আইসিসি-কে বাঁচাতে মাঠে যুক্তরাজ্য

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৭ ০০:০৫:২৭
আইসিসি-কে বাঁচাতে মাঠে যুক্তরাজ্য

ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে, আইসিসি’র কার্যক্রম ব্যাহত হওয়া ঠেকাতে মার্কিন প্রশাসনের কাছে সক্রিয়ভাবে লবিং করছে যুক্তরাজ্য। মিডল ইস্ট আই (MEE) নিশ্চিত করেছে, এর আগে যুক্তরাজ্য ট্রাম্প প্রশাসনকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যেন ব্রিটিশ নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা না দেওয়া হয়, যারা আইসিসি’র গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পেছনে ইসরায়েল ইস্যু

আইসিসির ব্রিটিশ প্রধান কৌঁসুলি কারিম খান এবং আদালতের চারজন বিচারপতির ওপর আর্থিক ও ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এদের মধ্যে রয়েছেন বেনিন, পেরু, স্লোভেনিয়া এবং উগান্ডা থেকে আসা বিচারকরা। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ—এরা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অবৈধ পদক্ষেপে’ যুক্ত।

আইসিসি যে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে তার পেছনে রয়েছেন খ্যাতিমান ব্রিটিশ মানবাধিকার আইনজীবী আমাল ক্লুনি, সাবেক আইসিসি বিচারক লর্ড জাস্টিস অ্যাড্রিয়ান ফুলফোর্ড এবং ব্যারোনেস হেলেনা কেনেডি। তারা সবাই ২০২৩ সালে আইসিসি কৌঁসুলির আহ্বানে গঠিত একটি স্বাধীন আইনি উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য ছিলেন। তারা ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াওভ গ্যালান্ট সহ সিনিয়র ইসরায়েলি ও হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন।

লেবার সরকারের নীতিগত পালাবদল

এমন সময় যুক্তরাজ্য লবিং করছে যখন ক্ষমতায় এসেছে কেয়ার স্টারমার নেতৃত্বাধীন লেবার সরকার। এর আগে ২০২৪ সালের এপ্রিলে কনজারভেটিভ সরকারে থাকা অবস্থায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ফোনে আইসিসি কৌঁসুলি কারিম খানকে সরাসরি হুমকি দিয়েছিলেন—যদি ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়, তাহলে যুক্তরাজ্য আইসিসি থেকে নিজেদের অর্থায়ন প্রত্যাহার করবে এবং সদস্যপদও বাতিল করতে পারে।

২০২৪ সালের ১০ জুন ব্রিটিশ সরকার আইসিসিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আপত্তি জানায়, যুক্তি ছিল—ইসরায়েলি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আদালতের বিচারিক ক্ষমতা নেই। তবে মাসখানেক পর নতুন লেবার সরকার ক্ষমতায় এসে সেই আপত্তি প্রত্যাহার করে নেয়। প্রধানমন্ত্রীর একজন মুখপাত্র সে সময় বলেন, “আইনের শাসন এবং আদালতের স্বাধীনতা—দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে—আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখি।”

যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত এবং আইসিসি’র অস্তিত্বের সংকট

যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি তার মিত্রদের জানিয়েছে, যদি আইসিসি তার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সব মামলা স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে, এমন প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, আইসিসি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেবে না, যদি না তারা আদালতের বিচারাধীনতা স্বীকার করে।

এই শর্তগুলোর ফলে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তি মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল রোম সংবিধির স্বাক্ষরকারী নয়, তবে আফগানিস্তান সই করেছে—যার ফলে আইসিসি সেখানে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে।

আইসিসিকে যদি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়, তবে আদালতের ব্যাংকিং, সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি পরিষেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে—যা সরাসরি এর কার্যক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেবে।

কৌঁসুলির ব্যক্তিগত পরিণতি

ইতোমধ্যেই কারিম খানের মার্কিন ভিসা বাতিল হয়েছে, তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি ছুটিতে রয়েছেন, কারণ তার বিরুদ্ধে একজন সহকর্মীর প্রতি যৌন অসদাচরণের অভিযোগে জাতিসংঘ তদন্ত চালাচ্ছে—যা তিনি অস্বীকার করেছেন এবং এখন পর্যন্ত ডাচ পুলিশের কাছে এই অভিযোগ হস্তান্তর করা হয়নি।

এই অবস্থায় ইসরায়েল ইস্যুতে আইসিসির পরবর্তী পদক্ষেপের দায়িত্ব এখন দুইজন উপ-কৌঁসুলির হাতে।

আইসিসির প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ

আইসিসি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কারিম খান এবং সংশ্লিষ্ট বিচারকদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তীব্র নিন্দা জানায়। আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়:

“এই ধরনের পদক্ষেপ একটি আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা এবং বৈধতা ক্ষুণ্ণ করার স্পষ্ট চেষ্টা, যে প্রতিষ্ঠান ১২৫টি রাষ্ট্রপক্ষের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করছে।”

এছাড়া, আদালত আরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, প্যালেস্টাইন তদন্ত সংক্রান্ত ভবিষ্যতের কোনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।

যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আইসিসি ইস্যুতে কূটনৈতিক টানাপড়েন এখন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই বিরোধ শুধু আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, বরং বিশ্বব্যাপী যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিশ্চিতে আইসিসির ভবিষ্যৎ সক্ষমতাকেও অনিশ্চিত করে তুলছে।

বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই প্রক্রিয়ায় আইসিসির ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক আইনের শাসন ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত