শেখ হাসিনার ট্রায়াল

গণআন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস উঠে আসছে ট্রাইব্যুনালে

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৩ ১২:০১:২১
গণআন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাস উঠে আসছে ট্রাইব্যুনালে

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থান চলাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ থেকে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর অনুমোদনে এই বিচার রোববার সকাল সাড়ে ১১টা থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়, যা বাংলাদেশে একটি ঐতিহাসিক নজির সৃষ্টি করেছে। বিচারিক কার্যক্রমের সূচনা বক্তব্যে রাষ্ট্রপক্ষ বিস্তারিতভাবে অভিযোগপত্র উপস্থাপন করে, যা ট্রাইব্যুনাল কক্ষে উপস্থিত জনগণ এবং টেলিভিশন দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়।

Link:https://www.facebook.com/share/v/16dq8bCvPh/

এই মামলায় প্রধান আসামি শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অভিযুক্ত। মামুন ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে নিজের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হয়েছেন। এই স্বীকারোক্তি মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মামলার আলামত হিসেবে তাঁর সাক্ষ্য এবং অন্যান্য প্রমাণ ভবিষ্যতের বিচারকে আরও গতিশীল ও সুপ্রমাণিত করতে সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত পাঁচটি গুরুতর অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে আখ্যায়িত করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এই বক্তব্যের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা সংগঠিতভাবে নিরীহ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালায়, যেখানে দেড় হাজার মানুষ নিহত ও প্রায় ২৫ হাজার আহত হন। দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনা ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন, যার ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি এই আদেশ বাহিনীর মধ্যে প্রেরণ করেন এবং এর ফলে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ ও অনুমোদনের দায়ও এই তিনজনের ওপর বর্তায়। একইভাবে চতুর্থ অভিযোগে রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত ছয়জন নিরস্ত্র যুবককে গুলি করে হত্যার এবং পঞ্চম অভিযোগে আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও মামুন অভিযুক্ত হয়েছেন।

এটি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একমাত্র মামলা নয়। এর আগে ২ জুলাই আদালত অবমাননার একটি মামলায় তাঁকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর প্রথম আনুষ্ঠানিক দণ্ড। এছাড়া শেখ হাসিনা ও আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে গুম-নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় তদন্ত চলছে, যার প্রতিবেদন ২৪ আগস্ট দাখিল করার নির্ধারিত তারিখ রয়েছে। একইসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা এবং হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আরেকটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন ১২ আগস্ট জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা এই বিচারকে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যা নতুন বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষ এবং যুবসমাজ যে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা নিয়ে রাজপথে নেমেছিল, সেই দাবির প্রতিফলন হতে পারে এই বিচার প্রক্রিয়া। এ বিচারিক ব্যবস্থা শুধু একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয় নয়, বরং এটি একটি শাসনব্যবস্থা, একনায়কতন্ত্র এবং নিষ্ঠুর দমননীতির দায়ের মুখোমুখি করার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।

এই বিচার থেকে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের পথে অগ্রসর হতে পারে কি না, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক মানে স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং প্রমাণভিত্তিক বিচার নিশ্চিত করা গেলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন যাত্রা শুরু করার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ