ঢালিউড

'তাণ্ডব' রিভিউ: শাকিব-রাফির অ্যাকশন-থ্রিলারে এবার বাংলাদেশ বাজিমাত করলো

রাফসান খান
রাফসান খান
বিনোদন ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ জুন ০৯ ২১:০৯:১৪
'তাণ্ডব' রিভিউ: শাকিব-রাফির অ্যাকশন-থ্রিলারে এবার বাংলাদেশ বাজিমাত করলো

ঈদুল আজহার দিনে মুক্তি পাওয়া ‘তাণ্ডব’ নিঃসন্দেহে ২০২৫ সালের সবচেয়ে বহুল আলোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ বাংলা চলচ্চিত্রগুলোর একটি। জনপ্রিয় নির্মাতা রায়হান রাফির পরিচালনায় এবং শাকিব খানের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নির্মিত এ ছবিটি কেবলমাত্র একটি অ্যাকশন-থ্রিলার নয়—বরং এটি বাংলা সিনেমায় একটি নতুন যুগের সূচনা। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি টেলিভিশন চ্যানেলে মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের হঠাৎ হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া গল্পে টানটান উত্তেজনা ও রহস্য একসঙ্গে জড়িত। সন্ত্রাসীরা লাইভ সম্প্রচারে একের পর এক বিস্ফোরক দাবি জানাতে থাকে, এবং সেই দাবির পেছনে লুকিয়ে থাকা উদ্দেশ্য, শক্তি ও সংঘর্ষ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।

এই সিনেমার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এর কেন্দ্রীয় চরিত্র মাখাহিল, যাকে পর্দায় তুলে ধরেছেন শাকিব খান। তার অভিনয় নিঃসন্দেহে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা। ভয়েস মডুলেশন, এক্সপ্রেশন, শারীরিক ভাষা এবং সংলাপ উপস্থাপনার প্রতিটি জায়গায় তিনি নিজেকে ভেঙে গড়ে তুলেছেন। এমনকি সিনেমার ডাবিং চলাকালে তার মুখ থেকে রক্তপাত হওয়ার ঘটনাও প্রমাণ করে এই চরিত্রে তিনি কতটা নিবেদিত ছিলেন। প্রিয়তমা ও তুফানের পর তাণ্ডব-এ শাকিব খান যেন এক ‘পোস্ট-সুপারস্টার এরা’-র সূচনা করলেন।

সিনেমার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দুই প্রখ্যাত তারকার চমকপ্রদ ক্যামিও। সিয়াম আহমেদ একটি ছোট কিন্তু দারুণ প্রভাবশালী চরিত্রে হাজির হয়ে চমকে দিয়েছেন দর্শকদের। তার লুক, স্ক্রিন প্রেজেন্স এবং ডায়লগ ডেলিভারি ছিল অনবদ্য। অন্যদিকে, ‘সুরঙ্গ মাসুদ’ চরিত্রে আফরান নিশো তার মাত্র দেড় মিনিটের উপস্থিতিতে পুরো হল মাতিয়ে তুলেছেন। এই সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিতেই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংঘর্ষ ও সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিচালক, যা ‘তাণ্ডব টু’-এর জন্য দর্শকদের আগ্রহ বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

নায়িকাদের মধ্যে জয়া আহসান আবারও প্রমাণ করেছেন কেন তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী। তার চরিত্রটিকে যেভাবে তিনি পরিপূর্ণতার সঙ্গে ধারণ করেছেন, তা সিনেমার কাহিনি ও আবেগকে আরও গভীরতা দিয়েছে। সাবিলা নূর তার সিনেমা অভিষেকেই দর্শকদের নজর কাড়তে পেরেছেন। যদিও স্ক্রিন টাইম তুলনামূলকভাবে কম, তার অভিনয়ে ছিল আত্মবিশ্বাস ও স্বাচ্ছন্দ্য।

রায়হান রাফি পরিচালনায় আবারও প্রমাণ করলেন, তিনি যে শুধু রোমান্টিক বা সামাজিক সিনেমার নির্মাতা নন, বরং অ্যাকশন-থ্রিলার নির্মাণেও দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম। ‘তাণ্ডব’-এর ক্লাইম্যাক্স, একাধিক টুইস্ট এবং থ্রিলার ভায়োলেন্সের নির্মাণে তার মুন্সিয়ানা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এ সিনেমা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম সচেতন সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স গড়ার প্রয়াস শুরু করলেন—যা সিয়াম, নিশো ও শাকিব খানের পরস্পর সংযুক্ত চরিত্র দিয়ে এগোতে পারে।

প্রযুক্তিগত দিক থেকেও ‘তাণ্ডব’ প্রশংসাযোগ্য। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং, সেট ডিজাইন—সবকিছুতেই ছিল আন্তর্জাতিক মানের ছাপ। যদিও পরিচালক রাফি আগেই বলেছিলেন, দর্শকরা বুঝতেই পারবেন না এটি বাংলাদেশে শুট হয়েছে—তবে বাস্তবে সিনেমার লোকেশন থেকে দেশীয় ভাব কিছুটা বোঝা গেছে। তবে সেটা কোনোভাবেই সিনেমার মান বা অভিজ্ঞতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং দেশীয় প্রোডাকশনে এরকম নির্মাণ মানেই এক সাহসী পদক্ষেপ।

সিনেমার প্রাণ ছিল ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, যার দায়িত্বে ছিলেন আরাফাত মহসিন নিধি। প্রত্যেকটি সিকোয়েন্সে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এতটাই নিখুঁতভাবে বসানো হয়েছে যে দর্শকরা অনায়াসেই আবেগ ও উত্তেজনার প্রবাহে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এই মিউজিক শুধু দৃশ্যপট নয়, চরিত্রগুলোকেও জীবন্ত করে তুলেছে। বিশেষ করে অ্যাকশন দৃশ্যগুলোয় মিউজিক ছিল সাড়া জাগানো।

তবে সিনেমাটি পুরোপুরি নিখুঁত নয়। কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, বিশেষ করে ‘লিচু বাগান’ গানটি সম্পূর্ণ বেমানানভাবে ঢোকানো হয়েছে, যা গল্পের গতি থামিয়ে দেয়। এটি হয়তো একটি প্রমোশনাল গান, কিন্তু সিনেমার ভেতরে নয়, বাইরে ব্যবহার করলেই ভালো হতো। আরেকটি দুর্বলতা হচ্ছে, ব্যাকস্টোরি বা ইমোশনাল দৃশ্যগুলো এত দ্রুত গতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে যে দর্শক সেই মুহূর্তগুলোতে আবেগে ডুবে যেতে পারেননি। এতে চরিত্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সময় কিছুটা কম পড়ে যায়।

রেটিং

‘তাণ্ডব’ সিনেমাটি গল্প ও স্ক্রিনপ্লে’র জন্য ১০-এ ৮.৫ রেটিং পাওয়ার যোগ্য, যেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থ্রিল ও টুইস্ট দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখে। শাকিব খান, জয়া আহসান, সিয়াম আহমেদ ও আফরান নিশোর দুর্দান্ত অভিনয়ের জন্য অভিনয় বিভাগে রেটিং ৯.৫। নির্মাণশৈলী ও পরিচালনার ক্ষেত্রে রায়হান রাফি অত্যন্ত দক্ষতা দেখিয়েছেন, যার জন্য এ বিভাগে রেটিং ৯। সিনেমাটোগ্রাফি, কালার গ্রেডিং ও টেকনিক্যাল এক্সিকিউশনে মান বজায় রাখায় প্রোডাকশন বিভাগে রেটিং ৮.৫। বিশেষভাবে প্রশংসনীয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য পূর্ণ ১০-এ ১০ রেটিং প্রাপ্য। সব মিলিয়ে ‘তাণ্ডব’ একটি পরিপূর্ণ কমার্শিয়াল থ্রিলার, যার সামগ্রিক রেটিং দাঁড়ায় ৯/১০।

সবকিছু মিলিয়ে ‘তাণ্ডব’ একটি সাহসী সিনেমা। এটি বাংলা সিনেমার জন্য কেবল একটি থ্রিলিং অভিজ্ঞতা নয়, বরং একটি ন্যারেটিভ শিফট—যেখানে জনপ্রিয় তারকারা, নতুন প্রজন্মের অভিনেতারা এবং পরিচালক একত্রিত হয়ে ভবিষ্যতের বাংলা সিনেমার রূপরেখা তৈরি করছেন। এটি শাকিব খান, সিয়াম আহমেদ, আফরান নিশো, জয়া আহসান—সবাইকে নিয়ে বাংলা সিনেমার একটি ইন্টিগ্রেটেড ইউনিভার্স গঠনের দিকে ইঙ্গিত করে, যা প্রোডাকশন, স্টোরিটেলিং এবং মার্কেটিং—সব দিক থেকেই যুগান্তকারী হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, ‘তাণ্ডব’ কেবল একটি সিনেমা নয়, এটি একটি আন্দোলন। বাংলা সিনেমা কী হতে পারে, সেই ধারণাকে সম্প্রসারিত করেছে এই চলচ্চিত্র। যারা এখনো দেখেননি, তাদের জন্য এটি হলে গিয়ে দেখার মতো একটি পূর্ণ বিনোদন এবং গর্বের সিনেমা।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ