ইরান- ইসরায়েল সংঘাত

হাসপাতাল দুইটি, কভারেজ একপাক্ষিক- মিডিয়া কি পক্ষপাতদুষ্ট?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২০ ১১:৪৭:২৭
হাসপাতাল দুইটি, কভারেজ একপাক্ষিক- মিডিয়া কি পক্ষপাতদুষ্ট?

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দুটি মর্মান্তিক হাসপাতাল হামলা বৈশ্বিক মিডিয়া কাভারেজে এক গভীর বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছে, যা বিশেষ করে ইরানি জনগণকে বেদনাহত ও ক্ষুব্ধ করেছে। একদিকে, ইসরায়েলের বিরশেবা শহরের একটি হাসপাতালে বোমা হামলার খবর মুহূর্তেই আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়ে উঠে; অন্যদিকে, এর মাত্র তিন দিন আগে ইরানের কেরমানশাহ শহরের একটি হাসপাতালে চালানো একই ধরনের হামলা ছিল গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিসীমার একেবারেই বাইরে।

এই পার্থক্যের পেছনে রয়েছে মূলত প্রবেশাধিকার, স্বচ্ছতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অনুপস্থিতি। ইসরায়েল যেখানে দ্রুত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে ঘটনাস্থলে প্রবেশের অনুমতি দেয়, নিয়মিত ব্রিফিং এবং ভিডিও ফুটেজ সরবরাহ করে সেখানে ইরান উল্টো পথ বেছে নেয়। দেশটির সরকার সাংবাদিকদের ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করে এবং ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত করে ফেলে।

ফলে কেরমানশাহর মতো মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা শুধু নির্ভর করে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের তোলা অস্পষ্ট ভিডিও কিংবা বিক্ষিপ্ত মন্তব্যের ওপর। এইভাবে যে ন্যারেটিভ তৈরি হয়, তা কখনোই তথ্যনির্ভর বা বস্তুনিষ্ঠ নয় এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় সেইসব শোকাহত পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের, যাদের কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে যায় বিশ্বমঞ্চে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধ কিংবা সংঘাতকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সহমর্মিতার অনেকটাই নির্ভর করে মিডিয়া কাভারেজ এবং জনগণের আবেগময় সংবেদনশীলতার উপর। ইসরায়েলের হাসপাতাল আক্রান্ত হওয়ার পরপরই বিশ্বজুড়ে সরকার, মানবাধিকার সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অথচ কেরমানশাহর ঘটনায় ইরান সরকার দুদিন পর একটি মোট পরিসংখ্যান দিলেও—২২৪ জন নিহতের সেই সংখ্যার পেছনের মানুষদের গল্প, হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপে হারিয়ে যাওয়া জীবন, চিকিৎসক ও রোগীদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কোনও বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়নি।

এই বৈষম্য কেবল মিডিয়ার অপারগতাকেই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও বৈশ্বিক নজরদারির দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। যেখানে কিছু দেশ স্বচ্ছতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা অর্জন করতে পারে, সেখানে অন্য দেশের জনগণ নিজেদের ব্যথা চাপা দিতে বাধ্য হয় কারণ রাষ্ট্রই তাদের কণ্ঠস্বর আটকে রাখে।

শোকাহত পরিবারগুলো যদিও নিজেদের গল্প সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তবে তা মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সংগঠিত কাভারেজের বিকল্প হতে পারে না। সংবাদপত্রে উঠে আসা একটি ছবিই অনেক সময় বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেয়, কিন্তু যখন সেই ছবি তোলারই সুযোগ দেওয়া হয় না, তখন তা হয়ে পড়ে এক নীরব গণবিস্মরণ।

কেরমানশাহর ঘটনাটি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয়, তথ্য নিয়ন্ত্রণ কেবল রাজনৈতিক অস্ত্র নয়, বরং মানবিক সহানুভূতির প্রতিবন্ধকও হতে পারে। যুদ্ধের বিভীষিকার মাঝে সত্য উচ্চারণের স্বাধীনতা না থাকলে, বিশ্বের সামনে কেবল একপাক্ষিক চিত্রই উপস্থাপিত হয় যা কোনোভাবেই ন্যায়বিচারের ভিত্তি হতে পারে না।

এমন বাস্তবতায় কেবল সংবাদপত্র বা সাংবাদিক নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন এবং সচেতন বিশ্ববাসীরই দায়িত্ব এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সব কণ্ঠ, সব কান্না, সব ক্ষয়ক্ষতিকে সমান গুরুত্বে দেখা। কারণ যুদ্ধের আঘাত জাতি দেখে না, কিন্তু ইতিহাস বিচার করে কে কথা বলতে দিয়েছিল, আর কে কণ্ঠরোধ করেছিল।

সূত্র- বিবিসি বাংলা

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত