স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

অহিদুজ্জামান
অহিদুজ্জামান
সম্পাদক, সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ১২ ১৩:০৮:১৩
স্টারমারের নীরবতা: কূটনৈতিক শিষ্টাচার বনাম রাজনৈতিক সংকোচ

একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, সামাজিক ব্যবসার পথপ্রদর্শক এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্রনায়ক—এই তিনটি পরিচয়ই এখন সমভাবে প্রযোজ্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি যখন যুক্তরাজ্যে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আসেন, তখন বিষয়টি কেবল একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয়—এটি ছিল বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার আন্তর্জাতিক পরিচিতি এবং সম্মান প্রতিষ্ঠার একটি পরিণত পর্ব। এই সফরের পটভূমি, বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট সবকিছু মিলিয়ে একে গভীর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্বের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে আসে।

অধ্যাপক ইউনূসের এই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—ব্রিটেনের রাজা চার্লস তৃতীয় তাঁকে "Harmony Award 2025" প্রদান করবেন বলে বাংলাদেশ সরকারের সূত্রে জানা গেছে। যদিও এখনও রাজপ্রাসাদ বা ব্রিটিশ সরকারিভাবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি, তথাপি এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা। যুক্তরাজ্যে সমাজকল্যাণ, মানবতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। অধ্যাপক ইউনূসের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের আন্তর্জাতিক প্রভাব বিবেচনায় এ সম্মান একদিকে যেমন তাঁর কৃতিত্বের স্বীকৃতি, অন্যদিকে এটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থারও প্রতিফলন।

তবে এই মর্যাদার প্রাপ্তি যতটা উজ্জ্বল, এর বিপরীতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের ‘সৌজন্যমূলক নীরবতা’ ততটাই তাৎপর্যপূর্ণ। এই সফরের প্রাথমিক সূচিতে স্টারমারের সঙ্গে ইউনূসের সৌজন্য সাক্ষাৎ অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাংলাদেশের হাইকমিশনও একাধিকবার চেষ্টার পরও সেই সাক্ষাৎ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়। The Financial Times ১১ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনেও অধ্যাপক ইউনূসের বক্তব্য তুলে ধরে বলা হয়েছে—“প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি এবং ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন কোনো বৈঠকের পরিকল্পনাও নেই।”

এই অনুপস্থিতি নিছক সময়াভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না—বরং এটি স্পষ্ট কূটনৈতিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। এবং এই অবস্থানকে যে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে তা হলো—এই সফরের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেবার পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের ভূমিকাকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা।

টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির অভ্যন্তরে একজন প্রভাবশালী নেতা এবং শেখ হাসিনার ভাগ্নি। বাংলাদেশে বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত চলছে, যা পরিচালনা করছে ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে টিউলিপ বা তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন—বিশেষ করে ঢাকায় জমি বরাদ্দ ও আর্থিক সম্পদ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে। টিউলিপ সিদ্দিক সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, তিনি কোনো সম্পত্তির মালিক নন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্র চলছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন, যদিও লেবার পার্টি তাঁর প্রতি আস্থা বজায় রেখেছে।

এই পরিস্থিতিতে টিউলিপ অধ্যাপক ইউনূসকে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন—যেখানে তিনি "লাঞ্চ বা চা"র আমন্ত্রণ জানান এবং তার বিরুদ্ধে চলমান ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে চান। অধ্যাপক ইউনূস এই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি এবং স্পষ্ট করে জানান—“এটি একটি আইনি প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়।”

এখানে ইউনূসের নৈতিক অবস্থান যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি টিউলিপের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করাটিও যুক্তিসঙ্গত, কারণ বিষয়টি বিচারাধীন। কিন্তু কূটনৈতিক সৌজন্যের নিরিখে বলা যায়—এই “না” উত্তরটি একটি সংবেদনশীল ও স্পষ্ট আইনি ব্যাখ্যাসহ প্রদান করা উচিত ছিল। অন্তত একজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী হিসেবে টিউলিপ একটি আনুষ্ঠানিক উত্তর পাওয়ার ন্যূনতম মর্যাদা দাবি করতে পারেন।

তবে আরও বড় প্রশ্ন উঠছে—প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের নীরবতা কি নিছক নিরপেক্ষতা, নাকি রাজনৈতিক সংগতির মোড়কে দলের ভেতরের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা?

এখানেই এসে যুক্ত হয় কূটনীতির জটিল বাস্তবতা। টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, এবং তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি তদন্ত চলছে এমন একজন নেতার সঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যদি সাক্ষাৎ করতেন, তাহলে তা দলীয় বিভাজন কিংবা রাজনৈতিক বিরূপতা সৃষ্টি করতে পারত। এ কারণেই অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, স্টারমার সরকারের নীরবতা মূলত দলীয় সংহতি রক্ষার হিসাবি অভিব্যক্তি।

তবে এই অবস্থান আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে একপ্রকার রাজনৈতিক দ্বিচারিতা বলেই মনে হয়। এমন একটি মুহূর্তে, যখন বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম গণআন্দোলনের মাধ্যমে একটি ফ্যাসিবাদী সরকারকে প্রতিস্থাপন করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের পথে এগোচ্ছে—ঠিক তখন যুক্তরাজ্যের মতো একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাশিত ছিল একটি কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও প্রতীকী সমর্থন।

অবশ্য ইউনূসের সফরে আইনি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার দিক থেকে অগ্রগতি হয়েছে। National Crime Agency (NCA)–সহ যুক্তরাজ্যের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্পদের খোঁজে তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ চিহ্নিতকরণ ও ফ্রিজ করার প্রক্রিয়াও চলছে বলে সূত্র জানায়। তবে এসব বাস্তব সাফল্য সত্ত্বেও, একটি করমর্দনের অভাব রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতীকে এক শূন্যতা তৈরি করেছে।

শেষত, প্রশ্নটা হয়ে দাঁড়ায়—এই সফর কি সফল? হয়তো কার্যকর অগ্রগতির নিরিখে তা সফল। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্মান ও কূটনৈতিক বার্তার দিক থেকে এই সফর একটি বড় রাজনৈতিক ‘নীরবতা’ রেখে গেছে, যা ভবিষ্যতের সহযোগিতার জোটে একটি দ্বিধার ছায়া ফেলতে পারে।

কূটনীতিতে নীরবতা অনেক সময় সবচেয়ে শক্তিশালী ভাষা হয়। আর এই সফরে স্টারমার সরকারের নীরবতা নিঃসন্দেহে একটি বার্তা পাঠিয়েছে—সেই বার্তা গণতন্ত্রের পক্ষে নাকি দলীয় সংকোচের প্রতিফলন, তা সময়ই বলে দেবে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ