দুর্গের গল্পে ইতিহাসের ছায়া: ইউনেস্কো স্বীকৃত ৭ মহা-নিদর্শন

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১০ ১৮:০০:১৮
দুর্গের গল্পে ইতিহাসের ছায়া: ইউনেস্কো স্বীকৃত ৭ মহা-নিদর্শন

মানব সভ্যতার ইতিহাসে দুর্গ শুধু প্রতিরক্ষা বা রাজকীয় আবাসের জন্য নির্মিত স্থাপনা নয়, বরং এগুলো একেকটি যুগ, সংস্কৃতি, কল্পনা ও শৌর্যের সাক্ষ্য বহন করে। কখনো আক্রমণ প্রতিহত করতে, কখনো রাজ্যশাসনের প্রতীক হিসেবে, আবার কখনো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তির নিদর্শন হিসেবে এসব দুর্গের অস্তিত্ব স্থাপত্য ও ইতিহাসের যুগপৎ ক্যানভাস তৈরি করেছে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ায় এ দুর্গগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে, আর তা আজও বিশ্বের কোটি দর্শনার্থীকে মুগ্ধ করে চলেছে।

১. এডিনবরা ক্যাসেল, স্কটল্যান্ড: আগ্নেয়গিরির চূড়ায় ইতিহাসের প্রহরী

স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরার কেন্দ্রস্থলে একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরির ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এডিনবরা ক্যাসেল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি রাজকীয় বাসভবন, সামরিক ঘাঁটি, কারাগার ও কোষাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। এ দুর্গ থেকে গোটা শহরের দৃশ্য দেখা যায়, যা একদিকে যেমন কৌশলগত সুবিধা দিয়েছে, তেমনি পর্যটকদের জন্য অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন অভিজ্ঞতা এনে দেয়। ইউনেস্কো ১৯৯৫ সালে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।

২. হিমেজি ক্যাসেল, জাপান: শান্তি ও প্রতিরক্ষার চূড়ান্ত নান্দনিকতা

‘হোয়াইট হেরন’ নামে খ্যাত হিমেজি ক্যাসেল, জাপানের হিমেজি শহরে অবস্থিত এক অতুলনীয় স্থাপত্য। এর ঝকঝকে সাদা প্রাচীর ও সূক্ষ্ম কারুকার্য একে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দুর্গ হিসেবে পরিচিত করেছে। ১৪শ শতকে নির্মিত এই দুর্গটি বহু যুদ্ধ, ভূমিকম্প এবং এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোমাবর্ষণেও টিকে ছিল। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করে।

৩. শঁবোর্দ প্রাসাদ, ফ্রান্স: রেনেসাঁর সৃষ্টিশৈলীতে রাজকীয় অভিজ্ঞান

লয়ার ভ্যালির শঁবোর্দ প্রাসাদ রেনেসাঁ স্থাপত্যের এক বর্ণময় নিদর্শন। ফরাসি রাজা ফ্রঁসিস প্রথমের আদেশে নির্মিত এই প্রাসাদে রয়েছে দারুণ বৈচিত্র্যপূর্ণ স্থাপত্য, যার মধ্যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির প্রভাব লক্ষণীয়। এখানকার ‘ডাবল হেলিক্স’ সিঁড়ি, যা একে অপরকে না ছুঁয়ে উপরে উঠে, স্থাপত্যকলায় এক বিস্ময়। বিশাল বনভূমি, জটিল ছাদশৈলী ও অলঙ্করণে সমৃদ্ধ এই দুর্গ ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অন্যতম বাহক।

৪. প্রাগ ক্যাসেল, চেক প্রজাতন্ত্র: ইউরোপের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র

বিশ্বের বৃহত্তম দুর্গ হিসেবে গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে স্থান পাওয়া প্রাগ ক্যাসেল ৭০ হাজার বর্গমিটারের বেশি আয়তনজুড়ে বিস্তৃত। চেক প্রজাতন্ত্রের এই দুর্গে একত্রিত হয়েছে রোমানেস্ক, গথিক ও বারোক স্থাপত্যের অনন্য সমাহার। এখানে রয়েছে সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রাল, প্রাচীন রাজপ্রাসাদ ও বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। ১৯৯২ সালে ইউনেস্কো একে ‘প্রাগের ঐতিহাসিক কেন্দ্র’-এর অংশ হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।

৫. আলহামব্রা, স্পেন: আন্দালুসের সৌন্দর্য ও মুসলিম ঐতিহ্যের জ্বলন্ত স্মারক

স্পেনের গ্রানাডায় অবস্থিত আলহামব্রা দুর্গ মুসলিম স্থাপত্য ও সংস্কৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। নবম শতকে সাবিকা পাহাড়ে নির্মিত মূল কাঠামোর ওপর একাদশ শতকে নাসরিদ রাজবংশ এটি সম্প্রসারণ ও অলঙ্করণ করে। ইসলামী খোদাই, ফোয়ারাবহুল প্রাঙ্গণ ও আরবি শিলালিপি সমৃদ্ধ এ দুর্গ এখনো ইসলামী সোনালি যুগের সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৮৪ সালে ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে।

৬. মঁ স্যাঁ মিশেল, ফ্রান্স: দ্বীপ-দুর্গে ধর্ম, নান্দনিকতা ও ইতিহাসের ছোঁয়া

ফ্রান্সের উত্তর উপকূলে অবস্থিত এই পাথুরে দ্বীপ-দুর্গটি কেবল একটি সামরিক স্থাপনা নয়, এটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাত। জোয়ার-ভাটার খেলায় দ্বীপটি কখনো সমুদ্রের মাঝে, আবার কখনো স্থলভাগের অংশ হয়ে ওঠে। অষ্টম শতক থেকে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এ স্থাপনাটি ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করে এবং প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ পর্যটক এখানকার অলৌকিক সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করতে আসে।

৭. পেনা প্রাসাদ, পর্তুগাল: রোমান্টিসিজমের গিরিশিরায়

পর্তুগালের সিন্ট্রা শহরের পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত পেনা প্রাসাদ একাধারে রোমান্টিসিজম, নব্যগথিক ও ইসলামি স্থাপত্যের মিশ্রণে গঠিত এক বিস্ময়কর সৌধ। এটি প্রায় পুরোটা পাথরের ওপর নির্মিত এবং দূর থেকেও তা রঙিন দৃশ্যপট তৈরি করে। এটি ১৯ শতকের রাজনৈতিক রোমান্টিসিজম ও শিল্পশৈলীর দৃষ্টান্ত হিসেবে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়।

ইতিহাসের প্রহরী, ভবিষ্যতের ঐতিহ্য

এই দুর্গগুলো শুধু পাথর, ইট বা প্রাচীন স্থাপত্যের সংগ্রহ নয় প্রতিটি দুর্গই অতীতের এক জীবন্ত দলিল। এগুলো যুদ্ধ, শিল্প, ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক জটিলতার এক অনন্য সংমিশ্রণ। ইউনেস্কো স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে শুধু ঐতিহাসিক গুরুত্বই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটন, গবেষণা এবং বিশ্ব ঐতিহ্য সংরক্ষণের দিক থেকেও এসব দুর্গ আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে এই দুর্গগুলো সময়ের সীমা ছাড়িয়ে ইতিহাসের গভীর থেকে আমাদের ডেকে বলে "আমরা শুধু অতীত নই, আমরা চিরন্তন।"

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ