১৭ বছরের দানবীয় বিআরটি প্রকল্প: বিদেশি ঋণে জর্জরিত সরকার

জাতীয় ডেস্ক . সত্য নিউজ
২০২৫ আগস্ট ০৭ ০৯:১০:০৮
১৭ বছরের দানবীয় বিআরটি প্রকল্প: বিদেশি ঋণে জর্জরিত সরকার
ছবি: সংগৃহীত

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণ নিলেও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হয়নি। মূলত সমন্বয়হীন পরিকল্পনা, নকশায় ত্রুটি এবং বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এই প্রকল্প এখন সরকারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পের চার দফা সংশোধনের পরও কাজ শেষ না হওয়ায় আরও এক দফা অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা প্রকল্পটিকে ১৭ বছর মেয়াদী এক 'দানবীয় উদ্যোগ'-এ পরিণত করেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

২০১২ সালে ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (জিডিএসইউটিপি)’ নামে প্রকল্পটি শুরু হয়। এর আওতায় গাজীপুর থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি করিডোর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যাতে নির্দিষ্ট লেনে দ্রুত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বাস চলাচল সম্ভব হয়।

প্রকল্পের মূল ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ছিল ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। কিন্তু তিনবার সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায়। সম্প্রতি আরও এক দফা অর্থ বৃদ্ধির প্রস্তাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি)-এর কাছ থেকে।

তবে প্রকল্পের কাজ শেষ না হলেও রেয়াতকাল শেষে এখন থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। এতে করে প্রকল্প থেকে উপকার না পেয়েই অর্থ পরিশোধের দায়ে পড়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো বাস্তবায়ন হলে ঋণটি যথার্থ হতো। কিন্তু এখন এই প্রকল্প সরকারের জন্য আর্থিক ও প্রশাসনিক চাপ তৈরি করছে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বিআরটি প্রকল্প এখন এমন এক পর্যায়ে এসেছে, যেখানে থামানো বা এগিয়ে নেওয়া—দুটোই জটিল সিদ্ধান্ত। অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও পরিবহন বাস চালু হয়নি। অবকাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে পথচারীরা ফুটপাত ব্যবহার করতে পারবে না, রাস্তায় হেঁটে পারাপারও সম্ভব নয়। এমন অসংগতি প্রকল্প পরিকল্পনার শুরুতেই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।”

তিনি আরও বলেন, “পরামর্শক নিয়োগের সময় চুক্তিতে থাকে, প্রকল্প সফল বা ব্যর্থ হলে তাদের দায় নেই। কিন্তু যারা এই পরামর্শক নিয়োগ দেয়, তাদের দায় তো থেকেই যায়। আর যখন বিদেশি ঋণ থাকে, তখন প্রকল্প শেষ করার বাড়তি চাপও তৈরি হয়।”

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানায়, ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এডিবি ও এএফডি’র সঙ্গে চারটি ঋণচুক্তি হয়েছে। মোট ঋণ প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এই ঋণের সুদ ২ শতাংশ, যার সঙ্গে ম্যাচুরিটি ও কমিটমেন্ট চার্জও যুক্ত রয়েছে। পাঁচ বছরের রেয়াতকাল শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে।

এদিকে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকারের চারটি সংস্থা—সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সেতু কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ঢাকা বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট পিএলসি। কিন্তু চার দফা সংশোধনের পরও প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৭৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

ইআরডির সাবেক সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, “যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তা যদি পূরণ না হয়, তাহলে সেই ঋণ বোঝায় পরিণত হয়। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় এখন একদিকে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে, অন্যদিকে প্রকল্পের সুফলও মিলছে না।”

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সাম্প্রতিক এক বৈঠকে চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হলেও তা অনুমোদন পায়নি। বরং প্রকল্পটির খুঁটিনাটি মূল্যায়নের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি)। এর মধ্যেই মে মাস পর্যন্ত ২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

পরিস্থিতি এখন এমন যে, প্রকল্পটি বন্ধ করা যেমন সম্ভব নয়, আবার পূর্ণ বাস্তবায়নেও দরকার অতিরিক্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত প্রকল্প দেশের আর্থিক সক্ষমতার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। এখন সময় হয়েছে—এই প্রকল্পের দায় কে নেবে, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করার।

/আশিক

পাঠকের মতামত:

আপনার জন্য বাছাই করা কিছু নিউজ

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ