ভাষান্তর
শতাব্দীর প্রভাবশালী দলিল ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র—দ্বিতীয় পর্বের প্রথমাংশ

রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য দলিল হলো কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। জার্মান ভাষায় এর মূল নাম “Manifesto der Kommunistischen Partei”, অর্থাৎ কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। বিখ্যাত দার্শনিক কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস ১৮৪৮ সালে এই এটি লিখেন, যা প্রথম প্রকাশিত হয় লন্ডনে। ১৮৪৮ সালে যখন এটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়, তখনকার বিপ্লবাত্মক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল এক যুগান্তকারী লেখা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-কে আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলিলগুলোর অন্যতম বলে বিবেচনা করা হয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটির চারটি অধ্যায় রয়েছে। ধারাবাহিক ভাবে আমরা এর ভাবানুনাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। আজ আমরা করছি দ্বিতীয় পর্বের প্রথমাংশ। আশাকরি পাঠকরা সহজভাবে এর মূল ভাবনা ও তাৎপর্য বুঝতে পারবেন।
দ্বিতীয় পর্ব: প্রোলেতারিয়ানস এবং কমিউনিস্টরা
কমিউনিস্টদের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে প্রোলেতারিয়ানসদের/সর্বহারাদের সম্পর্ক কী?
কমিউনিস্টরা কোনো স্বতন্ত্র বা প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক দল নয়। তারা নিজেদের কোনো বিশেষ দলীয় মতবাদ বা সংকীর্ণ স্বার্থ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না। বরং তারা প্রোলেতারিয়ানস/সর্বহারা শ্রেণির সার্বিক স্বার্থের প্রকাশ ও বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কমিউনিস্টদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো—তারা জাতীয় সংগ্রামের মধ্যেও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রোলেতারিয়ানসদের অভিন্ন স্বার্থকে সামনে নিয়ে আসে এবং শ্রমিকশ্রেণি ও পুঁজিপতিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রতিটি পর্যায়ে আন্দোলনের সামগ্রিক ও ঐতিহাসিক গতিপথকে তুলে ধরে। এ কারণেই, একদিকে তারা শ্রমিকশ্রেণির সবচেয়ে অগ্রণী ও দৃঢ় অংশ, অপরদিকে, তারা তাত্ত্বিকভাবে পরিষ্কারভাবে বোঝে এই আন্দোলনের গতিপথ, শর্ত এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য কী হওয়া উচিত।
কমিউনিস্টদের তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লক্ষ্য অন্যান্য প্রোলেতারিয়ানস/সর্বহারা পার্টিগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ: শ্রমিকদের একটি শ্রেণি হিসেবে সংগঠিত করা, বুর্জোয়া শ্রেণির কর্তৃত্বের অবসান ঘটানো, এবং প্রোলেতারিয়ানসদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। তবে, তাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি কোনো কল্পনাপ্রসূত বা আদর্শবাদী ধারণার ওপর নয়—বরং সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিসংঘাত ও বাস্তব সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা।
কমিউনিজমের লক্ষ্য সাধারণ অর্থে সমস্ত সম্পত্তির বিলুপ্তি নয়, বরং বুর্জোয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যুগে যুগে সম্পত্তির ধরন পরিবর্তিত হয়েছে—যেমন ফরাসি বিপ্লব সামন্তবাদী সম্পত্তিকে বিলুপ্ত করে পুঁজিবাদী সম্পত্তির জন্ম দেয়। আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তি হলো এমন এক উৎপাদন ও মালিকানা ব্যবস্থা, যার ভিত্তি গুটিকয়েকের হাতে পুঁজি কেন্দ্রীভূত করা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শ্রমকে শোষণ করার ক্ষমতা। এই প্রেক্ষিতে, কমিউনিস্ট তত্ত্বকে এক লাইনে বলা যায়: "ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলুপ্তি।"
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, তারা মানুষের নিজস্ব শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিতে চায়—যা ব্যক্তিস্বাধীনতা, কর্মকুশলতা ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হলো—আপনারা কোন ধরনের সম্পত্তির কথা বলছেন? যদি বোঝান সেই ক্ষুদ্র কারিগর বা কৃষকের সম্পত্তি, তাহলে স্পষ্ট করে বলা যায়, শিল্পোন্নয়ন ও পুঁজিবাদ ইতোমধ্যেই তা ধ্বংস করে দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে। আর যদি বোঝান আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তি, তাহলে প্রশ্ন জাগে—মজুরি-ভিত্তিক শ্রম কি শ্রমিকের জন্য কোনো সম্পত্তি সৃষ্টি করে? মোটেও না। বরং এটি পুঁজির জন্ম দেয়—এক ধরনের সম্পত্তি যা মজুরি-শ্রমকে শোষণ করে এবং যার বিস্তার নির্ভর করে নতুন শ্রমিকদের শোষণের ওপর।
বর্তমান সমাজে সম্পত্তির ভিত্তি হলো পুঁজি ও মজুরি-শ্রমের দ্বন্দ্ব। একজন পুঁজিপতি কেবল ব্যক্তি নন—তিনি একটি সামাজিক শক্তির অধিকারী। কারণ পুঁজি হলো সম্মিলিত শ্রমের ফল; এটি ব্যক্তির সম্পদ নয়, সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। অতএব, যখন এই পুঁজিকে সমাজের অভিন্ন সম্পত্তিতে রূপান্তর করা হয়, তখন তা ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে সামাজিক সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয় না বরং তার শ্রেণিচরিত্র বিলুপ্ত হয়। সম্পত্তি তখন আর শোষণের উপকরণ নয়, বরং সমান অংশগ্রহণের ভিত্তি হয়ে ওঠে।
মজুরি-শ্রমিক যা উপার্জন করে তা কেবল তার নগ্ন জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট। আমরা এই শ্রমফলের ব্যক্তিগত অধিগ্রহণের বিরোধিতা করি না, যতক্ষণ না তা অন্যের শ্রম শোষণের উপায়ে পরিণত হয়। বরং আমরা প্রতিরোধ করি সেই ব্যবস্থাকে, যেখানে শ্রমিক কেবল পুঁজির সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য বেঁচে থাকে, এবং যতক্ষণ না শাসক শ্রেণির প্রয়োজন মেটে, ততক্ষণই তাকে বাঁচতে দেওয়া হয়।
কমিউনিস্ট সমাজে এই বাস্তবতা পাল্টে যাবে। সেখানে অতীতের সঞ্চিত শ্রম হবে জীবন্ত শ্রমিকের বিকাশ ও কল্যাণের উপায়। সেখানে অতীত নয়, বর্তমান নিয়ন্ত্রণ করবে সমাজকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজি স্বাধীন, মানুষ পরাধীন। এই শোষণাত্মক স্বাধীনতার অবসানই কমিউনিজমের লক্ষ্য। বুর্জোয়ারা এই প্রক্রিয়াকে "স্বাধীনতার বিলুপ্তি" বললেও, বাস্তবে এটি বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অবসান।
তাদের কথিত "বাজারের স্বাধীনতা" বা "বেচাকেনার মুক্তি" আসলে সেই ব্যবস্থাকে রক্ষা করে, যেখানে শ্রমিক নিজেই হয়ে ওঠে একটি পণ্য। এই তথাকথিত মুক্ত বাণিজ্যের যুক্তি তখনই অর্থবহ যখন তা মধ্যযুগীয় সীমাবদ্ধ বাণিজ্যের বিপরীতে দাঁড়ায়। কিন্তু যখন কমিউনিজম এই বেচাকেনার প্রক্রিয়া, উৎপাদনের ভিত্তি এবং পুরো বুর্জোয়া শ্রেণিকেই বিলুপ্ত করতে চায়, তখন সেই মুক্ত বাণিজ্য আর কোনো অর্থ বহন করে না।
আপনারা আতঙ্কিত হন কারণ আমরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিলুপ্ত করতে চাই। অথচ বাস্তবে এই সমাজেই নয়-দশমাংশ মানুষের জন্য এই সম্পত্তি নেই বললেই চলে। কেবল কিছু সংখ্যক মানুষের হাতে এর অস্তিত্ব বজায় আছে—বাকি সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্পত্তিহীনতার খেসারত দিয়েই। অতএব, আমাদের অভিযুক্ত করা হয় যে আমরা আপনাদের সেই সম্পত্তি বিলুপ্ত করতে চাই, যার অস্তিত্ব নির্ভর করে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠকে সম্পত্তিবঞ্চিত করার ওপর। সঠিকই বলেছেন—এটাই আমাদের উদ্দেশ্য।
যেদিন শ্রম আর পুঁজি, মুনাফা বা ভাড়া হিসেবে রূপান্তরিত হবে না—অর্থাৎ যেদিন ব্যক্তি শ্রম আর বুর্জোয়া সম্পত্তিতে রূপান্তরযোগ্য থাকবে না, সেদিন থেকেই, আপনারা বলবেন, ব্যক্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা বলব—ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদা ও মানবিক স্বাধীনতার প্রকৃত সূচনা তখনই ঘটবে।
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- শেয়ারবাজারে এল বড় সুখবর!
- কবে থামবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভেদের রাজনীতি?
- স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ
- ২০২৬ সালের এপ্রিলেই জাতীয় নির্বাচন: জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা
- নির্বাচনের ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া: বিএনপি অসন্তুষ্ট, জামায়াত সন্তুষ্ট, এনসিপি শর্তসাপেক্ষে সমর্থন
- রিজার্ভের দাপট: বিদ্যুৎ খাতের ১৪ কোম্পানি বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা
- রোজা, পরীক্ষা ও বাজেটের মাঝে নির্বাচন অযৌক্তিক: বিএনপি
- নারায়ণগঞ্জে বিএনপি নেতার বাড়িতে সেনা অভিযান:উদ্ধার ইয়াবা ও ধারালো অস্ত্র!
- দ্বিতীয় দিনেও চলছে কোরবানি, কসাই না পাওয়ায় আজ জবাই অনেকের
- তিন মাসেই যে ১০ বেসরকারি ব্যাংকে ৩২ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি!
- তারেক-ইউনূস বৈঠক: উত্তপ্ত রাজনীতিতে সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট?
- তারেক রহমানের দেশেফেরার সম্ভাব্য সময় জানালেনমির্জা ফখরুল
- উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?
- সাক্ষাৎ চাইলেন শেখ হাসিনার ভাগ্নি, মুখ ফিরিয়ে নিলেন ড. ইউনূস
- ডিএসইতে সাধারণ বীমা খাতের প্রান্তিক বিশ্লেষণ:মুনাফা বৃদ্ধির শীর্ষে কারা?