যেভাবে আইজিপির স্বীকারোক্তি মামলার গতিপথ বদলে দেবে

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুলাই ১১ ১০:২৪:২১
যেভাবে আইজিপির স্বীকারোক্তি মামলার গতিপথ বদলে দেবে

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ গণ-অভ্যুত্থান এবং তৎপরবর্তী দমন-পীড়নের ঘটনা অবশেষে আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন হলো। বৃহস্পতিবার (১০ জুলাই) ট্রাইব্যুনাল-১ এর তিন সদস্যবিশিষ্ট বিচারিক বেঞ্চ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং গ্রেপ্তারকৃত তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন।

বিচার প্রক্রিয়ায় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে যখন একমাত্র গ্রেফতারকৃত আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন করেন। ইংরেজিতে তিনি বলেন, "আই ফিল গিলটি, আই হুইল ডিসক্লোজ।" তিনি আরও বলেন, “আমি এই অপরাধে দোষী এবং আদালতকে সত্য উদ্ঘাটনে সাহায্য করতে প্রস্তুত।” আদালত তার এই আবেদন গ্রহণ করে তাকে ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। মামুনের এই ভূমিকা মামলার গতিপথকে নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করতে পারে বলে মত দিয়েছেন প্রসিকিউটররা।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, মামুনের স্বীকারোক্তিমূলক সাক্ষ্য এবং প্রত্যক্ষ জ্ঞান শেখ হাসিনাকে ‘অপারেশনাল মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে। তাজুল ইসলাম আরও বলেন, মামুন একাধিক গোপন নথিপত্র ও আদেশের বিষয়ে অবগত ছিলেন, যা আদালতে উপস্থাপন করা হলে সত্য উদ্ঘাটনের পথ সুগম হবে। আদালতের বেঞ্চে ছিলেন প্রধান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার, বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

আদালত ৩ আগস্ট প্রসিকিউশনের প্রাথমিক বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উপস্থাপনের তারিখ নির্ধারণ করেন এবং ৪ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে বলে আদেশ দেন। এই বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে নজিরবিহীন, যেখানে একটি সরকার কর্তৃক সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হলো।

মামলার তদন্ত সংস্থা ১২ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে পাঁচটি স্পষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, নির্যাতন, নিখোঁজ এবং দমন চালান। তদন্ত প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’র আওতায় অভিযুক্ত করা হয়।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনকারীদের রাজাকার ও তাদের উত্তরসূরি আখ্যা দিয়ে নির্মূলের ঘোষণা দেন। এই উসকানির পর সারা দেশে একযোগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে প্রায় দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করে, আহত করে প্রায় ২৫ হাজারকে। এই গণহত্যার জন্য অভিযুক্তদের সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, শেখ হাসিনা একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও আত্মীয়দের সঙ্গে কথোপকথনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং মারাত্মক মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই আদেশের ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরাসরি প্রাণঘাতী অভিযান পরিচালনা করে।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়, ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ নামের এক নিরীহ ছাত্রকে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহতের মৃত্যুর কারণ গোপন করতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চারবার পরিবর্তন করা হয়। হত্যার এই ঘটনা শেখ হাসিনার প্রকাশ্য উসকানির ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়।

চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়, ৫ আগস্ট সকালে ঢাকার চানখারপুল এলাকায় ছয়জন ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশনা উচ্চ পর্যায় থেকে আসে এবং অভিযুক্তদের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত হয়।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে আন্দোলনরত ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পরে লাশগুলো একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। একজন আহত হলেও জীবিত ছিলেন, তাকেও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এটি ছিল অপরাধকে ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যপ্রসূত এক নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড।

চিফ প্রসিকিউটর আরও জানান, মামুনের সাক্ষ্যে জানা যাবে কিভাবে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, কাদের নির্দেশে এবং কোন বাহিনী কীভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। তার এই ভূমিকাকে কেন্দ্র করে আদালতের রায় মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ী ব্যক্তিদের চূড়ান্তভাবে চিহ্নিত করার পথ সুগম করবে।

এই মামলা 'চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা গং' নামে রুজু হয়েছে এবং এই বিচার প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মোড় সৃষ্টি করতে চলেছে, যেখানে সাবেক শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিচার হচ্ছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এই বিচারিক কার্যক্রম একটি নতুন ইতিহাস রচনা করতে পারে।

-ইসরাত, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ