বিশেষ প্রতিবেদন
উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষোভ কি ভারতের কেন্দ্রীয় কূটনীতি পাল্টাবে?

আল রাফি
স্বাধীন সাংবাদিক

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এখন শুধু দুই দেশের ভৌগোলিক বিভাজন নয়—এটি হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি, রাজনীতি, কূটনীতি এবং জাতিগত সম্পর্কের জটিল এক সন্ধিক্ষণ। মোদি সরকারের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ নীতির প্রেক্ষাপটে এই সীমান্তে জন্ম নিয়েছে অনির্বচনীয় ক্ষোভ, বিভ্রান্তি, এবং বিদ্রোহের আগুন।
আসামের করিমগঞ্জ শহরের ট্রাক চালক সলিমউদ্দিনের আত্মহত্যা শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়—এটি ভারতের ভেতরেই চেপে রাখা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। টানা ২১ দিন সীমান্তে আটকে থাকা, পচে যাওয়া সবজি, অনাহারী পরিবার—এই বাস্তবতা কেবল ত্রাণ নয়, রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধেই এক মৌন প্রতিবাদ।
এই প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনপদগুলোতে আজ ছড়িয়ে পড়ছে এক নতুন রাজনৈতিক চেতনা: “বাংলাদেশ আমাদের শত্রু নয়, শত্রু সেই নীতি যা আমাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে।”
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ১৩টি স্থলবন্দর ও ৪টি জলপথ দিয়ে বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য আদান-প্রদান হয়, যার সিংহভাগ প্রবাহিত হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর মাধ্যমে। এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকেই তাদের "লাইফলাইন" হিসেবে বিবেচনা করেন।
কিন্তু ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে মোদি প্রশাসন পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশমুখী পণ্য পরিবহন আটকে দেওয়ার, চিকিৎসা ভিসা স্থগিত করার এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে এক ধরনের “আর্ম টুইস্টিং” কৌশল চালু করে। উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপে রাখা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক রূপান্তরের পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু এতে লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে ইকোনমিক করিডর, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিকল্প বাণিজ্যিক জোট, এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে। ভারতকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঢাকার নতুন সংযোগ গড়ে উঠছে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরকে কেন্দ্র করে।
দিল্লি ধরে নিয়েছে যে, অর্থনৈতিক নির্ভরতার ভিত্তিতে বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এমন নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির ধারায় থাকা মধ্যম আয়ের দেশ, যার হাতে রয়েছে বিকল্প বাজার, বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আত্মবিশ্বাসী নেতৃত্ব।
এককেন্দ্রিক চাপ প্রয়োগের কৌশল বরং ভারতের নিজেদের রাজ্যগুলোতেই ক্ষোভ জন্ম দিচ্ছে। আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়ের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো মুখ খুলছে, “আমরা দিল্লির রাজনীতি বুঝি না, আমরা শুধু জানি সীমান্ত বন্ধ মানে আমাদের খাবার বন্ধ।” এমন বাস্তবতায় স্থানীয় পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ‘বাংলাদেশ নীতি’। এক প্রার্থী সরাসরি প্রচারণায় বলেছেন—“বাংলাদেশ বন্ধ থাকলে আমরাও বন্ধ থাকি।”
দিল্লির রাজনৈতিক সংকীর্ণতা যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান দুর্বল করছে, ঠিক সেভাবেই চীন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের করিডর বিস্তৃত করছে। চীন-বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডর (CBEC) বর্তমানে শুধু পণ্য পরিবহন নয়, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও কৌশলগত প্রভাব বিস্তারেরও হাতিয়ার। ভারত যেখানে বন্ধ করছে, চীন সেখানে খুলছে। যেখানে দিল্লি সন্দেহ দেখায়, বেইজিং সেখানে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা প্রদর্শন করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু বাণিজ্যের প্রশ্ন নয়, এটা দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্বের প্রশ্ন।
টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, ডেকান ক্রনিকলের মতো শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো একযোগে বলছে,মোদি সরকারের বাংলাদেশ নীতি আত্মঘাতী। কারণ এতে কূটনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক সম্পর্ক সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি করিমগঞ্জ, শিলচর, আগরতলার মতো শহরে আজ ছাত্র, ব্যবসায়ী, শ্রমিক সকলেই বলছে, “আমরা ঢাকার দিকে তাকাই, দিল্লি তো আমাদের দেখেই না।” সীমান্তের হকার, চালক, দোকানদার সবার মুখে এখন একটাই বাক্য: “বাংলাদেশ শত্রু নয়, আমাদের সরকার ভুল করছে।”
নয়া দিল্লির সামনে এখন একটি মৌলিক প্রশ্ন-বাংলাদেশকে শত্রু ভাববো না বন্ধু হিসেবে দেখবো? চাপ সৃষ্টি করবো না পাশে দাঁড়াবো? রাজনৈতিক দম্ভ নয়, সমঝোতার ভাষা কি শিখবে ভারত? ক্রাইস্ট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. শিয়া উপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, “দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বাংলাদেশকে সম্মান দেখাতে হবে-শত্রু নয়, পার্টনার হিসেবে দেখতে হবে।”
করিমগঞ্জে সলিমউদ্দিনের আত্মহননের মধ্য দিয়ে যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়েছে, তা শুধু একজন চালকের নয়,এটি ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগণের চাপা প্রতিক্রিয়া। এই সংকট কেবল রাজনৈতিক বিরোধ নয়, এটি একটি আর্থসামাজিক ও কৌশলগত বিভাজন। একদিকে দিল্লির আত্মতুষ্ট নীতি, অন্যদিকে মানুষের বাস্তবতা ও চাহিদা। এই লড়াই এখন নির্বাচনের নয়, এটি হয়ে উঠছে প্রতিটি রাস্তায়, ট্রাকে, সীমান্তে প্রতিধ্বনিত ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন একটাই—এই দ্বন্দ্বে জিতবে কে? দিল্লি? না করিমগঞ্জ?
পাঠকের মতামত:
আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ
- সঠিক প্রশ্ন করা জরুরি: আমাদের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি প্রসঙ্গে
- আবু সাইদ: এক জনতার মহানায়ক
- ব্রেক্সিট, ফেসবুক ও গণতন্ত্রের ছায়াযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা
- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: আত্মপরিচয়ের নবতর ব্যাখ্যা ও আগামী রাষ্ট্র নির্মাণের ভিত্তি
- ফ্যাসিবাদ, শিক্ষকতা ও প্রতিরোধের সমাজতত্ত্ব
- “সুশীল” শব্দটি কেন আজও গালি?
- ঢাকার ২০টি আসনে বিএনপির নির্বাচনী কৌশল: কারা পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন?
- যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: “লাথি মারি এই শোকে”—উমামা ফাতেমার বিস্ফোরণ
- মাইলস্টোন ট্রাজেডি: আমরা কি মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছি?
- অবশেষে শেখ হাসিনার পরিবারের একজন গ্রেপ্তার
- ঘুষের হারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি, কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই- মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ
- তারেক রহমান এখন উপযুক্ত নেতা: কাদের সিদ্দিকী
- প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিমানবাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
- বাস্তবায়নের পথে তিস্তা প্রকল্প: উত্তরাঞ্চলের প্রাণ ফিরে পাওয়ার শেষ আশা
- যমুনার বৈঠকে বড় বার্তা দিল জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন
- সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে যা বললেন জামায়াত আমির!
- বাড়ি কিনলেই নাগরিকত্ব! ক্যারিবীয় দ্বীপে ভিড় বাড়াচ্ছেন ধনীরা
- অবশেষে দশম গ্রেড পাচ্ছেন প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকরা, কিন্তু আছে কিছু শর্ত!
- চাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে বিশাল গ্রহাণু, হতে পারে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ!
- পিআর পদ্ধতির পক্ষে ঐক্য ডাক চরমোনাই পীরের
- শহীদদের রক্তের সঙ্গে ওয়াকআউট করা যায় না: নাসির পাটোয়ারী"
- নেত্রকোনায় কিশোরী ধর্ষণ ও আত্মহত্যা মামলার রায়: তিন যুবকের মৃত্যুদণ্ড
- স্ত্রী ছেড়ে যাওয়ার পর এক মাস শুধু বিয়ার, শেষে যা ঘটল থাইল্যান্ডের যুবকের সঙ্গে!
- জুলাই সনদ নিয়ে সব দলের কাছে চিঠি—৩০ জুলাইয়ের মধ্যে মতামত চাইল কমিশন
- কুমিল্লার মেয়র কন্যাসহ বাহার পরিবারে সিআইডির নজর, বিপুল অর্থ জব্দ
- সারা বছর ইলিশের স্বাদ পেতে জানুন সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি
- চট্টগ্রামে শুরু বৃক্ষমেলা, ২০৬৫ প্রজাতির চারা প্রদর্শনী
- প্রথম মিনিটেই বাজিমাত! চাকরির ইন্টারভিউয়ে নিজেকে যেভাবে পরিচয় করাবেন
- ভারতীয় বাহিনীর দাবি:পেহেলগাম হামলার মূল পরিকল্পনাকারী শেষ
- জানুন মানসিক সুস্থতায় বিজ্ঞানসম্মত ছয়টি পরামর্শ
- জাতীয় পার্টির নামে ফেরার পথ খুঁজছে আওয়ামী লীগ: রাশেদ খান
- শহীদ মিনার নিয়ে ছাত্রদল-এনসিপি মুখোমুখি
- ‘নির্বাচনের আগে সংস্কার না হলে আন্দোলন চলবে’—সাবধান করলেন নাহিদ ইসলাম
- ওজন কমানোর সবচেয়ে সহজ ও টেস্টি উপায়!
- সহকারী ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ নিয়ে বিক্ষোভে উত্তাল রাজশাহীর রুয়েট শিক্ষার্থীরা
- লালমনিরহাটে ভয়াবহ ট্রেন সংঘর্ষ লাইনচ্যুত দুটি বগি!
- দেশের তিন বিভাগে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস, চট্টগ্রামে ভূমিধসের শঙ্কা
- চাঁদাবাজ যত বড়ই হোক, ছাড় নেই: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- আইপিএল-এর আদলে বিপিএল পরিচালনার নতুন পথচলা
- এনসিপি ত্যাগ নীলা ইস্রাফিলের: বললেন, ‘এটা আর রাজনৈতিক দল নয়, দুর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল’
- সঠিক প্রশ্ন করা জরুরি: আমাদের শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি প্রসঙ্গে
- আবু সাইদ: এক জনতার মহানায়ক
- ব্রেক্সিট, ফেসবুক ও গণতন্ত্রের ছায়াযুদ্ধ: বাংলাদেশের জন্য সতর্কবার্তা
- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: আত্মপরিচয়ের নবতর ব্যাখ্যা ও আগামী রাষ্ট্র নির্মাণের ভিত্তি
- ফ্যাসিবাদ, শিক্ষকতা ও প্রতিরোধের সমাজতত্ত্ব
- “সুশীল” শব্দটি কেন আজও গালি?
- ঢাকার ২০টি আসনে বিএনপির নির্বাচনী কৌশল: কারা পাচ্ছেন দলীয় মনোনয়ন?
- যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: “লাথি মারি এই শোকে”—উমামা ফাতেমার বিস্ফোরণ
- মাইলস্টোন ট্রাজেডি: আমরা কি মানবিকতা হারিয়ে ফেলেছি?
- অবশেষে শেখ হাসিনার পরিবারের একজন গ্রেপ্তার
- ঘুষের হারে পাঁচগুণ বৃদ্ধি, কোথাও কোনো সুশাসন নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই- মির্জা ফখরুলের উদ্বেগ
- তারেক রহমান এখন উপযুক্ত নেতা: কাদের সিদ্দিকী
- প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিমানবাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
- বাস্তবায়নের পথে তিস্তা প্রকল্প: উত্তরাঞ্চলের প্রাণ ফিরে পাওয়ার শেষ আশা
- যমুনার বৈঠকে বড় বার্তা দিল জামায়াত-ইসলামী আন্দোলন