ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনায় ভারতের এই নীরবতা কি ইচ্ছাকৃত?

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১৬ ১১:৩৪:০৩
ইসরায়েল-ইরান উত্তেজনায় ভারতের এই নীরবতা কি ইচ্ছাকৃত?

ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল যে সুনির্দিষ্ট ও ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এই হামলার নিন্দা জানাতে বিশ্বের বহু দেশ সরব হলেও ভারত যেন নীরবতার কৌশল বেছে নিয়েছে। দেশটি সরাসরি কোনো পক্ষ নেয়নি, বরং ‘উত্তেজনা প্রশমনে সংলাপ ও কূটনীতির’ আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই ‘নিরপেক্ষতা’ আদৌ কি নিরপেক্ষতা, না কি জিওপলিটিক্যাল স্বার্থে একপাক্ষিকতার সূক্ষ্ম কৌশল?

স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ছিল মূলত নীতিনিষ্ঠ এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে ভারত দীর্ঘদিন ফিলিস্তিনের অধিকার ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনার বিরোধিতা, ১৯৭৪ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (PLO)-কে স্বীকৃতি, ১৯৮৮ সালে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং দিল্লিতে দূতাবাস খোলার মতো পদক্ষেপ তারই প্রমাণ।

কিন্তু ১৯৯১ সালের পরবর্তী সময় থেকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, এবং অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে ভারতের জিওপলিটিকাল ও অর্থনৈতিক চাহিদা বদলাতে শুরু করে। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালে ভারতের সঙ্গে ইসরায়েলের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পায়।

বর্তমানে ইসরায়েল ভারতের অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী, বিশেষত স্থল ও বিমান বাহিনী, ইসরায়েলি প্রযুক্তিনির্ভর অস্ত্র, নজরদারি ব্যবস্থা, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল, রাডার এবং ড্রোনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। কার্গিল যুদ্ধে ‘ইসরায়েলি আর্টিলারি শেল’ সরবরাহ ছিল নির্ণায়ক। লাদাখ ও চীন সীমান্ত উত্তেজনায়ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে।

এর বাইরে, সাইবার নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ নজরদারি প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ভারত-ইসরায়েল অংশীদারিত্ব গভীর। এমনকি কাশ্মীর পরিস্থিতি ও বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণেও ইসরায়েলি প্রযুক্তির ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৫ সাল থেকে ভারতের জাতিসংঘে ভোটদানের ধরনেও বদল দেখা গেছে। আগে ফিলিস্তিন প্রশ্নে ভারত নির্দ্বিধায় ইসরায়েল-বিরোধী প্রস্তাবে ভোট দিত। এখন অনেক ক্ষেত্রে ভারত ‘অপস্থিত’ থাকছে বা ‘বিরত’ ভোট দিচ্ছে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঐতিহাসিক ইসরায়েল সফরে প্রথমবারের মতো কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিন সফর না করে তেলআবিবে পা রাখেন।

২০২৩ সালে গাজা যুদ্ধে যখন ইসরায়েলিরা ব্যাপক হামলা চালায় এবং হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনি হতাহত হয়, তখনও ভারত সরকারি পর্যায়ে কোনো কড়া প্রতিক্রিয়া দেয়নি। বরং, যুদ্ধের ঠিক পরপরই ভারত ১৬ হাজারের বেশি শ্রমিক ইসরায়েলে পাঠায়, যা কিছু বিশ্লেষকের মতে, ‘মৌন সমর্থনের’ সমান।

ইরান সম্পর্কেও একসময় ঘনিষ্ঠতা থাকলেও আজ সেই সম্পর্ক অনেকটাই ছায়াপাতইরান দীর্ঘদিন ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল। ২০১১ সালের আগপর্যন্ত ভারতের অপরিশোধিত তেলের প্রায় ১২ শতাংশ আসত ইরান থেকে। কিন্তু মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই বাণিজ্য এখন প্রায় স্তব্ধ।

ভারত অবশ্য ইরানের চাবাহার বন্দরে বিনিয়োগ করেছে, যা আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় ভারতের বাণিজ্যিক উপস্থিতি জোরদারের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। তবে এ প্রকল্পও নানা কারণে ধীরগতির। ইরান, চীন ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা বাড়ার পর ভারত অনেকটা নিঃসঙ্গ।

বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি যখন ইরান ইসরায়েলের ওপর পাল্টা হামলা চালায়, তখন ভারত ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করলেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলেনি। অথচ এই ইরানই একসময় ভারতীয় মুসলমানদের জন্য কাশ্মীর ইস্যুতে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাতো।

বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক অন্তত স্বল্পমেয়াদে। এটি তাকে অস্ত্র ও প্রযুক্তি সহায়তা দেয়, কাশ্মীর ইস্যুতে একটি পশ্চিমা সমর্থন তৈরি করে, এমনকি আমেরিকান ভূ-রাজনীতির সাথেও সঙ্গতি বজায় রাখে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এই পক্ষপাত ভারতের নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। গ্লোবাল সাউথের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ভারতের উচিত হবে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার প্রশ্নে আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও নীতিনির্ভর ভূমিকা নেওয়া।

ভারতের ‘কৌশলগত নিরপেক্ষতা’ এখন একরকম ‘কৌশলগত পক্ষপাত’-এ রূপ নিচ্ছে বিশেষ করে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্পর্কের বিনিময়ে ভারত কী হারাচ্ছে? ইরান, আরব বিশ্ব কিংবা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর আস্থা হারানো কি শুধু একটি সময়ের বাস্তবতা, না কি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে বড় ধরনের ছেদ তৈরি করছে?

-রফিক, নিজস্ব প্রতিবেদক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের... বিস্তারিত