ইসলাম ও জীবন

ইসলামে বিবাহ: একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের পথে নৈতিক ও আত্মিক নির্দেশনা

ধর্ম ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৩ ২০:৫৯:২০
ইসলামে বিবাহ: একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের পথে নৈতিক ও আত্মিক নির্দেশনা

ইসলাম ধর্মে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা কেবল মানবজীবনের একটি সামাজিক চুক্তি নয়, বরং এটি একটি ধর্মীয় দায়িত্ব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ এবং আত্মিক প্রশান্তি ও চারিত্রিক পবিত্রতার উৎস। কুরআন ও সহিহ হাদিসে বিবাহের গুরুত্ব বারবার উচ্চারিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তাঁর নিদর্শনসমূহের একটি এই যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জীবনসঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করো এবং তোমাদের মধ্যে প্রেম ও দয়া স্থাপন করেছেন।” (সূরা রূম, আয়াত ২১)। এই আয়াতই বিবাহের মৌলিক হিকমত বা উদ্দেশ্যকে তুলে ধরে—মানুষের মানসিক, জৈবিক ও আত্মিক চাহিদার পরিপূর্ণতা।

রাসুল (সা.) যুবসমাজকে বিবাহে উৎসাহিত করেছেন এই বলে, “হে যুব সম্প্রদায়! যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিবাহ করে। কেননা, তা দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গকে হেফাজত করে। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সাওম পালন করে; তা যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণের উত্তম পন্থা।” (সহিহ বুখারি)। এটি প্রমাণ করে যে, বিবাহ কেবল সম্পর্কের বিষয় নয়, বরং তা মানবিক এবং চারিত্রিক সুরক্ষার অন্যতম প্রাচীর। বিবাহের মাধ্যমে মানুষ হারাম পথ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং নিজের জন্য একটি নিরাপদ, সম্মানজনক এবং প্রশান্তিময় জীবন গড়ে তুলতে পারে।

ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহের শাব্দিক অর্থ ‘নিকাহ’—যার মানে হলো মিলন বা চুক্তি। শরীয়তের পরিভাষায় এটি এমন একটি বৈধ চুক্তি, যার মাধ্যমে নারী-পুরুষ একে অপরের জীবনসঙ্গী হয়ে বৈধভাবে একত্রিত হন। ইসলাম বিবাহকে একটি সম্মানজনক বন্ধনে রূপান্তর করেছে যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা না ছড়ায়, অবৈধ সম্পর্ক প্রতিরোধ হয় এবং পরিবার ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা সুসংগঠিত থাকে।

বিবাহ সংঘটিত হওয়ার জন্য ইসলামে নির্ধারিত কিছু মৌলিক শর্ত ও রুকন রয়েছে। প্রথমত, ইজাব বা প্রস্তাব—যা সাধারণত কনের অভিভাবকের পক্ষ থেকে বরকে দেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, কবুল বা সম্মতি—যা বর বা তার প্রতিনিধির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। এই ইজাব ও কবুল স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করতে হয়, এবং দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক, ন্যায়পরায়ণ পুরুষ সাক্ষীর উপস্থিতিতে তা সম্পন্ন করতে হয়। এছাড়া বর ও কনে উভয়কে অবশ্যই একে অপরের প্রতি সম্মত হতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, “কোনো অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোনো নারীর বিবাহ নেই; অভিভাবক ও সাক্ষী ছাড়া কোনো বিবাহ নেই।” (তিরমিজি, সহিহ জামে)।

ইসলামে বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য আরও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন, বর-কনে উভয়কে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ও চুক্তির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে; কারো উপর জোর করে বিবাহ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না; কনের অভিভাবক মুসলিম, ন্যায়পরায়ণ ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে; সাক্ষীগণও বিশ্বস্ত ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হতে হবে। ইসলামী ফিকাহ অনুসারে, কাছের আত্মীয় অভিভাবকের অধিকার সর্বাগ্রে। যেমন—বাবা, দাদা, ভাই ইত্যাদি। যদি কাছের কেউ না থাকে, তবে অন্য আত্মীয় বা সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

বিবাহের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি পারিবারিক বন্ধনকে মজবুত করে এবং প্রজন্ম রক্ষা করে। হালাল উপায়ে সন্তান জন্ম দেওয়া, বংশ রক্ষা, পিতা-মাতার দায়িত্ব গ্রহণ এবং সমাজে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা—সবই বিবাহের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়। এর পাশাপাশি বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসা, করুণা ও সহনশীলতার বন্ধন গড়ে তোলে। এটি কেবল দৈহিক সম্পর্কের সীমায় আবদ্ধ নয়; বরং আত্মিক বন্ধনের এমন এক কাঠামো যা মানুষকে পূর্ণতা দেয়।

ইসলামে বিবাহের ক্ষেত্রে কিছু সুন্নাত রয়েছে যেগুলো পালন করা উত্তম। যেমন—বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার আগে কনের সৌন্দর্য, চরিত্র, ধর্মীয়তা ইত্যাদি দেখা; বিয়ের খুতবা পাঠ করা; মসজিদে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা; জুমার দিনে (বিশেষ করে আসরের পর) বিয়ের আকদ পড়ানো। বর-কনে যেন পরস্পরকে দেখে ও জানে, এজন্য দেখা বৈধ করা হয়েছে; তবে নির্জনে সাক্ষাৎ অনুমোদিত নয়।

অন্যদিকে, কিছু নিষিদ্ধ কাজ রয়েছে যেগুলো বিবাহের ক্ষেত্রে পরিহার করতে বলা হয়েছে। যেমন—ইদ্দতকালীন নারীর প্রতি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া (বিশেষত ‘রাজ‘ঈ’ তালাকের পর), অন্যের প্রস্তাবে হস্তক্ষেপ করা বা মেয়ের সম্মতি ছাড়া জোর করে বিয়ে দেওয়া। ইসলাম এসব অনৈতিক কাজকে নিষিদ্ধ করে একটি স্বচ্ছ ও সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় বিবাহ সম্পন্ন করার নির্দেশনা দিয়েছে।

সবশেষে, ইসলাম বিবাহকে শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এটি মানুষের আত্মিক পরিতৃপ্তি, চারিত্রিক উৎকর্ষ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। আজকের যুগে যেখানে চারিত্রিক অবক্ষয়, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও পারিবারিক ভাঙনের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে, সেখানে ইসলাম প্রদত্ত বিবাহব্যবস্থা হতে পারে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সুতরাং বিবাহকে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি ও শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী গুরুত্ব সহকারে পালন করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।

সূত্র: কুরআন, সহিহ বুখারি, তিরমিজি, ইসলামী ফিকাহ গ্রন্থ, সহিহ জামে

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত