছে।”

মিসরীয় মানবাধিকার আইনজীবী নেগাদ আল-বোরাই মন্তব্য করেন,“এতে নতুন কিছু নেই। মার্কিন প্রশাসন যা বহুদিন ধরে করে আসছে, এবার শুধু তা একটু খোলাখুলি বলা হয়েছে।”

মার্কিন হস্তক্ষেপবাদের বিরোধিতায় স্পষ্ট অবস্থান

ট্রাম্প তার বক্তব্যে পরোক্ষভাবে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় মার্কিন সামরিক অভিযানের প্রতি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, “যারা অন্য দেশের রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে, তারা অনেক সময় দেশ গড়ার চেয়ে বেশি ধ্বংসই ডেকে এনেছে। তারা এমন সমাজে হস্তক্ষেপ করেছে, যা তারা বুঝতেই পারেনি।”

এই ঘোষণাকে অনেক বিশ্লেষক মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রনির্মাণমূলক সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ’-এর অবসানের বার্তা হিসেবে দেখছেন।

ট্রাম্প বনাম বাইডেন: নীতির রূপান্তর না মাত্র কৌশলগত ব্যতিক্রম?

ট্রাম্পের বক্তব্য অনেক দিক থেকে বর্তমান বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে তুলনামূলক প্রশ্ন তোলে।

  • বাইডেন মানবাধিকার ও গণতন্ত্রমুখী এক মন্থর কূটনীতিতে বিশ্বাসী,
  • ট্রাম্প কৌশলগত স্বার্থ, বিনিয়োগ ও শক্তি-ভিত্তিক বাস্তববাদের প্রবক্তা।

যেখানে বাইডেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে এড়িয়ে চলেছেন, সেখানে ট্রাম্প তাকে আখ্যা দিয়েছেন “অসাধারণ একজন মানুষ” হিসেবে।ট্রাম্পের রিয়াদ ভাষণ এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে—যুক্তরাষ্ট্র কি তার ভূরাজনৈতিক নীতিতে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আনছে, নাকি শুধুমাত্র তার কৌশলিক ভাষা পাল্টাচ্ছে?

এই ভাষণ মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকাকে কেন্দ্র করে আস্থা, বাস্তবতা ও আত্মপর্যালোচনার এক ত্রিমাত্রিক দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের ভাষায়, এই বক্তব্য হয়তো সাময়িক রাজনৈতিক বিজ্ঞপ্তি, তবে তা গভীর আন্তর্জাতিক প্রতিধ্বনি রেখে যাবে বহুদিন।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত