নার্স সংকটে স্বাস্থ্যখাত, ঘাটতি ৮২%

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ১২ ০৮:৫০:৫৮
নার্স সংকটে স্বাস্থ্যখাত, ঘাটতি ৮২%

সত্য নিউজ: বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রয়োজনীয় নার্সের ঘাটতি ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে অন্তত ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ জন নার্স থাকা প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে কর্মরত নার্সের সংখ্যা মাত্র ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন—প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৮২ শতাংশ কম।

এই পরিসংখ্যান প্রকাশ পেল এমন এক সময়ে, যখন বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস (১২ মে)। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘নার্সের সুরক্ষা, জাতির সমৃদ্ধি’। অথচ বাংলাদেশে নার্সদের বর্তমান পরিস্থিতি সেদিকে করুণ এক চিত্রই তুলে ধরে।

স্বাস্থ্য খাতে ভারসাম্যহীন জনবল কাঠামো

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একজন চিকিৎসকের সঙ্গে কমপক্ষে তিনজন নার্স এবং পাঁচজন সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী থাকা উচিত। সে হিসাবে দেশের ১ লাখ ৩ হাজার ৫০০ জন চিকিৎসকের তুলনায় প্রয়োজন ৩ লাখ ১০ হাজার ৫০০ জন নার্স এবং ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ জন সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী। অথচ বাস্তবে ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসক রয়েছে ৮৬ হাজার ৬৭৫ জন (প্রয়োজনের তুলনায় ১৬.৫% কম), নার্স মাত্র ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন এবং সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মী ২ লাখ ৩০ হাজার ২১৯ জন (৫৫.৫% কম)। এই ঘাটতির সবচেয়ে বড় অংশ জুড়েই রয়েছে নার্সিং পেশার অনুপস্থিতি।

সেবার মানে বিপর্যয়, নার্সদের অতিরিক্ত কাজের চাপ

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও নিপসম শিক্ষার্থী মল্লিকা বানু বলছেন, "একজন নার্সের দায়িত্ব ৬ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হলেও বাস্তবে দিতে হয় ৫০ জনকে। এতে রোগী যেমন সন্তুষ্ট হন না, তেমনি নার্সরাও বার্নআউট হয়ে পড়েন।" অতিরিক্ত চাপের কারণে সেবার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি নার্সদের পেশাগত জীবনেও আসে হতাশা ও ক্লান্তি।

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পেশাগত অবমূল্যায়ন

নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সাময়িকী Policy, Politics & Nursing Practice-এ প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, নার্সিং পেশাকে বাংলাদেশে সামাজিকভাবে এখনো যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয় না। অনেকেই এটিকে 'নিম্নমানের' বা ‘অনৈতিক’ কাজ হিসেবে দেখেন। নার্সদেরকে মূলত দরিদ্র পরিবারের নারীদের জন্য উপযুক্ত পেশা হিসেবে দেখা হয়, যা এই পেশার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়।

উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিচে নার্সদের জন্য পদ নেই, উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরেও পদোন্নতির সুযোগ নেই, এমনকি সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের চেয়ে কম মর্যাদা পান নার্সরা—যদিও পরবর্তী শ্রেণির কর্মীদের ক্লিনিক্যাল ট্রেনিং ও একাডেমিক যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে কম।

নার্সিং শিক্ষার পরিকাঠামো ও নীতিগত বাধা

নার্সিং শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে প্রায় ৯০ হাজার নার্স কর্মরত থাকলেও এই সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেক নার্স নেতা অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনেও পরিসংখ্যান পুরোনো।

এছাড়া, নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে বেসরকারি উদ্যোক্তারা উৎসাহ পান না। একদিকে সম্মানজনক কর্মপরিবেশ ও ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পথ অনিশ্চিত, অন্যদিকে সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি—এই দুই মিলে নার্সিংকে এখনো জনপ্রিয় পেশায় পরিণত করা সম্ভব হয়নি।

সমাধানের পথ কী?

সাবেক নার্স নেতা ইসমত আরা পারভীন বলেন, “নার্সদের সংখ্যা বাড়ানো, তাঁদের বেতন বৃদ্ধি, এবং প্রশাসনিক ও চিকিৎসা সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। ক্লান্ত ও অবমূল্যায়িত নার্সদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যসেবায় গুণগত মান আশা করা অন্যায়।”

স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও নার্সরা বাংলাদেশে রয়েছেন অবহেলার চরম প্রান্তে। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে, একটি দেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নির্ভর করে চিকিৎসক, নার্স এবং সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অংশীদারিত্বের ওপর। বর্তমান চিত্র বলছে, বাংলাদেশে এই ভারসাম্য ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত।

এখন সময় এসেছে নার্সিং পেশাকে মর্যাদার আসনে বসানোর—শুধু নার্সদের জন্য নয়, গোটা জাতির স্বাস্থ্য-সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্বার্থেই।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ