স্বাস্থ্য কথন

দুশ্চিন্তা যেভাবে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে

স্বাস্থ্য ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ২৮ ২২:০৬:৪৭
দুশ্চিন্তা যেভাবে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে

দুশ্চিন্তা—শব্দটি শুনলেই মনে আসে এক ধরনের মানসিক অস্থিরতা। কিন্তু আপনি কি জানেন, এই মানসিক চাপ আপনার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গেও ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে? আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, দীর্ঘমেয়াদি দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয় এবং একাধিক জটিল শারীরিক রোগের জন্ম দেয়। Healthline ও Mayo Clinic-এর মতো বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা সাইটের তথ্যে এই বাস্তবতা বারবার উঠে এসেছে। নিচে আমরা তুলে ধরেছি দুশ্চিন্তার শারীরিক প্রভাব, কারণ ও প্রমাণ নিয়ে এক গভীর ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।

দুশ্চিন্তার শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া

দুশ্চিন্তার সময় মস্তিষ্ক “ফাইট-অর-ফ্লাইট” সিস্টেম সক্রিয় করে, যেখানে হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল (HPA) অক্ষ এবং সিম্প্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র জেগে ওঠে। ফলস্বরূপ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে অ্যাড্রেনালিন ও কর্টিসল নিঃসৃত হয়। অ্যাড্রেনালিন তাৎক্ষণিক শক্তি ও রক্তচাপ বাড়িয়ে তোলে, আর কর্টিসল শরীরে গ্লুকোজ সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রতিক্রিয়া উপকারী, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এই হরমোনগুলোর অতিরিক্ত ক্ষরণ শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিপাক কার্যক্রম ও ঘুমসহ নানা প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে।

হৃদ্‌যন্ত্র ও রক্তচাপের উপর প্রভাব

উদ্বেগে হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, বুক ধড়ফড় করে, এমনকি ব্যথাও অনুভূত হতে পারে। ক্রমাগত দুশ্চিন্তা উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও করোনারি ধমনী রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যাঁরা পূর্ব থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত, তাঁদের জন্য উদ্বেগ একটি বড় ট্রিগার হিসেবে কাজ করে।

পরিপাকতন্ত্রের ক্ষয়ক্ষতি

দুশ্চিন্তার কারণে হজম ধীর হয়ে যায়। এর ফলে পেটব্যথা, গ্যাস, বমিভাব, এমনকি ডায়রিয়া হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ ক্ষুধা কমায় এবং ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) বা পেপটিক আলসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁদের উদ্বেগের মাত্রা বেশি, তাঁদের পেটে ঘা হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি।

ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া

স্বল্পমেয়াদী দুশ্চিন্তা প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা বিপরীত প্রভাব ফেলে। কর্টিসল হরমোন ইমিউন কোষগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, ফলে ঠান্ডা-কাশি, সংক্রমণ ও ফ্লু-এর মত রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। এমনকি টিকার কার্যকারিতাও কমে যেতে পারে।

শ্বাসপ্রশ্বাস ও পেশী-স্নায়ুর জটিলতা

উদ্বেগের সময় শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়, অনেক সময় হাইপারভেন্টিলেশন হয়, যা মাথা ঘোরা ও ঝিমঝিম ভাব তৈরি করে। হাঁপানি ও COPD রোগীদের ক্ষেত্রে এই অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। পেশীগুলো ক্রমাগত সঙ্কুচিত থাকায় ঘাড়, কাঁধ ও পিঠে ব্যথা দেখা দেয়, এবং তা থেকে মাথাব্যথা বা মাইগ্রেনও হতে পারে।

ঘুম ও ক্লান্তিভাব

দুশ্চিন্তা ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করে। ফলে ঘুম না আসা, দুঃস্বপ্ন, কিংবা বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সমস্যা দেখা দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় ক্লান্তিভাব, শক্তিহীনতা এবং আরও উদ্বেগ তৈরি হয়—একটি দুষ্টচক্রের মতো।

দীর্ঘমেয়াদী উদ্বেগ: ক্রনিক রোগের ঝুঁকি

দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে শরীরে “নীরব বিষ” হিসেবে কাজ করে। এতে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হজমজনিত সমস্যা, সংক্রমণ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে। মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, ফলে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হতে পারে।

প্রমাণ ও গবেষণালব্ধ সত্য

২০১৬ সালে Celano et al.-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, উদ্বেগ বিকারে আক্রান্ত রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ২০১৫ সালের আরেক গবেষণায় আলসার, হাঁপানি ও হৃদরোগের সাথে উদ্বেগের সরাসরি সংযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালের স্টাডিতে প্রবীণদের মধ্যে উদ্বেগ ও হৃদরোগের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে।

Psychosomatic উপসর্গসমূহ

দুশ্চিন্তা মূলত মানসিক হলেও তার বহিঃপ্রকাশ হয় দেহে। কিছু সাধারণ উপসর্গ:

  • পেটের সমস্যা: ব্যথা, ডায়ারিয়া, বমিভাব
  • মাথাব্যথা: টেনশন হেডেক বা মাইগ্রেন
  • ঘুমের সমস্যা: অনিদ্রা ও দুঃস্বপ্ন
  • হৃদযন্ত্রের উপসর্গ: বুক ধড়ফড়, ব্যথা
  • শ্বাসকষ্ট: শ্বাস আটকে যাওয়ার অনুভূতি
  • কম্পন ও পেশী টান: ঘাড় ও কাঁধে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা

এই উপসর্গগুলোর পেছনে যদি অন্য কোনও শারীরিক রোগ ধরা না পড়ে, তবে তা দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ভূত মনোদৈহিক উপসর্গ হতে পারে।

দুশ্চিন্তা মানসিক চাপের চেয়ে অনেক বেশি কিছু—এটি একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি। একে অবহেলা করলে তা কেবল মনের নয়, শরীরের প্রতিটি কোণায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই সময়মতো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা ও চিকিৎসা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ