গ্রেটা থুনবার্গের ফ্লোটিলা আটক, গাজা অবরোধ প্রশ্নে উত্তাল ইউরোপ

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ০৯ ২২:৫৩:২২
গ্রেটা থুনবার্গের ফ্লোটিলা আটক, গাজা অবরোধ প্রশ্নে উত্তাল ইউরোপ

সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক জলসীমায় গাজামুখী মানবিক সহায়তা নৌকা ‘ম্যাডলিন’-এ ইসরায়েলি নৌবাহিনীর অভিযান এবং এর ফলে গ্রেফতার হন সুইডিশ জলবায়ু অধিকারকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, ফরাসি ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান সহ আরও ১২ জন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী। গাজার কঠোর অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং চরম মানবিক সংকটে থাকা এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে খাদ্য ও ওষুধ পাঠানোর লক্ষ্যে ফ্লোটিলা যাত্রাটি সংগঠিত করেছিল Freedom Flotilla Coalition। অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়ার মাধ্যমে গাজার সঙ্কট আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।

সংগঠনের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় বেআইনিভাবে নৌকাটি আটক করে, সক্রিয় অস্ত্রহীন কর্মীদের অপহরণ করে এবং তাদের বহনকৃত ত্রাণ সামগ্রী—including শিশু খাদ্য, ঔষধ ও শুকনো খাবার—জব্দ করে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, “এই অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল একটি মানবিক মিশনের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করেছে, যা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।”

অন্যদিকে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অভিযানকে ‘জনসংযোগের ছলচাতুরি’ হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টে লেখে—“সেলিব্রিটিদের ‘সেলফি ইয়ট’ নিরাপদে ইসরায়েলের উপকূলের দিকে এগোচ্ছে।” তারা জানায়, আটক কর্মীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে এবং জব্দকৃত ত্রাণ সামগ্রী গাজার অনুমোদিত চ্যানেলের মাধ্যমে পৌঁছানো হবে।

তবে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এর প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্পেন, যার নাগরিক সের্হিও তোরিবিও ছিলেন এই মিশনে, ইসরায়েলের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রী ইওলান্দা দিয়াস একে আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন বলে আখ্যা দেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ইসরায়েলের সঙ্গে থাকা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি পর্যালোচনার আহ্বান জানান।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ-নোয়েল বারো আটক ফরাসি নাগরিকদের জন্য অবিলম্বে কনস্যুলার সহায়তা এবং দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। একইসঙ্গে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বামপন্থী জোট এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের এই কর্মকাণ্ডকে "ইচ্ছাকৃতভাবে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখার কৌশল" বলে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, "এই অভিযান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী এবং এর বিরুদ্ধে ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে।" ইতোমধ্যে বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, পর্তুগাল ও নেদারল্যান্ডস ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য ও সহযোগিতা চুক্তি পর্যালোচনার প্রস্তাব তুলেছে।

‘ম্যাডলিন’ গত সপ্তাহে ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে এটি লিবিয়ার জলসীমার কাছাকাছি চারজন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করে, যারা লিবীয় কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়ার ভয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। মিশনের মানবিক প্রকৃতি ছিল সুস্পষ্ট। গ্রেটা থুনবার্গ এক প্রাক-রেকর্ডকৃত বার্তায় বলেন, “আমরা অস্ত্র নয়, খাদ্য নিয়ে এসেছি। আমাদের লক্ষ্য গাজার শিশুদের জন্য দুধ ও ওষুধ পৌঁছে দেওয়া।” তিনি তার মুক্তির জন্য সুইডিশ সরকারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

এই অভিযানে আটক আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন ফ্রান্সের ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য রিমা হাসান, যিনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত এবং ইসরায়েলের ফিলিস্তিনবিরোধী নীতির কঠোর সমালোচক। তিনি বলেন, “এই মানবিক মিশনকে সামরিকভাবে থামিয়ে ইসরায়েল দেখিয়ে দিল যে তারা আন্তর্জাতিক সহানুভূতির প্রতিও শত্রুতা পোষণ করে।”

ইসরায়েলি পক্ষের যুক্তি, গাজার উপর তাদের নৌ-অবরোধ হামাসের কাছে অস্ত্র প্রবাহ রোধের জন্য জরুরি। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এটি মূলত গাজার সাধারণ জনগণের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করার হাতিয়ার। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছে যে, অবরোধের কারণে গাজার প্রায় ২৩ লাখ মানুষ দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেস্কা আলবানিজে বলেন, “যদি সরকারগুলো এই অবরোধ তুলে না নেয়, তবে নাগরিক সমাজের উচিত সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে নামা।” একইসঙ্গে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, অক্সফ্যাম, এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অভিযানের নিন্দা জানিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানায়।

বর্তমানে ‘ম্যাডলিন’ ইসরায়েলি নৌবাহিনীর নজরদারিতে আশদোদ বন্দরের দিকে এগোচ্ছে। আটককৃতদের আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে ইসরায়েলি সূত্র জানিয়েছে। তবে ইউরোপীয় কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে এবং এই আটক-পর্ব wider কূটনৈতিক উত্তেজনার দিকে গড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে—গাজায় সহায়তা পাঠানো কি অপরাধ, নাকি মানবিক কর্তব্য? এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি এবার নিন্দার গণ্ডি পেরিয়ে কার্যকর পদক্ষেপে যাবে? সময়ই বলবে, তবে এ ঘটনা নিশ্চিতভাবেই গাজার সংকটকে আরেক ধাপ আন্তর্জাতিকীকরণ করলো—এবার বিশ্বনন্দিত গ্রেটা থুনবার্গ ও ইউরোপীয় রাজনীতিকদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত