সিএনএনের প্রতিবেদন

ট্রাম্প-কারনি বৈঠক: বাণিজ্য যুদ্ধে সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা

বিশ্ব ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ মে ০৬ ১৯:০৮:৫৬
ট্রাম্প-কারনি বৈঠক: বাণিজ্য যুদ্ধে সম্পর্কের অগ্নিপরীক্ষা

সত্য নিউজঃ কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি আগামী মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হবেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের মধ্যে কোনো শীর্ষ বৈঠককে ঘিরে এতটা উত্তেজনা এবং রাজনৈতিক তীব্রতা দেখা যায়নি। আজ সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এই বৈঠককে "সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বিতর্কিত বৈঠকগুলোর একটি" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

কানাডা বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও কৌশলগত মিত্র। জাতীয় নিরাপত্তা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা রয়েছে। তবে সিএনএন জানিয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক ট্যারিফ নীতির কারণে সেই দীর্ঘকালীন সম্পর্ক বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই নতুন করে আলোচনার টেবিলে বসতে যাচ্ছেন দুই দেশের শীর্ষ নেতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কনীতি একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা অর্থনৈতিক সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি করেছে, অন্যদিকে কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। সিএনএন জানিয়েছে, ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কানাডার লিবারেল পার্টি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ফেডারেল নির্বাচনে অভূতপূর্ব জয় পেয়েছে, যেখানে মার্ক কারনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন। নির্বাচনী বিজয়ের পর এক দৃপ্ত ভাষণে কারনি বলেন, "আমরা আমেরিকার বিশ্বাসঘাতকতার ধাক্কা সামলে উঠেছি, তবে সেই শিক্ষাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে।"

বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপড়েন

দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (NAFTA ও পরবর্তীকালে USMCA) মাধ্যমে অর্থনৈতিক বন্ধন বজায় রেখেছিল। সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্যোগে ২০২০ সালে নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (NAFTA)-এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তি (USMCA) কার্যকর হয়। তবে চলতি বছর ট্রাম্প সেই চুক্তিতে পরিবর্তন এনে নতুন করে উত্তেজনার সূত্রপাত করেছেন।

২০২৫ সালের মার্চের শুরুতে কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর ট্রাম্প প্রশাসন ২৫% শুল্ক আরোপ করে, যদিও তা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয় দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে। সিএনএন জানিয়েছে, এখনো যেসব পণ্য USMCA-এর শর্ত পূরণ করে না, সেগুলোর ওপর ২৫% শুল্ক বহাল রয়েছে। এর পাশাপাশি, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গাড়ি, স্টিল, অ্যালুমিনিয়ামসহ একাধিক পণ্যের ওপরও ট্রাম্প নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছেন।

কানাডার পাল্টা জবাব

ট্রাম্পের এই শুল্কনীতির জবাবে কানাডা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত প্রায় ৩০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের পণ্যের ওপর সমপরিমাণ শুল্ক আরোপ করেছে। এছাড়া ট্রাম্পের ধাতু-শুল্কের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় আরও ২৯.৮ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত গাড়ির ওপরও কানাডা শুল্ক আরোপ করেছে।

সিএনএনের তথ্য অনুযায়ী, দুই দেশের এই বাণিজ্য যুদ্ধে দুই পক্ষের অর্থনীতিতেই বড় প্রভাব পড়ছে। কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের মোট বাণিজ্যের প্রায় ১৪% এর অংশীদার। কানাডাই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে ২০২৪ সালে প্রায় ৩৪৯.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি ও যানবাহন খাত শীর্ষে রয়েছে। অপরদিকে কানাডার রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি পণ্য যায় যুক্তরাষ্ট্রে, যার মধ্যে রয়েছে সফটউড লাম্বর, স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি।

প্রভাব পড়ছে ব্যবসা ও ভোক্তাদের ওপর

সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্পের শুল্কনীতি ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবসায় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। জেনারেল মোটরসের সিইও মেরি বাররা সিএনএনকে জানিয়েছেন, শুল্কের কারণে এ বছর তার কোম্পানির ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হবে। ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রেও চাপ বাড়ছে। বেবি প্রোডাক্টস কোম্পানি বিজি বেবির মালিক বেথ ফিনবো বেনিকে জানিয়েছেন, একটি কন্টেইনার পণ্য আনতে তাকে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার খরচ করতে হচ্ছে, যা আগে অনেক কম ছিল।

ফেডারেল রিজার্ভের সর্বশেষ বেইজ বুক রিপোর্টে দেখা গেছে, বাণিজ্য উত্তেজনার কারণে কানাডা ও মেক্সিকো থেকে পর্যটকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সিএনএনের প্রতিবেদন বলছে, উত্তর ওয়াশিংটন এবং দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার খুচরা ব্যবসা এবং আতিথেয়তা খাতের উদ্যোক্তারা ক্রস-বর্ডার পর্যটনের এই পতনকে তাদের আয়ের জন্য উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

একই সঙ্গে কানাডিয়ানরা এখন মার্কিন পণ্য বর্জনের দিকে ঝুঁকছে। তারা ক্যালিফোর্নিয়ার টমেটোর পরিবর্তে ইতালির টমেটো, ওহাইওর তৈরি পেপারনির পরিবর্তে অন্টারিও ও কুইবেকের মাংস, এবং কোকা কোলার পরিবর্তে কানাডিয়ান ম্যাপল সিরাপ মেশানো সোডা পানি বেছে নিচ্ছেন। টরন্টোর বাসিন্দা এবং 'মেইড ইন কানাডা' অনলাইন ডিরেক্টরির পরিচালক ডিলান লোবো সিএনএনকে বলেন, "আমরা কানাডিয়ানরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিবাদ তৈরি করি না। এটি আমাদের ওপর এক ধরনের আক্রমণ।"

দুই দেশের মধ্যে এই বাণিজ্য উত্তেজনা কীভাবে মীমাংসা হবে, তা নির্ভর করছে আসন্ন বৈঠকের ওপর। সিএনএন বলছে, বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে হোয়াইট হাউসের এই বৈঠক থেকে অন্ততপক্ষে একটি গঠনমূলক দিকনির্দেশনা বেরিয়ে আসবে, যা দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে পারে।

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ