জ্বালানি তেল: সাগর থেকে সড়ক, পথে পথে চুরি

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ২২ ১৭:২৭:২৫
জ্বালানি তেল: সাগর থেকে সড়ক, পথে পথে চুরি

সত্য নিউজ: বাংলাদেশে আমদানি করা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল বঙ্গোপসাগরের মাদার ভেসেল থেকে শুরু করে গ্রাহকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সংঘবদ্ধভাবে চুরি হচ্ছে—এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে একটি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, তেল পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাবিক, ডিপো কর্মকর্তাসহ একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কোস্টগার্ডকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছে এবং তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগও নিয়েছে।

চোরাই প্রক্রিয়া: মাদার ভেসেল থেকে শুরু করে পাম্প পর্যন্ত

প্রতিবেদন অনুসারে, চট্টগ্রাম বন্দরের মাদার ভেসেল থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে তেল ডিপোতে নেওয়ার সময়ই চুরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। তেলের মাপ নির্ধারণে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা লেনদেন করে পরিমাণ কম বা বেশি দেখিয়ে চুরি করে থাকেন। লাইটার জাহাজের গোপন চেম্বারে অতিরিক্ত ৮০০ থেকে ১,০০০ লিটার পর্যন্ত তেল লুকিয়ে রাখা হয়। এসব তেল পরে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয়।

অপরদিকে, রেল ও সড়কপথে পরিবহনেও দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। একটি ট্যাংকলরিতে সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ লিটার পর্যন্ত অতিরিক্ত তেল ভরা হয়, যা ভাউচারে উল্লেখ থাকে না। একইভাবে ড্রামেও ১৫ থেকে ২০ লিটার পর্যন্ত অতিরিক্ত তেল ভরার চিত্র উঠে এসেছে।

কর্ণফুলী নদী ও বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলো থেকেও তেল চুরি হয় বলে জানা গেছে। রাতের অন্ধকারে জাহাজ থেকে ড্রামে ভরে তেল নামিয়ে নদীপথে নৌকায় করে সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছে পৌঁছানো হয়, যা পরে বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে বা ইঞ্জিনচালিত নৌযানে।

প্রযুক্তিহীনতা ও জবাবদিহিহীনতা: চুরির প্রধান কারণ

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে প্রায় ৬৭ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি সরবরাহ করা হয়, যার মধ্যে ৬৭ শতাংশই পরিবহন করা হয় নৌপথে। কিন্তু অধিকাংশ ডিপো, পরিবহন মাধ্যম ও সরবরাহ চেইনে এখনো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত, ফলে কার্যকর নজরদারির অভাবে চুরির ঘটনাগুলো ব্যাপক হারে ঘটছে।

বিশ্লেষকদের মতে, ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় তেল পরিমাপ ও রেকর্ড সংরক্ষণের ফলে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তেল তাপমাত্রার তারতম্যে পরিমাপে অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হলেও সেটি স্বচ্ছভাবে ব্যবস্থাপনায় আসে না।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সুপারিশ

জ্বালানি চুরি রোধে পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা অয়েল কোম্পানিগুলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে তেল সরবরাহ, মজুত ও বিতরণ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

তেল পরিবহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ট্যাংকলরিতে ট্র্যাকিং সিস্টেম এবং ডিজিটাল লক সংযোজনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে করে পথে চুরির সুযোগ কমে আসবে এবং যেকোনো অনিয়ম সহজে শনাক্ত করা যাবে।

তেল চোরাচালান রোধে স্থানীয় প্রশাসন ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এতে করে নৌপথ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

জ্বালানি তেল লোড-আনলোডের প্রতিটি পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের নির্দেশনা এসেছে। এ ব্যবস্থায় চুরির ঘটনাগুলো রেকর্ড হবে এবং দায়ীদের শনাক্ত করা সহজ হবে।

তেল পরিমাপ ও সরবরাহ কার্যক্রমে নিয়োজিত সার্ভেয়ার কোম্পানির প্রতিনিধি, জাহাজ মাস্টার, নাবিকসহ সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি একটি স্বতন্ত্র ইন্সপেকশন কমিটি গঠন করে তেল পরিমাপ ও সরবরাহ পদ্ধতি নিয়মিতভাবে তদারকি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন ডিপোতে কাগুজে রেকর্ড অনুযায়ী প্রকৃত মজুত তেলের পরিমাণ যাচাইয়ের ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ রয়েছে। এ উদ্দেশ্যে একটি অভ্যন্তরীণ মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা তেলের প্রকৃত মজুত পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে মূল্যায়ন করবে।

বিপিসির উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন্স ও পরিকল্পনা) ড. এ কে এম আজাদুর রহমান জানান, চুরির তথ্য উদঘাটনের পর কোস্টগার্ডকে নিয়মিত অভিযান চালাতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।

তিনি আরও জানান, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)-এ ‘কাস্টডি ফ্লো মিটার’ প্রযুক্তির মাধ্যমে অটোমেশন চালুর প্রস্তুতি চলছে, যা পুরো সরবরাহ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করে তুলবে। একইভাবে, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং ও পাইপলাইন প্রকল্প চালু হলে বিভিন্ন ধাপে সিস্টেম লস কমবে।

বিপিসির অধীন পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েল কোম্পানিগুলোর সব ডিপো অটোমেশনের আওতায় আনার লক্ষ্যে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি চলমান রয়েছে। তবে জনবল সংকট এবং কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা বাস্তবায়নকে কিছুটা বিলম্বিত করছে।

রাষ্ট্রীয় জ্বালানি তেল চুরি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্যও হুমকিস্বরূপ। প্রয়োজন দ্রুত অটোমেশন, কঠোর নজরদারি এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা। তা না হলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরির এই চক্র অচিরেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে এ হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল।

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ: বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা

বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে, এবং এই পরিবর্তনটির মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ।... বিস্তারিত